সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
শিহরিত রাত
সুচন্দ্রিতা ঘোষাল চক্রবর্তী
এতো অল্প বয়সে যে সংসারের হাল ধরতে হবে, তা বুঝতে পারেনি অর্ণব। বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে পঙ্গু হয়ে যায়। ডান দিকের অঙ্গের কোনো সাড় নেই। উপার্জনক্ষম বাবাই ছিলো, একমাত্র ভরসা। তার ওপর এতো বড়ো সংসার, পাঁচ ভাইবোন মিলে থাকে, সাথে বাবা ও মা। অর্ণব বাড়ির বড়ো ছেলে, সবে মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। ভাইবোনেরা খুব ছোটো। অর্ণবের খুব সখ ছিলো মস্ত বড়ো ক্রিকেট খেলোয়াড় হবে। বাবা তাকে ব্যাট ও কিনে দিয়েছিল। কিন্তু তা এখন ধূলো পড়ে গেছে। বন্ধুদের সাথে আর যেনো হেসে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না অর্ণবের।
কিছু না করলে যে ,সবাই না খেয়ে মরে যাবে , এ চিন্তাতেই থাকে সে। পাশের বাড়ির নিমাই দাদা, তাঁকে অন্য পাড়ায় চারটে টিউশন খুঁজে দিয়েছে। যা মেলে তাই ভালো। কিছু তো করতেই হবে, বারে বারে মনে বলতে থাকে অর্ণব। নিজের পড়াশোনা লাটে উঠলেও, ভাইবোনেদের যেন অভাবের আঁচ না লাগে। শুধু এক কথাই মনে করতে থাকে। অর্ণবের বাবা ছিলেন চটকল কর্মী। মিলের ওপরতলার লোকেদের ধরে তাঁর বাবার চাকরিটা, অল্প বয়সেই অর্ণবকে দিতে বাধ্য করেছে তাঁর বাবা। খুব ভোরবেলায় উঠে মিলে কাজে যায়, ফিরে একটু স্কুলে যায়। দু একটা ক্লাস করে পালিয়ে এসে আবার, মিলে কাজে লেগে পড়ে। আর বিকেল হতে না হতেই টিউশনি শুরু। এভাবেই চলছিলো তার।
মফস্বলের ছেলে অর্ণব, শীতের রাত, কনকনে ঠাণ্ডা। পড়াতে তো যেতে হবে, না হলে তারা বসে বসে এমনি মাইনে দেবে, তা তো কেউ মেনে নেবে না।অর্ণবকে, দুটো পাড়া পেরিয়ে পড়াতে যেতে হয়। বেশ খানিকটা দূর। সবার মুখে এপাড়ার মান্নাদের বাগানের সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছে। মান্নাদের বাগান পেরিয়ে পড়াতে যেতে হয় অগত্যা। ফেরার সময় বড্ড ভয় লাগে। কে যেনো এ বাগানে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছিলো, সেই নিয়ে গল্পকথা অনেক শুনেছে। বাচ্ছাছেলে, বাড়ির অভাবের টানে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোজ আসে। আর পড়িয়ে বাড়ি ফেরে।
পৌষ মাস, সবার বাড়ির দরজা বন্ধ। দরজা , জানলার ফাঁক দিয়ে একটু আধটু আলো আসছে, ব্যস এইটুকুই।চারদিক নিঝুম তখন, রাস্তাঘাট একদম শুনশান। ঘুটঘুটে অন্ধকারে, দু এক ফোঁটা আলো যেন, হঠাৎ প্রদীপের আলোর মতো, কখনো বেশি জলছে, আবার কমে যাচ্ছে। হাতের টর্চ টারো ঠিক আলো নেই।দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে, একদল কুকুর দাঁড়িয়ে আছে, পাশে একজনের বিশাল পা রয়েছে, প্রায় রাস্তা জুড়ে। অর্ণব 'জয় মা দুগ্গা নম" এই বলতে বলতে এগিয়ে গেলো। সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে, ভয়ে ভিজে স্নান করে গেছে। পিছনে ফেরার পথ ও নেই, বাড়ি যেতে হলে এই একটাই রাস্তা। মায়ের নাম নিতে নিতে এগিয়ে গেলো। যতো এগোচ্ছে দেখছে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুর দল আর নেই, একদল শূকরে পরিনত হয়ে গেল। রাস্তার পাশে সামান্য ফাঁকা জায়গা দিয়ে পেরোতে গিয়ে , নিজের জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো। খুব সামলে নিয়ে এগোতে যাবে, পাশে শুনতে পেলো , নাকি সুরে কে যেনো অর্ণব বলে ডাকছে। বলছে আয় ছোকরা কাছে আয়। দূর থেকে যে পা দেখেছিলো, সামনে আসতেই দেখতে পেলো, "আগে গোড়ালি, পিছে পা"। অর্ণবের শরীরটা ঝিম মেরে গিয়েছে। চুল ভয়ে খাড়া হয়ে গেছে। অর্ণবের চোখে গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। চেঁচিয়ে কাউকে ডাকার শক্তি ও নেই। শক্তিহারিয়ে যখন মাথায় আঘাত পেলো। হঠাৎ করে বুঝতে পারলো, এক চারচাকা গাড়ি আসছে। কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে গাড়ির কাছে সাহায্য চাইতে গেলো। বাচ্ছা ছেলের এই আকুতি দেখে, তারা, নাম, ঠিকানা জিঞ্জেস করে, অর্ণবের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলো। ভগবানের আশীর্বাদ এ যাত্রায় রক্ষা পেলো অর্ণব। বাড়িতে ফিরে প্রচুর জ্বর এসেছিলো। অর্ণবের মা জানতে পেরে, ভয়ে কাঠ হয়ে গেছিল। বললো বাবা, আর তোকে পড়াতে যেতে হবে না। আমরা ঠিক থাকবো, সবাই মিলে। তুই আমাদের প্রাণনিধি। এতো ঝুঁকি নিয়ে আর যেতে হবে না।কিছু দিন বাদে সুস্থ হয়ে উঠলেও, ওদিনের কথায় এখনো , তাঁর গা ভয়ে শক্ত হয়ে আসে।
0 comments:
Post a Comment