সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 সেই রাত

মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জী



শ্রীপতি বাবু সাউথ ইস্টার্ণ রেলওয়ের একজন রিটায়ার্ড টি.টি। তিনি বেশ অমায়িক মানুষ। ভাইপো ভাইঝি আর পরিবারের সকলকে নিয়ে হৈ হুল্লোড় করে থাকতে বড়োই ভালোবাসেন। তাঁর আরো একটি বড়ো গুণ হল তিনি দারুণ গল্প বলিয়ে। তাই অবসর সময়ে তাঁর ভাই ভাতৃবধূ ও ভাইপো ভাইঝিরা সবাই একদিন আবদার করে বলল আমাদের আজ একটা ভূতের গল্প শোনাতেই হবে অন্য কোনো গল্প শুনব না। শ্রীপতি বাবু হেসে বললেন ভূতের গল্প? বেশ! সে না হয় শোনাচ্ছি। তবে ভয় পেয়ে কারোর পালিয়ে যাওয়া চলবে না কিন্তু। তাছাড়া মাঝপথে আমাকে থামিয়ে কোনো প্রশ্ন করাও যাবে না। তাহলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাবো। সঙ্গে সঙ্গে সকলে একসাথে জোরে গলা মিলিয়ে বলল না না আমরা কেউ এমন করব না। তুমি গল্পটা বলো এখনই। শ্রীপতি বাবু একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন আজ যে গল্পটা তোদের শোনাতে যাচ্ছি তা আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এবং সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা।

আমি তখন বছর দেড়েক হল রেলের চাকরীতে জয়েন করেছি সবে একজন টিকেট এক্সামিনার হিসেবে। একদিন ডিউটি দিতে ট্রেনে উঠে প্রচণ্ড শরীর খারাপ আর অস্বস্তি শুরু হল। অথচ উঠেছিলাম এসি থ্রী টায়ারে। এমনিতেই তখন ঘোর বর্ষা। তার ওপর ঘূর্ণী ঝড়ের পূর্বাভাস থাকায় অনেক যাত্রী টিকেট ক্যান্সেল করে দেয়। ফলে ট্রেনটা ফাঁকা ফাঁকাই ছিল। একটা কোচে সাইডের লোয়ার বার্থে হেলান দিয়ে বসে রইলাম বিশ্রাম নিতে।  ভাবলাম সেরকম ভীড় নেই যখন একটু না হয় দেরীতেই ডিউটি শুরু করা যাবে। এদিকে চিল্ড এসিতেও গরম লাগছিল ভীষণ। একটু পরেই মনে হল কেউ যেন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে আমার গা ঘেঁষে বসে রয়েছে। কাউকে দেখতে পাই নি অথচ একটা শীতল অস্তিত্ব অনুভব করছি। সীটে আধশোয়া হয়ে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। আরাম বোধ হচ্ছিল বেশ। চোখ দুটো বোজাই ছিল। আস্তে আস্তে চলে গেলাম ঘোরের ভিতরে। খুব চেনা একটা চেহারা দেখতে পেলাম তবে তার মুখটা অস্পষ্ট। আমার সাথে হ্যাণ্ডশেক করে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করছে! আচমকা জোর ঝাঁকুনিতে ঘোরটা কেটে গেল আমার। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা খেয়াল নেই। জেগে দেখি আশপাশে কয়েকজন মাত্র হাতে গোনা প্যাসেঞ্জার যে যার মতন নিজের বার্থে আপনমনে শুয়ে বসে আছে। কেউ কেউ চা কফিও খাচ্ছে। অর্থাৎ ট্রেনটা থেমেছে কোথাও। হাত ঘড়িতে টাইম দেখে জানলার পর্দা সরাতেই স্টেশনের নামটা দেখে চমকে উঠলাম। চোখ কপালে উঠে গেল পুরো এতক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছি ভেবে! খড়গপুর আসতে আর মাত্র ঘণ্টাখানেক বাকী। আর আমার ডিউটি খড়গপুর পর্য্যন্তই। এরপর টিটি চেঞ্জ হয়ে যায়। 

পাশের বার্থ থেকে ছ সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে আমার কাছে এসে বলল আঙ্কেল তুমি বুঝি আজ দুপুরে ঘুমোও নি? তাই এখন ঘুমাচ্ছিলে? আমিও হেসে আদর করে বললাম হ্যাঁ রে সোনা আমি আজ দুপুরে ঘুমোই নি। তারপর হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটা বলল একটু আগে আরেকটা আঙ্কেল এসেছিল ঠিক তোমার মতনই কালো কোট টাই পড়া। আমাদের সবার টিকিট দেখে গেল। ঐ আঙ্কেলটাও আমাকে অনেক আদর করেছিল তোমার মতই! শুনেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। মেয়েটা বলে কি? টিকিট দেখে গেছে মানে? এ অসম্ভব! কারণ আজ আমার যা ডিউটি শিডিউল তেমনই নর্ম্যালি রোজ থাকে। তারপর মনে হল নিশ্চয়ই বাচ্চা মেয়েটি শিশুসুলভ কল্পনা থেকে এসব বলছে। বাচ্চারা তো কল্পনায় বহুদূর পর্যন্ত চলে যায়। তাদের ভাবুক মন অনেক কিছু দেখে শোনে কথাও বলে। তাই মনে মনে হাসলাম। কিন্তু আমার সে ভুলটা ভেঙে গেল মুহূর্তে। মেয়েটির বাবা এসে যখন আলাপ করে বললেন স্যার আমি লক্ষ্য করে দেখেছি এসির ঠাণ্ডাতেও আপনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, আপনি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন? সেজন্যই বোধহয় হঠাৎ টি.টি. চেঞ্জ হল? আপনি ঘুমোচ্ছিলেন দেখে আমি আর ডাকিনি। যাক গে! টিকিট তো চেক হয়েই গেছে সবার। আপনি বরং বিশ্রাম নিন আরো খানিকক্ষণ! তখন আমি কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলাম ফের। নাহ্! এতো শিশুর কল্পনা নয়! মেয়েটির বাবাও তো একই কথা বললেন। আসল ব্যাপারটা জানতে আমি আমার ডিউটি শুরু করে দিলাম। যার কাছেই যাচ্ছি প্রত্যেকেরই একই কথা তাদের টিকেট অলরেডি চেকড্! শুধু মাঝপথে ওঠা কিছু প্যাসেঞ্জার তাদের টিকেট চেক করালেন আমার কাছে। আমার তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। অকল্পনীয় ব্যাপার। আমি তো ডিউটি চেঞ্জ করিনি! তাহলে কে টিকেট চেক করে গেল? স্টেশন মাস্টার এবং অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করলাম যে কোনো কারণে অন্য কাউকে আজ আ্যালোট করা হয়েছে নাকি আমার জায়গায়? স্টেশন মাস্টার তো শুনেই বলে দিলেন তোমার মাথা একদম গেছে শ্রীপতি! ভাং খেয়েছো নাকি? সেম শিডিউলড রোজ তোমার। অন্য কেউ আসবে কি করে? যে রোজ আসে তার ডিউটি তো খড়গপুরের পর থেকে। সহকর্মীরাও সকলে একই কথা বলল। মাথায় বাজ পড়ল আমার। 

ওরা বিশ্বাস না করলেও এটা তো প্রমাণিত। তাহলে আমার হয়ে কে ডিউটি দিয়ে গেল এতক্ষণ? পাশের কোচে গিয়েও ঐ একই কথা শুনলাম। টিকেট চেক হয়ে গেছে। এবার আমার বেশ ভয় লাগতে শুরু করল। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় মোটেও। আমি চাইলে স্টেশন মাষ্টারকে প্রমাণ দিতে পারতাম কিন্তু আমার মনে হল এই রহস্যটা আগে উদ্ঘাটন করা দরকার। সুতরাং প্রথমেই  কয়েকজন চেনা প্যাসেঞ্জারকে টিকেট চেকারের ব্যাপারে সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। উত্তরে তারা সেই টিটির চেহারার যা বিবরণ দিল শুনে আমার হাত পা পুরো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মাথার চুল খাড়া হয়ে প্রায় মূর্ছা যাবার মতন অবস্থা তখন। যাত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা আলাপ আলোচনা শুনে সম্পূর্ণ নিশ্চিৎ হয়ে গেলাম যে ওরা কার কথা বলছে?

 ইতিমধ্যে কামরায় হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। কেউ চীৎকার করে বলছে গেল গেল পড়ে গেল! আপনারা কেউ আসুন প্লিজ। অনুগ্রহ করে এসে বাঁচান! আমি যে পারলাম না। আমরা ছুটে গিয়ে দেখি একজন প্যাসেঞ্জার ওয়াশ বেসিনের নীচে বসে জোরে আর্তনাদ করছে আর পাগলের মত নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে বসে বসে। তারপর ভেস্টিবিউল কোচের মাঝখানের প্লেটগুলো দেখিয়ে বলছে  পারলাম না আমি। বাঁচাতে পারলাম না ওনাকে! কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে তুলে তার সীটে এনে বসিয়ে দিল। আমি  জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আপনার? কাকে বাঁচানোর কথা বলছেন আপনি? ভদ্রলোক আতঙ্কিতও ছিলেন যথেষ্ট। করুণ সুরে বললেন 'আমি একটু আগ বেসিনে হাতমুখ ধুতে গেছিলাম। তখন দেখলাম যিনি আমাদের টিকিট চেক করে গেছেন সেই টি.টি সাহেব পাশের কোচে যেতে গিয়ে ভেস্টিবিউল কোচের ঐ মাঝের প্লেটে দাঁড়িয়ে রেজিস্টারে লেখালেখি করছেন যেমনটা অনেক চেকারই করে থাকেন। উনি আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন। 

হঠাৎ দুম করে একটা বিকট শব্দ হল। মুহূর্তের মধ্যে উনি দুটো প্লেটের মাঝখান দিয়ে গলে ট্রেনের তলায় পড়ে গেলেন। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না!' শুনে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সবাই ! আর আমার অবস্থা? সে আর কাকে বলব? আমি তো আসল ব্যাপারটা বুঝে গেছি ততোক্ষণে। কিন্তু সেটা যে কি ভয়ংকর ঘটনা কেউ কি তা বিশ্বাস করবে আমি বললেও? দীর্ঘশ্বাস ফেলে তবু বললাম শুনুন সকলে একটা ঘটনা আপনাদের বলি। অযথা এতটা কষ্ট পেয়েও লাভ নেই। ঘটনাটা শোনার পর সেটা সত্য কি মিথ্যা তা বিচার করে আপনারা যা ভাবার ভাববেন। সকলেই বলল নিশ্চয়ই শুনবো আমরা। স্যার! বলুন আপনি। যাত্রীরা সকলেই আমার দিকে চেয়ে রইলো শোনার অপেক্ষায়। আমি বলতে শুরু করলাম। গতবছরের ঘটনা। সেদিন কোনো বিশেষ কারণে চেকিংয়ে খুব কড়াকড়ি থাকায় আমার সাথে আমারই এক সহকর্মী টি.টি বন্ধু কমলেশও এই ট্রেনে ডিউটিতে ছিল। আমরা সেদিন ডিউটি ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম। কমলেশ আমার প্রিয় বন্ধু।  

আমি ডিউটি সেরে ফ্রেশ হতে গেছিলাম ঐ বেসিনেই। কমলেশ তখন পাশের কোচে চেকিংয়ে যাচ্ছিল। ভেস্টিবিউল কোচ। দুটো কোচের মাঝখানের প্লেটে দাঁড়িয়ে একজনের টিকেট চেক করে খাতায় লিখছিল। হঠাৎ দুম করে প্রচণ্ড যান্ত্রিক আওয়াজ। চমকে উঠে দেখলাম কমলেশ প্লেট দুটো ভেঙে গলে পড়ে যাচ্ছে ট্রেনের তলায়! আমি ছুটে গেলাম ধরতে। ততোক্ষণে সব শেষ! কাটা পড়ে গেল চোখের নিমেষে। প্লেটগুলো এতটা ডিফেক্টিভ হয়ে আছে তা বোঝাই যায় নি আগে! চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম আমার হাত পা জিভ অসাড় হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। ভাগ্যিস ট্রেনে খুব বেশী যাত্রী ছিল না সেদিন। তাহলে যে আরো কত মৃত্যু দেখতে হত! ভাবতেই শিউড়ে উঠেছিলাম। কমলেশ যেন নিজে মরে সাবধান করে দিয়ে গেল সমস্ত যাত্রীকে। চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুর ঐ মর্মান্তিক মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারিনি। আমার সেরিব্র্যাল আ্যাটাক হয়ে গেল। তিনদিন কোমায় থাকার পর কোনোরকমে যমের দুয়ার থেকে ফিরলাম। সেও সম্ভব হল কমলেশের দৌলতেই! জ্ঞান ফিরে মনে হয়েছিল তাকে হাসতে দেখেছি কোমায় আমার পাশে গা ঘেঁষে বসে। আর এখন তো বুঝতেই পারছি আজ সন্ধ্যবেলায় অসুস্থ হয়ে ঘুমের ঘোরে আমি তাকেই দেখেছি। হ্যাঁ ওইই তো আমার সাথে দেখা হলেই হ্যাণ্ডশেক করত। জড়িয়ে ধরত। আজো আমার খুব কাছে ঘন হয়ে বসেছিল তাই অনুভব করেছি তাকে। সত্যি সত্যিই এসেছিল কমলেশ। আজই যে তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী! সে তার প্রিয় বন্ধুকে (আমায়) ঘুম পাড়িয়ে ডিউটি করে গেল। 

ঘটনাটা শুনে সকলে তখন নির্বাক কথাশূন্য। আশেপাশের বগি থেকেও ততোক্ষণে যাত্রীরা ছুটে এসেছে। সব শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েকজন। বাচ্চা মেয়েটির মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরল আতঙ্কে দুঃখে। তার বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। আবার অনেকেই ভয়ে ফ্যাকাশে মুখে হাঁ করে বেসিনের দিকে চেয়ে রইল। সেই ভদ্রলোকটিও তখন সব কথা হারিয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বললাম  আপনি যাকে দেখলেন সেইই আমার প্রিয় বন্ধু কমলেশের আত্মা। গতবছর ঠিক আজকের দিনেই তার মৃত্যু হয়েছে ট্রেনে কাটা পড়ে। ঐ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে গেল সে আপনার সামনে। 

0 comments: