সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
টিমটিমের বন্ধুরা
- সাগরিকা বিশ্বাস
১
টিমটিমের মন আজ বেজায় খারাপ। হবে নাই বা কেন? এতদিনের চেনা জায়গা, প্রাণের বন্ধুদের ছেড়ে চলে যাওয়া কি সোজা কথা? কিন্তু মা বলছে, ওদের নাকি যেতেই হবে ! বাবার চাকরিতে একবার ট্রান্সফার হলে না করা যায় না !
টিমটিম অতশত বোঝেনা। মায়ের ওপর রাগ করে আজ ও সারাদিন নিজের ট্রি-হাউসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এই ট্রি-হাউসে ওর বন্ধুরা থাকে। টিকিরাম, কাঠুরাম, আর পিপুরাম। ঠাকুমা বলেছে রামনাম করলে নাকি ভাল হয়, তাই ও ওর সব বন্ধুদের নামের সাথে রাম যোগ করে দিয়েছে।
টিসি-টা হাতে নিয়ে বাবা যখন প্রিন্সিপ্যালের সাথে কথা বলছিলেন, টিমটিমের খুব কান্না পাচ্ছিল। ওর ক্লাসের বন্ধুরা তখন মাঠে হৈ করে খেলে বেড়াচ্ছে। ওর প্রিয় ঝাঊগাছের পাশের বেদীর ওপর তিন্নি পা ছড়িয়ে বসে বাদাম খাচ্ছে। তিন্নি ওর সেরা বন্ধু। ওরা দুজন টিফিনবেলায় ওখানেই বসে রোজ টিফিন ভাগাভাগি করে খায়। কাঠূরামকে ওখানেই খুজে পেয়েছিল টিমটিম।
প্রথম কাঠূরাম ওকে দূর থেকে দেখেই পালিয়ে যেত। তারপর টিমটিম যখন একটা দুটো কাজু ছড়িয়ে দিতে শুরু করল, দূর থেকে দেখত, কাঠুরাম এক পা দুপা করে এসে এগিয়ে একটা বাদাম তুলে নিচ্ছে। নিয়েই রুদ্ধশ্বাসে ছুট ! কী জোরেই না ছুটতে পারে কাঠুরাম !
ধীরে কাঠূরামের ভয় কেটে গেল। এখন টিফিনবেলায় রোজ কাঠুরাম এসে টিমটিমের সাথে খেলা করে। এমনকি টিমটিমের ক্লাস্রুমের জানালা দিয়েও উঁকি মারে মাঝেমধ্যে। কালো কুচি চোখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ওকে খোঁজে। সেবার মাসখানেক পর পুজোর ছুটি পড়ে গিয়েছিল। আর স্কুল নেই, কাঠুরামের সঙ্গেও আর দেখা হয়না। ওর সাথে খুব খেলতে ইচ্ছে করত টিমটিমের। কিন্তু কী আর করবে টিমটিম! স্কুল না খুললে তো আর কাঠূরামের সাথে দেখা হবেনা।
মহালয়ার দিন খুব ভোর টিমটিম ট্রি-হাউসে এসেছে একবার। ওমা, ঢুকেই দেখে কাঠুরাম খোলা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন !
টিকিরাম অবশ্য ওদের বাড়িতেই থাকত। তবে শুরুতেই বন্ধুত্ব হয়নি। টিমটিমের পড়ার টেবিলের পাশের জানালায় টিকিরা্মের বাসা। সারাদিন টিক আওয়াজ করে ঘরময় ঘুরে বেড়ায় আর খাবার খোঁজে। টিমটিম মাঝে মধ্যে মুড়ি রেখে দিত। কিন্ত টিকিরাম সেসব ছুঁয়েও দেখেনি কোনোদিন। ঠাকুমাকে কথাটা বলায় তিনি বললেন, ওরা নাকি খালি পোকা আর ফড়িং খায়।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর বাগানে ঘুরছে টিমটিম। হঠাত দেখে, বাগানের শেষে গুলঞ্চ গাছের তলায় একটা মরা ফড়িং প্ড়ে আছে। খুব সাবধানে একটা গুলঞ্চ পাতার মধ্যে ওটা তুলে নিয়ে পড়ার ঘরে এসেছিল। তারপর সেই পাতাশুদ্ধ ফড়িংটা রেখে দিয়েছিল জানালার কোণায়। ওইভাবে রেখেই সেদিন টিমটিম চলে গিয়েছিল মামারবাড়ি।
দিন পাচেক পর ফিরে এসে দেখে ফড়িংটা নেই, পাতাটাও নেই। সেদিন আর খোঁজাখুঁজি করতে পারেনি টিমটিম। খুব ক্লান্ত ছিল বলে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা হোমওয়ার্ক করতে বসে দেখে, টেবল ল্যাম্পের ওপর টিকিরাম দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটা পাতা। খানিক্ষণ টক করে মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে শেষে খাতার ওপর পাতাটা ফেলে চলে গেল। সেদিন থেকে রোজ সন্ধ্যেবেলা টিকিরাম এসে টিমটিমের পড়ার টেবিলে চুপচাপ বসে থাকে অথবা হন্তদন্ত হয়ে সারা টেবিল ঘুরে বেড়ায়।
পিপুরামের সঙ্গে বন্ধুত্বটা অবশ্য মামাবাড়িতে হয়েছে। গরমের ছুটিতে প্রতিবার টিমটিম মায়ের সাথে মামাবাড়ি যায়। বিরাট প্রাসাদের মত বাড়ি, আশি-নব্বুই বছরের পুরনো; পিছনদিকে প্রায় এক বিঘা জমিতে ফলপাকুড়ের বাগান। সারা দুপুর টিমটিম সেই বাগানে খেলে বেড়ায়।মা কিচ্ছু বলেন না। বলবেনই বা কোন সাহসে ! দাদু দিদুন সাংঘাতিক বকে দেবেন না !
গতবছর গরমের ছুটির সময়কার কথা। ও বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় চোখে পড়ল, বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে একটা মাকড়সা জাল বানিয়েছে। আর তার ঠিক মাঝখানে হাত পা ছুঁড়ছে একটা কালো-বাদামী রঙের ডেঁয়ো পিপড়ে। যত বেরোতে যাচ্ছে, ততই আরো আটকা পড়ছে জালের তন্তুতে।।
টিমটিমের খুব কষ্ট হল দেখে। আস্তে জাল সরিয়ে দুই আঙুলে সাবধানে ধরে পিপুরামকে বের করে আনল সে। কিন্তু মাটিতে ছেড়ে দেবার পরও কিছুতেই পিপুরাম যেতে চায়না। ওর আঙুল ধরেই ঠায় বসে আছে, ছাড়ায় কার সাধ্যি ! অগত্যা টিমটিম ওকে বাড়িতেই নিয়ে এসেছিল। দিদুন হোমিওপ্যাথি খান। তার ওষুধের বাক্স থেকে একটা ওষুধভর্তী শিশি চুরি করে, পুরোটা খালি করে পিপুকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাতে। ভাগ্যিস হোমিওপাথি ওষুধ মিষ্টি হয়। সেই গন্ধ পেয়েই আঙুল ছেড়ে শিশিতে ঢুকল দুষ্টু পিঁপড়েটা।
এখন অবশ্য এরা তিনজনেই টিমটিমের ভাল বন্ধু। টিমটিম ওদের সব্বার জন্য একটা করে আইডেন্টিটি কার্ড বানিয়ে দিয়েছে, যেমনটা ওর স্কুল থেকে দিয়েছে ওকে। অবশ্য ওরা টিমটিমের মত কার্ডটা গলায় ঝোলাতে পারে না ! পিপুরামের তো গলাই নেই। কার্ডগুলো রাখা আছে ট্রি-হাউসের জানলায়।
২
বাবার সাথে টিসি হাতে নিয়ে হাত ধরে বাড়ি ফিরছিল টিমটিম। খুব কান্না পাচ্ছিল ওর। কেন বাবা-মা ওঁকে নিয়ে যাবেন দিল্লীতে? দিল্লী খুব খারাপ জায়গা। খুব গরম ! তাছাড়া তার বন্ধুরাও থেকে যাবে এখানে। ওদের কি প্লেনে উঠতে দেবে? সিকিউরিটি চেকিং-এর সময়-ই তো ধরা পড়ে যাবে ! কথাটা ভেবেই এত্ত দুঃখ হল টিমটিমের, সারা রাস্তা বাবার সঙ্গে আর কথাই বলল না।
বাড়ি ফিরেও সেদিন গুম হয়ে রইল টিমটিম। মা ঘরে স্যান্ডুইচ, কলা, মিষ্টি ভর্তী প্লেট রেখে গেছেন, সেসব ছুঁয়েও দেখেনি সে। অথচ তা কেউ খেয়ালও করল না। আজ বাবা-মা দুজনেই খুব ব্যাস্ত। সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে কিসব আলোচনা করছেন। শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে কী করে টিমটিমকে অন্য কোন স্কুলে ভর্তি করানো যায়, সেসব নিয়ে। টিমটিমের কিচ্ছু ভাল লাগছেনা। ওর বন্ধুদের ছেড়ে ও কোথাও যেতে চায়না। ঠাকুমাও বলেছে বাবাকে, “তুই যা, কয়েক বছরের তো ব্যাপার, আমরা ঠিক থাকতে পারব।“ কিন্ত বাবা কোনো কথাই শুনতে চায়নি।
পরদিন সকালে টিমটিমের ঘুম ভাঙ্গল বাবার চ্যাঁচামেচিতে। প্রথমে ঘুম চোখে কিছু বুঝতে পারেনি । পরে ঠাকুমার কাছে যা শুনল, তাতে ও অবাক হয়ে গেল।
কাল নাকি বাবা টিমটিমের টিসি-টা টেবিলের ওপর রেখেছিল। ব্যাস্ততার কারনে ব্যাগে গুছিয়ে রাখা হয়নি। আজ সকালে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে নাকি দেখেছে, একটা কাঠবেড়ালি কাগজটা নিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে বাগানের দিকে।বাবা তার পেছনে ছুটেও খুঁজে পায়নি। বাবা নাকি স্কুলে ফোন ও করেছিল, আর একটা কপি পাওয়া যাবে কিনা জানতে। প্রিন্সিপ্যাল বলে দিয়েছেন আর নাকি দেওয়া যাবেনা। ওসব নাকি একটা করেই দেওয়া হয়।
দুপুরে খাবার পর টিমটিম এসেছে তার ট্রি-হাউসে। মনটা খুব খুশি এখন। কারন বাবা বলেছে ,টিসি সার্টিফিকেট ছাড়া টিমটিমকে কোথাও ভর্তি করা যাবেনা। কাজেই ক্লাস ফাইভ অব্দি ও এখানেই পড়ুক।তারপর বাবা ভাববে। আপাতত কাল বাবা দিল্লী চলে যাচ্ছে। টিমটিম, ওর মা ও ঠাকুমা এখানেই থাকবে। আর থাকবে টিমটিমের বন্ধুরা…।
ট্রি-হাউসের দরজা খুলতেই টিমটিম দেখল, কাঠুরাম খুব মনযোগ দিয়ে একটা কাগজ কুটিকুটি করছে,টিকিরাম আর পিপুরাম সেই ছোট কাগজগুলো মুখে করে নিয়ে জানালা দিয়ে নীচে ফেলে দিচ্ছে।
টিমটিম একটু ভাল করে তাকিয়েই বুঝতে পারল,এটাই কাল প্রিন্সিপ্যাল স্যার বাবার হাতে দিয়েছিল।
টিমটিম আনন্দে হাততালি দিতেই ওর বন্ধুরা ওর দিকে তাকাল। টিমটিমের মনে হল ,ওরা সবাই যেন হাসছে। কে জানে….।?
0 comments:
Post a Comment