সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
সম্পর্ক
বিনয় হাজরা
তখনও রাধানাথের নিষ্প্রাণ দেহ স্বর্গরথে শায়িত । কাছের মানুষজন ও প্রতিবেশিদের দেওয়া মালা ও পুষ্পস্তবকে মরদেহ আচ্ছাদিত ।
গাড়ি রওয়ানা হতে দেরি হচ্ছে স্ত্রী দেবলীনার নির্দেশে । কন্যা কুহেলি এ বিষয়ে প্রশ্ন করেও সদুত্তর পায়নি মার মুখ থেকে ।
ইতিমধ্যে কীর্তনের দল দু' পশলা হরিনাম গান করে অপেক্ষায় রয়েছে । শ্মশান যাত্রীরাও প্রস্তুত । রাধানাথের অকাল প্রয়াণে মহল্লার সকলে মর্মাহত । নামী গাইনি ডাক্তার হিসেবে তাঁর চলে যাওয়া এলাকায় শোকের আবহ তৈরি করেছে ।
কুহেলি বারবার মার বুকে আছড়ে পড়ে অবিরাম কেঁদেই চলেছে । দেবলীনা কিন্তু পাথর প্রতিমার মত নিশ্চল নিশ্চুপ । দু চোখে একফোঁটা জল নেই । একমাত্র কন্যার জন্য সান্ত্বনার কোন বাক্যও বেরোয়নি মুখ দিয়ে । শুধু পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে গেছে ।
ক্রমশ সমাগত মানুষজনে র ভিড় পাতলা হয় । খুব কাছের কিছু মানুষজন থেকে গিয়ে শেষযাত্রার তদারকিতে ব্যস্ত । কুহেলি মার জন্য ভাবিত। মা একটু কাঁদলে যেন সে স্বস্তি পায় ।
আঠারো বছরের দাম্পত্যজীবনে আর দ্বিতীয়বার দেবিনাকে গর্ভধারণ করতে হয়নি । গাইনোকলোজিস্ট স্বামী প্রথমবারেই সিজার করার সময় স্ত্রীর অগোচরে সে সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দেয় । দেবলীনারও এ ব্যাপারে পরে কোন আগ্রহ বা উদ্যোগ দেখা যায়নি ।
তার একজন ডাক্তার স্বামী হোক এ বিষয়টা ঘোরতর অপছন্দ ছিল দেবিনার । ডাক্তার তার কাজ নিয়ে সারা দিন ,এমনকি রাতেও ব্যস্ত থাকবে , এটাই বাস্তব । ঘটেছিলও ঠিক তাই । স্বামী সময় দিতে পারবে না বলে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রীটিকে বেছে নিতে হয়েছিল শিক্ষিকার জীবন ।
- - - 2
বিয়ের মণ্ডপে সারাক্ষণ কেঁদেছিল দেবলীনা। সিঁদুর দানের সময় তো হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে । রাধানাথ থমকে গিয়েছিল। তা হলে কি মেয়েটির এই বিয়েতে মত নেই ? ও কি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় ? অন্য কাউকে ভালবাসে ? শেষের এই সম্ভাবনার কথাটাই যেন চেপে বসেছিল তার মনে ।
রাধানাথ কিছুক্ষণ থমকে অপেক্ষা করেছিল সিঁদুরের পাত্রটি হাতে নিয়ে । পুরোহিতের কথায় সম্বিৎ ফেরে : সিঁদুরটা দিয়ে দাও বাবা ।
বিয়ে সম্পন্ন হলে বাসর ঘরেও একই অবস্থা । কান্নার বেগ কমলেও সম্পূর্ণভাবে থামেনি।
এক সময় রাধানাথ বিরক্তি প্রকাশ করে ও পক্ষের এক বয়স্কা মহিলাকে বলেই ফেলে : এত যখন আপত্তি তখন বললেই হত , ফিরে যেতাম ।
সেই মহিলা জবাব দিয়েছিলেন :
বাহ্ , বেশ বললে তো ! তারপর মেয়েটার কী হত ? লগ্নভ্রষ্টা হলে আর ওর বিয়ে দেওয়া যেত ? আসলে ওর মন খারাপ হয়েছিল সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে তাই ।
রাধানাথ কিছুটা অবিশ্বাস নিয়েই তখনকার মত কথাটা মেনে নিয়েছিল , তবে বিস্ময়ের ঘোরটা বোধহয় কখনও মন থেকে দূর করতে পারেনি ।
বিয়ের পর কালরাত্রি কাটিয়ে এল সেই পরম কাঙ্খিত ফুলশয্যার রাত । দেবলীনার বিষাদের ঘোর তখনও কাটেনি । রাধনাথ স্বাভাবিক নিয়মেই ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েও বিশেষ সহযোগিতা পায়নি তার বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে । দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বেশ ক'দিন নিজেকে সংযত রাখতে বাধ্য হয় । একজন শিক্ষিত পরিশীলিত মনের মানুষ হিসেবে চেষ্টা করেছে স্ত্রীর মনোরঞ্জনের । দিন সাতেকের অপেক্ষার পর স্বাভবিকভাবে পেয়েছে নিবিড় সান্নিধ্য ।
হঠাৎ সরকারি নির্দেশে হপ্তাখানেকের জন্য রাধানাথকে উত্তরবঙ্গে যেতে হয় । ফিরে এলে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক বিস্ময় ।
- - - 3
উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরেই রাধানাথ স্ত্রীর কিছু শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে । বুঝে যায় দেবিনা কনসিভ করেছে । গাইনি ডাক্তারের চোখে এসব খুবই পরিচিত সিম্পটম । রাধানাথ তারিখের হিসেব মেলাতে পারে না । তার চিন্তায় আসে না এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে । মনে করতে পারে না আদৌ কোন শরীরী সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল কিনা । মনকে প্রবোধ দিয়ে স্বস্তি পেতে চায় , বোঝাবার চেষ্টা করে হয়ত ঘুমের ঘোরে কোন দুর্বল মুহূর্তের ফলশ্রুতিতেই এমনটা ঘটে থাকতে পারে ।
ওই সব তারিখ বা সম্ভাবনার প্রসঙ্গ মন থেকে তাড়িয়ে রাধানাথ দায়িত্বশীল স্বামী ও ডাক্তার হিসেবে দেবলীলার পরিচর্যা ও ওষুধপাতির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে ।
দেবলীনা কিন্তু মনে মনে খুবই অস্বস্তি বোধ করতে থাকে । বিয়ের অব্যবহিত পরেই এই ঘটনা বিসদৃশ মনে হয় তার । এই অল্প সময়ের ব্যবধানে গর্ভধারণ করার জন্য পরিচিত মহলে অনেক কথার সৃষ্টি হবে। ওকে কটাক্ষ করবে কেউ অথবা ঠাট্টা বিদ্রুপও করতে পারে । তাই এই সম্ভাবনাকে সে সুচনা লগ্নেই সমূলে শেষ করার জন্য স্বামীকে তাগিদ দেয় । রাধানাথ তীব্র আপত্তি করে । সে বলে : আমার কাজ জীবন রক্ষা করা , তাকে বিনষ্ট করা নয় । দেবলীনা তবুও ব্যাকুলভাবে চাপ দিতেই থাকে । রাধানাথ প্রতিবারই তা নাকচ করে ।
দেবলীনার এই অনীহার জন্যই বুঝি রাধানাথের জেদ বেড়ে যায় । অনাগত শিশুটির জন্য একটা মমত্ব বোধ গড়ে ওঠে তার মনে । রাধানাথের নিবিড় যত্ন ও পর্যবেক্ষণে যথাসময়ে জন্ম হয় কন্যা সন্তানটির । রাধানাথই তার নামকরণ করে - কুহেলি ।
কী যেন এক অজ্ঞাত কারণে শিশুকন্যাটিকে অত্যন্ত আদর ও যত্ন সহযোগে রাধানাথ বড় করতে থাকে । ফলে কুহেলিও মার চেয়ে বাবার বেশি ন্যাওটা হয়ে ওঠে।
- - - 4
কুহেলি আজ অষ্টাদশী তরুণী। সেও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী এবং পড়ছে সেই একই অধ্যাপকের কাছে -- সুরজিৎ রায় , যার কাছে একসময় পড়েছে দেবলীনাও ।
কলেজের প্রথম বছর । দেবলীলাও তখন ষোড়শী । সুদর্শন বছর চব্বিশের তরুণ অধ্যাপক অনেক তরুণীর হার্টথ্রব হয়ে ওঠে । ইন্টারমিডিয়েটে ইংরেজি ক্লাসে জুলিয়াস সিজার পড়ানোর সময় দেবলীনার কিছু বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন সুরজিৎকেও মেয়েটির বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে ।
ডিগ্রি কোর্সের দু'বছরের পাঠক্রমে ইংরেজি অনার্স পড়ার সময় প্রাইভেট ক্লাসেরও দরকার হয়ে পড়ে । তাই সুরজিতের কাছে পড়তে আসা শুরু হয় । দু'বছর পড়ানোর ফাঁকে দু'জনের মনেই রঙ ধরে । জীবনসঙ্গী হিসেবে সুরজিতকেই পেতে চায় দেবলীনা । দুঃসাহসে ভর করে মাকে জানায় তার বাসনার কথা । নীতিবাগীশ ঠাকুর্দার কানেও যায় প্রস্তাবনা । সুরজিত অব্রাহ্মন এবং দেবীর শিক্ষাগুরু । গুরু শিষ্যার মধ্যে এই সম্পর্ক স্থাপন প্রাচীনপন্থী ঠাকুর্দার অনুমোদন পেল না । তড়িঘড়ি উনিই বন্ধুপুত্র নব্য ডাক্তার রাধানাথের সাথে বিবাহের একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন । তাঁর নিদান খণ্ডন করার সাধ্য ছিল না কারও । অনিবার্যভাবে এগিয়ে আসতে থাকে সেই বিয়ের দিন । প্রস্তুতি এগোনের সাথে দেবিনার মনে রোলার চলতে থাকে ।
একসন্ধ্যায় বান্ধবীদের নিমন্ত্রণ পত্র বিলি করার অছিলায় ঘর থেকে বেরোয় দেবলীনা । দেরি হতে থাকলে মাকে ফোনে জানায় বন্ধু ছাড়ছে না , আজ রাতে ফিরবে না । সুরজিতের কাছে থেকে গিয়ে এই মিথ্যাচার করতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। সে পড়েছে : এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ অ্যাণ্ড ওয়ার । শেষ চেষ্টার মত সুরজিৎকে ইলোপ করার কথাও বলে দেবলীনা । তা সম্ভব হবে না বুঝে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে । সারারাত ভর এক হয়ে যায় দুটি প্রাণ । শুধু মনেই নয় , শরীরেও ।
- - - 5
দীর্ঘ অপেক্ষার পর এলেন তিনি , অধ্যাপক সুরজিৎ রায় যার জন্য এতক্ষণ রওয়ানা হতে পারেনি শেষ যাত্রা ।
সুরজিৎ পৌঁছাতেই তৎপর হয়ে ওঠে দেবলীনা । বাইরে বেরিয়ে আসে শববাহী শকটের পিছনে । সুরজিৎ একগোছা রজনীগন্ধার স্তবক মরদেহে অর্পন করে শেষ নমস্কার জানায় । দেবলীনা সঙ্কেত দিতেই হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে স্বর্গরথ রওয়ানা হয়ে যায় ।শ্মশানযাত্রীরা আওয়াজ তোলে : বলহরি- হরিবোল । হরিধ্বনি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে । দেবলীনা সুরজিৎকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এসে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকা কন্যাকে ডেকে ধরে উঠতে সাহায্য করে ।
কুহেলির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে দেবলীনা বলে : এনাকে প্রণাম কর , ইনিই তোর বাবা ।
0 comments:
Post a Comment