সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

    শিউলি-বাড়ির স্বপ্ন               

অশোক সিংহরায়    

ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়াল দুলাল বাছাড়। 

              ভুসো কালির মতো রাতের রঙ ফিকে হয়ে আসছে। ভোরের বাতাসে হালকা ঠান্ডার ভাব। শীত যত বাড়বে খেজুর গাছের রস তত  মিঠে হবে। দুলালের মতো শিউলিরা তাই চায় রসের মরসুমের এই মাস চারেক জমিয়ে শীত পড়ুক। তবে তো গুড় বানিয়ে সুখ, গুড় বেচে দেখবে দুটো পয়সার মুখ। 

             এই চার মাসেই তো শিউলি বা গাছিদের নিয়মিত রোজগার হয়। বাকি দিনগুলোয় চাষের সময় পরের জমিতে কাজ করে কিংবা অন্যসময় জনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতে হয়। সে কাজ কোনওদিন জোটে, কোনও দিন জোটে না। 

           শিউলিদের আর কারই বা নিজের চাষের জমি আছে। দুলালেরও নিজের চাষের কোনও জমি নেই। আছে ঘরের লাগোয়া এক চিলতে জমি তাতে কটা বেগুন, ঢেঁড়শ, টমেটো, লঙ্কা, কুমড়ো গাছ ; মাচায় লাউ, সিম ; ঘরের চালে চালকুমড়ো গাছ - যে ঋতুতে যেটা হয় লাগিয়ে সারাবছরের নিজেদের সব্জীর প্রয়োজন কিছুটা মেটে। বেচা যায় না, পয়সা আসে না। উঠোনের এক কোনে দুটো পেঁপে গাছ, এক কোনে একটা সজনে গাছও ঘরের প্রয়োজনই মেটায়। নিজেদের চাষের জমি নেই বলে যেখানে যেটুকু মাটি পাওয়া গেছে, তাকেই কাজে লাগিয়েছে এরা। আর উঠোনে  দুটো বড় চুলো আছে খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার জন্য। 

              মুখ ধুয়ে বাঁক কাঁধে নিয়ে দুলাল চলল গয়লা পুকুরের ধারে যেখানে তার খেজুর সুন্দরীরা মাটির কলসিভরা রস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারই প্রতীক্ষায়। এ বছর নস্করদের থেকে দশটা গাছ জমা নিয়েছে দুলাল। নেয় প্রতিবছরই । গাছগুলোই তার অন্ন যোগায় ; গাছে উঠার আগে তাই গাছকে সোহাগভরে জড়িয়ে ধরে সে। 

               একে একে দশ কলসি রস নামাল দুলাল। বাঁকের দুদিকের শিকেতে দড়িতে ঝোলানো কলসিগুলো পাঁচটা-পাঁচটা করে বেঁধে বাঁক কাধে নিয়ে চলল ঘরের দিকে।   

              বাড়িতে ঢুকে উঠোনে রসভর্তি কলসিগুলো নামিয়ে রাখল। চুলো দুটোর উপর বসাল দুটো বড় মাটির গামলা। চুলোতে শুকনো খেজুর পাতা-কাঠ-কুটো দিয়ে আগুন ধরাল। তারপর রস ঢেলে দিল মাটির গামলায়। ততক্ষণে চলে এসেছে দুলালের বউ করবী। এর পরের ব্যাপারটা করবীরই কাজ। রস জ্বাল দেওয়া, একটু ঘন হলেই নেড়ে যাওয়া যাতে ধরে না যায় ; গুড়ের সঠিক পাক ধরলে সারি সারি মাটির সরায় পরিষ্কার সাদা কাপড় পেতে তার মধ্যে ঢেলে দেওয়া গরম গুড়। আস্তে আস্তে গুড় ঠান্ডা হবে ; জমে গিয়ে সরার মাপে ও আকারে তৈরি হবে পাটালি। এইখানেই  শিউলি-বউয়ের কেরামতি। সব কিছু ঠিকঠাক না হলে মিষ্টি রসের থেকে তৈরি পাটালিও বিস্বাদ হয়ে যাবে। তার শাশুড়ি মা হাতে ধরে করবীকে শিখিয়েছিল পাটালি গুড় বানানোর পদ্ধতির খুঁটিনাটি। মানুষটা চলে গেছে ; করবীরও পাটালি গুড় বানাতে বানাতে চুলে পাক ধরল। আজ সে ওস্তাদ কারিগর।   

               বউয়ের হাতে দায় সঁপে দিয়ে দুলাল দাওয়ায় বসে মুড়ি-গুড় খেল। আগের দিনের গুড় নিয়ে গঞ্জের সাধুখাঁদের গুড়ের আড়তের দিকে চলল। গুড় ওজন করিয়ে গুড়ের টাকা নিয়ে সে যখন বাড়িতে ফিরে এল, করবীর কাজ প্রায় শেষ। শেষবেলায় মাটির সরায় গুড় ঢালবার সময় সেও হাত লাগাল। 

          এরপর করবী চলে গেল রান্নার কাজে ; দুলাল রইল গুড় তদারকিতে । রসের কলসিগুলো ভাল করে ধুয়ে রোদে রেখে দিল শুখোতে। বেলা পড়লে এই কলসিগুলোই আবার খেজুর গাছে ঝুলিয়ে আসতে হবে। বিকেল-সন্ধ্যে-সারা রাত চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ফোঁটা-ফোঁটা রস পড়ে কলসি ভর্তি হবে রসে। 

                রসের মরশুমে শিউলিদের এটাই রোজ-নামচা। 

             আজকাল দুলাল কাজের ফাঁকে ফাঁকে কখনও কখনও উদাস হয়ে যায়। বয়েস বাড়ছে, কমে আসছে শরীরের জোর। আর কতদিনই বা সে এই কাজ করতে পারবে। করবীই বা আর কতদিন পারবে এই খাটনির কাজ করতে। তারা বসে গেলে রসের কাজ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে এই বাড়ি থেকে। পুরুষানুক্রমে চলা পেশা থেকে ছুটি হয়ে যাবে এই শিউলি-বাড়ির।   

           এই রসের গল্প থেকে  তার ছেলে-মেয়েরা সরে গেছে বহুদূরে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে চাষি-ঘরে। জামাই বাসের ড্রাইভার। ছেলে রতন কোনও দিনই গাছি হতে চায় নি। মাধ্যমিক পাশ করে বসিরহাটের আই টি আই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে পাশ করে রাঁচির  একটা নির্মাণ সংস্থায় চাকরি পেয়েছিল। মাইনে খুব বেশি পেত না। কিন্তু আস্তে আস্তে মাইনে বাড়ছিল। কয়েক মাস বাদে বাদে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি আসত। তিন বছর চাকরি করার পর অতিমারী শুরু হলে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। বহু কষ্টে রাঁচি থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল। আর ফিরে যায় নি ; ওরাও আর ডাকে নি ওকে।  এখানেও পায় নি কোনও কাজ। কিছুদিন ধরে  প্রায় রোজই সকালে বেরোয় আর ফিরে আসে সন্ধ্যেয়। কোথায় যায় দুলাল জানে না। তবে কাজের কাজ যে কিছু হচ্ছে না তা বুঝতে পারে সে । গাছিদের জীবন কত সুখের, গাছির ছেলে হয়ে তা বুঝেছে রতন। তাই খেজুর গাছে কোন দিনই হাঁড়ি বাঁধবে না সে।

                  এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল দুলাল বাছাড়দের।             

         সেই রাতে শুয়ে শুয়ে দুলাল ভাবছিল সাত-পাঁচ। হঠাৎ পাশের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হ'ল। ক'দিন ধরেই ও শুনছে ছেলে দরজা খুলে রাতের বেলায় কোথায় বেরিয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে ; দরজা বন্ধের আওয়াজ পাওয়া যায়। এক রাতে বউকে জিজ্ঞাসা করেছিল, " ছাবালডা রেতের বেলায় কুথায় যেছে?" ঘুম জড়ানো গলায় বউ উত্তর দিয়েছিল, " আমি কী জানি? গে দেকো। " দুলালও আর মাথা না ঘামিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ দুলাল বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বাইরে এল। দেখল রতন উঠোন পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। দুলাল পিছু নিল। 

               চাঁদের আলোয় হালকা কুয়াশায় সে দেখল এক ভৌতিক দৃশ্য। সরকারদের বাড়ির পাশে মাঠের ধারে যে খেজুর গাছটা আছে রতন তাতে চড়ছে। 

রস চুরি করার ছেলে তো রতন নয় !  ওই গাছটা তো শুখনো। ওর থেকে রস হয় না। আর রতন গাছে উঠতে শিখলই বা কবে।

 দুলাল অবাক হয়ে দেখল গাছের ডগায় উঠে রতন আবার নেমে আসছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠছে, আবার নামছে। 

দুলাল ভয় পেয়ে গেল। ছেলেটা পাগল হয়ে গেল নাকি? নাকি ভূতে ধরেছে ! 

নিজেকে সামলাতে পারল না দুলাল। রতন এবার গাছ থেকে নামতেই দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, "কেডা আমাগো এই ক্ষেতিডা কইরলরে ! " 

বাবার উদ্বেগে কোন গুরুত্ব না দিয়ে উচ্ছ্বাস ভরা গলায় রতন বলল, " আজ পেরিছি ! " 

দুলাল আস্বস্ত হল। সে বুঝল যে রতন বেশ কিছুদিন ধরে রাত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাইকে লুকিয়ে খেজুর গাছে চড়া অভ্যাস করছে। 

ছেলে কি তাহলে গাছি হতে চায় ! 

          কোন কথা না বলে দুলাল রতনকে নিয়ে ঘরে ফিরে এল। করবী  দাওয়াতে দাঁড়িয়ে ছিল। 

দুলাল তাকে উদ্দেশ্য করেই বলল, " ল্যাখাপড়ি করি ছাবাল এখন গাছি হব্যে "। 

যখন ছেলে পড়াশোনা শিখে বাইরে গেল চাকরি করতে দুলাল দুঃখ পেয়েছিল। এখন আবার তার আক্ষেপ সেই দিন-আনি-দিন-খাই গাছিই যদি হবে, তাহলে লেখাপড়া শিখে কী লাভ হ'ল ! 

রতন জবাব দিল, " ইসব খাজুর রসের লেগে। নলেন গুড়ের লেগে।আমি মোয়ার বেওসা কইরব।"

          কদিন ধরে ঘুরে ঘুরে রতন জেনে এসেছে কোথায় পাওয়া যায় কনকচূড় ধানের খই, ভালো গাওয়া ঘি, ক্ষীর, কাজু-কিসমিস-পেস্তা।জয়নগরের ওস্তাদ কারিগরের কাছে গিয়ে গিয়ে   শিখে এসেছে ভালো মোয়া বানানোর পদ্ধতি। জয়নগরের মোয়া ভারতের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সারা দেশে  হয়েছে তার সুনাম।         

          দুলাল বলল, " মোয়ার নলেন গুড়ের লেগে জিরেন কাঠের রস লাইগবে। " 

           এবার মুখ খুলল করবী, " ছাবাল বাগুইদের থেইকে লতুন কডা গাছ জমা লিছে। তুমি রসের লেগে গাছ বানাই দেবা। "

           দুলাল বলল, " দুবো, দুবো।  দুবোনি? আমার ছাবাল ! "  

         দুলাল এবার বুঝতে পারল এইজন্যই মায়ে-পোয়ে পড়ে থাকা চালাটা সাফ-সুতরো করছিল। ওইটাই হবে মোয়া তৈরির পাকশালা। করবী ছেলের পরিকল্পনার সবটাই জানে।          বাগুই বাবুর থেকে নতুন পাঁচটা খেজুর গাছ দুলালই জমা নিতে গিয়েছিল। দেয় নি। রতন বোধহয় বাগুইদের আড়তেই তার মোয়া দেবে। তাই বাগুইবাবু ওকে নতুন খেজুর গাছ কটা জমা দিয়েছে। 

          মনে শান্তি নিয়ে দুলাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। রতনও ঢুকে পড়ল তার ঘরে।

            ঘুমের মধ্যে দুলাল স্বপ্ন দেখে করবী এক চুলোয় জ্বাল দিচ্ছে তার পাটালির রস ; আরেক চুলোয় জ্বাল দিচ্ছে রতনের নলেন গুড়ের রস। স্বপ্নের মধ্যেই দুলাল বলে উঠে, " পাটালির রসের পাক আর নলেন গুড়ের রসের পাক কিন্তুন এক লয়। নলেন গুড়ের রস জ্বাল হবে ঢিমে আঁচে। " করবী জবাব দেয়, " জানি গো, জানি। "  উঠোনে জুড়োবে পাটালি। চালাতে তৈরি হবে মোয়া। মোয়া যাবে বসিরহাট-বারাসাত-কলকাতা-বর্ধমান - শিলিগুড়ি।  

                 গোয়ালার ছেলে ময়রা হতে পারে। মাষ্টারের ছেলে ডাক্তার। শিউলির ছেলেও মোয়ার ব্যাপারী হতে পারে বইকি ! বেঁচে থাকার রস আর রসদ যোগাড়ের জন্য রাস্তা পালটানো যেতেই পারে। রাস্তাটা সোজা হলেই হল । এতগুলো বছর পৃথিবীতে থেকে লেখাপড়া না জানা শিউলি দুলাল কাছাড় বুঝেছে, সৎ ভাবে বেঁচে থাকাটাই সব। 

                  রাত শেষ না হতেই আর পাঁচটা দিনের মতো দুলালের ঘুম ভাঙে। মুখ ধুয়ে সে বাঁক, দড়ি কাঁধে নেয়। চলে গয়লা পুকুরের ধারে যেখানে দশ খেজুর সুন্দরী রসের কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতীক্ষায়।   

            আজ তার অনেক কাজ। রতনের জমা নেওয়া খেজুর গাছগুলোকে রস বের করার জন্য  সাফ-সুতরো করে ছুঁলতে হবে, তৈরি করতে হবে।   

2 comments:

তনুজা চক্রবর্তী। said...

খুব ভালো লাগল।

ANKUR ROY said...

কে বলেছে শারদ ভোরেই শিউলি শুধু ফোটে ?
সুন্দর হয়েছে।