সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
পাথর আর গাছের গল্প
অরিন্দম ঘোষ
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, “আ রোলিং স্টোন গ্যাদারস্ নো মস”, বাংলা করলে হয়তো বা হবে “জীবনপুরের পথিক রে ভাই, কোন দেশে সাকিন নাই”, ছেলেটার গল্পটাও অনেকটা সেই রকম। কর্মজীবনের প্রয়োজনে ভেসে বেড়াতে হয়েছে স্থান থেকে স্থানান্তরে, এমনকি বেশ কিছুটা সময় স্বদেশ ছেড়ে বিদেশেও। তাই বিদেশে বসে যেমন স্বদেশের জন্যে মন কাঁদে, দেশে ফিরে এলেও তাকে বিভ্রান্ত হতে হয়। তার কাছে স্বদেশ আসলে কোন শহর, কোন সড়ক, কোন নদী! সে যে গড়িয়ে যাওয়া পাথর– গড়াতে গড়াতে ছুঁয়ে গেছে অনেক মাটি, অনেক ঘাসবন, অনেক নদী-নালা। কিন্তু তার গায়ে যেন জমতে পারেনি সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, ভালবাসার শ্যাওলা। আসলে পাথরের তো আর শিকড় থাকে না, সে তো চাইলেও গাছ হতে পারে না কখনও। পারে না এক নির্দিষ্ট কোমল জমির অভ্যন্তরে বৃক্ষমূল নামিয়ে দিয়ে প্রকৃতির জীবনরস শুষে নিয়ে নির্দিষ্ট আকাশের বুকে ডালপালা মেলতে, নির্দিষ্ট পাখি-পক্ষীর আশ্রয়স্থল হতে, নির্দিষ্ট মানুষজনকে প্রখর সূর্যের দাবদাহ থেকে রক্ষা করতে।
তবু যদি কোনও অলস দুপুরে স্বদেশের কথা মনে আসে কর্মব্যস্ত জীবনের কোনও অবসর মুহূর্তে, কী মনে আসে তার? মন সত্যিই বিচিত্র, সাম্প্রতিক টাটকা স্মৃতির সরণি ছাড়িয়ে মুহূর্তে পৌঁছে যায় সেই ছোটবেলায়। সেই মফস্বল শহরের নদীর ধার, খেলার মাঠ, স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে। জীবন কী সহজ সরল ভাবনাহীন ছিল সে যুগে! কত কিছুর অভাব ছিল, তবু কত শান্তি, কত স্বপ্ন, কত আনন্দ ছিল জীবনে। আজকের এই ইঁদুর দৌড় ছিল না পড়াশোনার ক্ষেত্রে, ছিল না প্রতিমুহূর্তে পিছিয়ে পড়ার আতঙ্ক। আজ যে যা খেলাই খেলুক না কেন, সকলে চায় সেরা খেলোয়াড় হতে। ছেলেটাকে খেলত মনের আনন্দে। জিতলে যদিও আনন্দে ভেসে যেত, হেরে গেলেও সেই আনন্দে ভাঁটা পড়ত না কখনও। আর ছিল দুষ্টুমির মজা– মিত্তিরদের আমবাগানে ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়া– জাম, জামরুল, কুল, পেয়ারা, লিচু পাড়া– পুজোর সময় রাত জেগে ঠাকুর দেখা, যাত্রা জলসা শোনা– বিকাল বেলায় সাইকেল নিয়ে টোটো কোম্পানি– আর মাঝে মধ্যে রাস্তার ধারে শালপাতার ঠোঙায় কচুরি, ফুলুরি, আলুর চপ খাওয়া। কী জানি কী ছিল সেই সব খাবারের স্বাদ তা সে এখন বোঝে না। দামি হোটেলে এখন ইচ্ছে করলেই কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে যেতে পারে সে, কিন্তু ছেলেবেলার সেই হাবুদার দোকানের এগ রোল, ফিশ ফ্রাই, মোগলাই পরোটার স্বাদের কাছে হাজার টাকার বুফে ডিনার যেন ফিকে মনে হয় আজও। হাবুদার বয়স হয়েছে, আশেপাশে আরও অনেক নতুন রেস্তোরাঁ জন্ম নিয়েছে, কিন্তু পুরোনো শহরে গেলে স্কুলের পাশের হাবুদার দোকানে একবার না গেলে যেন ঠিক বাড়ি যাওয়া সম্পূর্ণ হয় না। কিশোরবেলা পেরিয়ে যাবার পর শহরের চারটে সিনেমা হলে বচ্চনের সিনেমার লাইনে দেখা যেত তাকে। দু’ঘণ্টা আগে লাইনে না দাঁড়ালে টিকিট পাওয়া যেত না তখন। ক্রমে বচ্চনের আকর্ষণ কমল ধীরে ধীরে, কিউএসকিউটি আর এমপিকে এসে যেন একটা নতুন জোয়ার আনল তার মনে। তবু অনুচ্চারিত প্রেমের প্রথম অনুভূতিগুলো ডায়েরির পাতায় আটকেই মরে গেল নিঃশব্দে। এখনও সুযোগ পেলে একবার ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় সেই প্রথম প্রেমের পুরোনো পাড়ায়, একই ঢিপঢিপানি যেন আজও শোনা যায় তখন তার বুকে কান পাতলে।
কী যে খুঁজতে যায় সে পুরোনো শহরের বদলে যাওয়া অলিগলিতে, সেই জানে। ভাল মতোই জানা আছে যে সেই মাঠটায় এখন অনেকগুলো বাড়ি হয়ে গেছে– সাঁতারের পুকুরটা অর্ধেকটা বুজে এখন ডোবা, প্রোমোটার অপেক্ষা করে আছে পুরোটা বুজে যাওয়ার জন্যে– নদীর ধারটাও একদম বদলে গেছে– চারটে সিনেমা হলের মধ্যে মাত্র একটা টিম টিম করে চলছে কোনও রকমে– সবাই বলে হাবুদার দোকানের খাবারের সেই টেস্ট আর নেই– মল্লিকার বিয়ে হয়ে গিয়ে সে এখন অন্য শহরে কারও সুখী সংসারী ঘরনি, মা-বাবা মারা যাবার পর হয়তো আসেও না পুরোনো শহরে আজকাল। তাহলে কী রয়েছে ছেলেটার জন্যে পুরোনো মফস্বল শহরটাতে? কিছুই না। স্কুলের পুরোনো বন্ধুরা আজ হয় তারই মতো শহরছাড়া, নয়তো নিজেদের কাজকর্মে অত্যন্ত ব্যস্ত। তবু সে যায়, মাঝেমাঝেই যায় সুযোগ পেলে, আর খুঁজে বেড়ায় নিজের হারানো শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোকে। সে বোঝে টানটা ঠিক স্বদেশের নয়, এক পক্বকেশ প্রৌঢ়র হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নময় দিনের জন্যে।
2 comments:
এই স্মৃতিগুলোই আমাদের স্বদেশ। খুব সুন্দর লিখেছেন।
কী সুন্দর লেখাটি!!
Post a Comment