সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

28,047
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 জলছবি

পাদক



এই সবিতা,ওমন করে কি দেখছিস?রাস্তা দেখে হাঁট।নইলে গাড়ি চাপা পড়বি তো!রাস্তা দেখে চল....।সবিতা মাসির হাতটা চেপে ধরে বলে,কতো বড়ো বড়ো বাড়ি,কতো গাড়ি,আর কতো লোকজন!তুমি আমাকে কোন বড়ো বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছো মাসি?পাশের একটা বাড়িকে দেখিয়ে বলে,সেটা কি এত্তো বড়ো বাড়ি?মাসি সবিতার হাতটা ধরে একটু টেনে রোদের মধ্যে চলতে চলতে বলে,হ্যাঁ রে হ্যাঁ,এর থেকে বড়ো বাড়ি...চল তাড়াতাড়ি চল,গেলে দেখতে পাবি।

কলকাতা থেকে একশো কিলো মিটার দূরের এক গ্রামের পুকুর পাড়ে ছোট্ট ঘর সবিতার।মামা বাবা দুই বোন আর এক ভাইয়ের আম গাছের ছায়ায় ঢাকা একখানি উঠোন।পাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের একটুকরো ফালি সবিতার বাবা রাধাকান্ত রায়ে।বাকি জমি বাঁধা দিয়ে সেই টাকায় সংসার চালিয়েছেন।সেই একফালি জমি চাষ করে এতো গুলো মুখের ভাত জোগানো প্রায় অসম্ভব তার।দারিদ্রতা আর অনাহার এ পরিবারের নৃত্য অতিথি। সবিতা এই পরিবারের বড়ো মেয়ে।বিবাহ যোগ্যা হয়ে উঠলেও রাধাকান্ত বাবু টাকার অভাবে মেয়ের বিবাহের ব্যাবস্থা করে উঠতে পারেননি।সবিতা ভাই বোনের দুবেলা দুমুঠো মুখের ভাত তুলে দেখার জন্যে দুর সম্পর্কের এক মাসির হাত ধরে এই প্রথম কলকাতার শহরে।

বিশাল বিল্ডিংয়ের সাত নম্বর ফ্লাটের কলিং বেল চাপতেই এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন।অবাঙালী হয়েও বাংলাটা ভালো বলেন এবং বোঝেন।কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,কি বৌদি লোক কি পেলেন?আর তো দেরি করতে পারবো না..।কথা শেষ হতে না হতেই মাসি বলে-না না বাবু আর দেরি করতে হবে না।সবিতাকে দেখিয়ে বলে এই তো, একে এনেছি,এ আপনার সব কাজ করতে পারবে।কি সবিতা পারবি তো বাবুর সব কাজ করে দিতে? লিফ্টে চড়ে তিন তলার ফ্ল্যাটে আসা, কলিং বেল চেপে বাড়ির লোককে ডাকা,সাদা মোজায়িকের সাজানো গোছানো ঘর...এই সব যেন সবিতা স্বপ্নের মতো দেখছিলো তাই সবিতা মাসির কথা শুনতে পাইনি।মাসি সবিতার শরীরটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে বলে, কিরে পারবি তো বাবুর সব কাজ করে দিতে?সবিতা মাথা নাড়িয়ে বলে, হ্যাঁ পারব।মাসি সবিতাকে মন দিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে বাবুর কানের কাছে কি যেন ফিসফিস করে সবিতাকে রেখে ফিরে যায়।

এদিকে মাসি চলে যেতে বাবু সবিতাকে বিশ্রাম নিতে বলে নিজের কাজে চলে যায়।বাবু এ ফ্লাটেএকা থাকেন।তার আদি বাড়ি বিহারে। নাম রতন ত্রিবেদী।কলকাতায় এসেছেন কাপড়ের ব্যবসার উদ্দেশ্যে।থাকার জন্য এই ফ্লাটের একটি ঘর ভাড়া করেছেন।নিজের দেখা শুনার জন্য একটি মেয়ের প্রয়োজন।সেই জন্য বৌদিকে মোটা টাকা দিয়েছিলেন গ্রাম থেকে কম বয়সের একটি কাজের মেয়ে আনতে। কিন্তু সবিতা বুঝেছিল তাদের অভাব কষ্টের কথা ভেবে সুহৃদয় মাসি এখানে কাজ করতে এনেছে। 

সন্ধ্যে বেলায় বাবু ফ্লাটে ফিরে এসে কিছু নতুন কপড় চোপড়,সাজ-গোছের দ্রব সামগ্রী,শাখা সিঁদুর সবিতাকে দিয়ে বলেন,এবার থেকে এসব পরবে তুমি।আর আমি তোমাকে যে ভাবে থাকতে বলবো সে ভাবে থাকবে।সবিতা শাঁখা সিঁদুর দেখে চমকে ওঠে।শাঁখা সিঁদুর দেখিয়ে বলে এসব পরবো কেন বাবু?আমি যে আপনার এখানে কাজ করতে এসেছি?এতো বিয়ের পরে ঘরের বৌ পরে! আমার তো বিয়ে হয়নি?বাবু মুচকি হেসে বলেন,বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে?ভেবে নাও আমি তোমাকে বিয়ে করেছি।আর এখানে কাজ করতে হলে শাঁখা সিঁদুর পরতে হবে।দেখনা তোমার মাসি শাঁখা সিঁদুর পরেই তো কলকাতায় কাজ করে।সবিতা মাথা নাড়িয়ে বলে, নানা বাবু আমি এ সব পরতে পারবো না।মাসির বিয়ে হয়েছে বলে মাসি এ সব পরতে পরে,আমি পারবো না।বাবু একটি কাগজে দেখিয়ে বলেন,এখানে তুমি সই করলে আমরা স্বামী-স্ত্রী।তাহলে তুমি এসব পরতে পাবেনা কেন? তুমি এসব না পরলে তোমাকে আমি রাখতে পারবো না।আর তুমি আমার সাথে বাইরে যেতে পারবে না,কাজও করতে পারবে না। আর কাজ না করলে ভাই বোন মা বাবাকে খাওয়াবে কি করে?তুমি কাজ করলে তোমার ভাই বোন ভালো খেতে পাবে, পরতে পারবে, স্কুলে যেতে পারবে।বাবা জমিতে চাষ করতে পারবে।ভেবে দেখ তুমি কি করবে...

কেন এসব পারবে না বুঝতে না পেরে সবিতা কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,বাবু আমাকে কি করে বিয়ে করবে?আমরা কি ভাবে স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাব?বাবুএকটা লেখাঝোকা একটা কাগজ দেখিয়ে বলেন,এ কাগজে সই করলে আমরা স্বামী স্ত্রী..আমরা এক সাথে থাকবো,ঘুরবো ফিরবো...আমাদের কোন বাঁধা থাকবেনা।দাও এখানে একটা সই করে দাও।সবিতা রাজি হয়ে বলে,দাঁড়ান বাবু,আমি এই লাল শাড়িটা পরে আসি..

সবিতা লাল শাড়িটা পরে এসে বলে,আপনি এবার আমাকে শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে দেন।বাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবিতা বলে কি বাবু পরিয়ে দেন।কাগজে সই করবো না?বাবু কতোকটা ইচ্ছায় কতোকটা অনিচ্ছায় সবিতার দুহাতে শাঁখা,মাথার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলেন।সবিতা শিহরিত হৃদয়ে দুরু দুরু বুকে স্বামীর পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে কাগজে একটা সই করে দিল।

এই জানালা দরজা দেওয়া বদ্ধ ঘরে সবিতার শাঁখা সিঁদুর পরা,সই স্বাক্ষরে স্বামী স্ত্রীর নতুন জীবন শুরু।না হলো মন্ত্র পাঠ,না হলো অগ্নিসাক্ষী।তবু সবিতা এখন কোটিপতি স্বামীর স্ত্রী!সোনা-দানা, গাড়ি-বাড়ি সবই এখন তার।ঘরে কাজের মহিলাও আছে।রান্নাবান্না তাকে আর করতে হয়না। কিন্তু নিজের হাতে সাজিয়েছে ঘরের প্রতিটি কোণ। এককথায় সুখি দাম্পত্য জীবন সবিতার। স্বামীর হাত ধরে গঙ্গা বক্ষে নৌকা বিহার, ভিক্টোরিয়ার খোলা মাঠে হাওয়া খাওয়া,পার্কের বেঞ্চিতে বসে একান্ত নিভৃতে সময় কাটানো-এসবে কটাদিন ধরে কলকাতা শহরটা চষে বেড়িয়েছে সে।এখন কলকাতার অলি গলি প্রায় সব চেনা তার।নিজের গাড়িতে ড্রাইভার নিয়ে গ্রামের বাপের বাড়িতে গিয়েছে অনেকবার।বাপের বাড়িতে গিয়ে হাঁস গুলোকে আর কোলে করে পুকুরে ছাড়নি সে,গরুর জন্যে মাঠের আলের কচি ঘাস কাটেনি সে,ডোবা জলে নেমে কলমির ডগা তোলেনি সে।সে এখন কলকাতার কোটি পতি স্বামীর বৌ।বাবা মা ভাই বোনকে কলকাতায় এনেছেও অনেকবার। শুধুমাত্র সবিতার স্বামী কখনো সবিতার গ্রামের বাড়িতে যাইনি।গ্রাম্য জীবন নাকি তার ভালো লাগে না।

এক দুই করে সবিতা বিবাহিত জীবনে পাঁচ বছরে পড়েছে।এখন সে সন্তান সুখে অস্থির হয়ে উঠেছে।সবিতা অনেক বার সন্তান চাইলেও স্বামী রতন রাজি ছিল না।কারণ এখন তার ব্যাবসায় খুব চাপ,ব্যাবসাটা গুছিয়ে নেবার সময়। কিন্তু এখন সবিতা আর স্বামীর কোন কথা শুনতে রাজি নয়।এখন তার সন্তান চাই। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটু তিতো হয়ে উঠলে বেশ কিছু দিনের জন্য স্বামী তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে।আর বলেছে এবার সে নিজে এসে তাকে নিয়ে যাবে।এ জন্য সবিতা মাসখানেক বাপের বাড়িতে।এই দু-তিন দিন হলো স্বামীকে ফোনে পাচ্ছে না।স্বামীর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে সবিতার মন।আর অপেক্ষা না করে একাই চলে আসে কলকাতার ফ্লাটে।

সবিতা ফ্লাটের এসে দেখে দরজায় একটা নতুন তালা ঝুলছে।স্বামীকে যতবার ফোন করে ততবার বলে ফোনটি সুইচ অফ আছে। এমন সময় সাত নম্বর ফ্লাটের তালার চাবি নিয়ে হাজির ফ্লাটের মালিক অমল স্যানাল। সঙ্গে নতুন ভাড়াটিয়া।সবিতা তার দরজার নতুন তালার কথা জিজ্ঞাসা করতে মালিক বলেন---
এ ঘরে আগে যে ছিলেন তিনি সুরেশ ত্রিবেদী।বাড়ি কাশ্মীর।সেখানে তার বৌ বাচ্ছা।কলকাতায় এসেছিল পাঁচ বছরের জন্য শালের ব্যাবসা করতে।ব্যাবসা শেষ ঘর ছেড়ে চলে গেছে। আবার এই নতুন ভাড়াটিয়া....

সবিতা চিৎকার করে কেঁদে বলে,এ হতে পারে না।এ ঘরে যে ছিলেন সে রতন ত্রিবেদী,আমার স্বামী।বাড়ি বিহার।সেখানে তার কেউ নেই।তাই এখানে এসে এই সাত নম্বর ফ্লাটটি কিনেছে... এখানেই তার সব।

অমল স্যানাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন-এটাই যে কলকাতা বোন। ইট কাঠ পাথরের ঘেরা আকাশটা খুব ছোট।এখানে পাখি খুব সহজে আকাশে হারিয়ে যায়,আর একবার হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যায় না।এখানে সবই সম্ভব।সবিতা দেওয়াল ধর মেঝেতে বসে পড়ে। চোখের জল বুক ভিজিয়ে মেঝেতে টপ টপ করে পড়তে থাকে।এসব মিথ্যে হয় কখনো!শাঁখা সিঁদুর, স্বামী স্ত্রী,ঘর সংসার-এসব মিথ্যে!টাকা দিয়ে এসবোও হয়!গ্রামে ছোট বেলায় পুতুলের বর বৌ খেলেছে সে।এখানে যে মানুষ সত্যিকারের বর বৌ খেলে তা ভাবতেই পারছে না সবিতা। হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখে অমল স্যানাল সবিতাকে মেঝে থেকে তুলে বলেন-কান্না করে কি হবে বোন?এখানকার দেওয়ালের পাঁজড়ে সহজে কান্নার দাগ লাগে না। চলো আমার সাথে নীচে, আমার গাড়ি আছে....।

0 comments: