সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

পিঠেগাছ

(পুনর্কথন) অনন্যা অনুজা চট্টোপাধ্যায়


                   অনেক দিন আগে এক গ্রামে থাকত এক দুঃখী ছেলে -- নাম তার রাখাল। সংসারে মা ছাড়া রাখালের আর কেউ ছিল না। পরের বাড়ি ধান ভেনে তার মা ক্ষুদকুঁড়ো যা পেত, তাই দিয়ে তাদের মা-ছেলের একবেলাও ভরপেট খাওয়া জুটত না।

বছর-বছর পুজো পার্বনে গ্রামের ঘরে ঘরে কতরকম ভালোমন্দ খাবার রান্না হয়, কিন্তু সেদিনও ক্ষুদের জাউ খেয়েই রাখাল আর তার মা'র দিন কাটে।

সেবার পৌষ সংক্রান্তিতে মা'র কাছে রাখাল পিঠে খাবে বলে বায়না ধরল। মা জানে, পিঠের সাজসরঞ্জাম যোগাড় করার সাধ্য তাদের মতো গরীব মানুষের নেই। কিন্তু ছেলেমানুষ রাখাল এসব কথা বোঝে না। পিঠের জন্য সে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিল। তখন রাখালের মা বুদ্ধি করে ছেলেকে খুব জোরে জোরে কাঁদতে বললে রাখাল তাই করে।

তাকে কাঁদতে শুনে পড়শিরা জিজ্ঞেস করে, -- কি গো রাখালের মা, রাখাল কাঁদে কেন?

রাখালের মা চোখ মুছে বলে, -- কী আর বলব? আমার যেমন পোড়া কপাল! ছেলে আমার পিঠেপুলি খেতে চায়! আমি গরীব মানুষ ওসব পাব কোত্থেকে?

-- ও, এই কথা! তা পোষ পাবনের দিন। ছেলেমানুষের দুটো পিঠে খেতে তো সাধ হবেই। এতে আশ্চয্যির কী আছে? 

রাখালকে সকলেই ভালবাসত। তাই রাখালের মা'র কথা শুনে তারা কেউ একটু চালের গুঁড়ো, কেউ একটু মুচি গুড়, কেউ একটু নারকেল কোরা, কেউ একটু তেল ঘি -- এইসব দিয়ে গেল।

রাখালের মা দেখল, প্রতিবেশীরা সবই দিয়েছে, দেয়নি শুধু দুধ। তাই রাখালের হাতে আরো একবার জোরে চিমটি কেটে বলল, -- নে, আবারও জোরে জোরে কাঁদতে থাক।

মা'র কথা শুনে রাখাল আবার কাঁদতে শুরু করে দিল। এবার পড়শিরা একটু বিরক্ত হয়েই বলে, -- কি গো রাখালের মা, রাখাল আবার কাঁদে কেন?

-- দুঃখের কথা আর কত বলি তোমাদের? রাখাল আমার দুধপুলি খাবে বলে বায়না ধরেছে। আমি যত বলি, ওরে দুধ নেই। যা আছে তাই খেয়ে নে। ছেলে শোনে না, কাঁদতে থাকে।

শুনে পড়শিদের মনে দয়া হল। তারা এবারও রাখালের জন্য বাড়ি বয়ে এসে  দুধ দিয়ে গেল। সব সরঞ্জাম নিয়ে রাখালের মা তখন পিঠে বানাতে বসল। সেই পিঠে খেয়ে রাখালের এমনই তাক লেগে গেল যে, কী বলব!

কিন্তু প্রতিবেশীরা তো আর রোজ রোজ তাদের পিঠে বানানোর চালগুড় যোগান দেবে না। তাই রাখালের মা রাখালকে একটা পিঠে নিয়ে তাদের বাড়ির উঠোনে পুঁতে দিতে বলল।

অবাক কাণ্ড! দেখতে দেখতে সেই পিঠে থেকে পিঠে গাছ হল! আর সেই পিঠে গাছের ডালে ডালে ফলে আছে হরেক রকমের পিঠে!

এই দেখে রাখাল খুশিতে ডগমগ হয়ে রোজ পিঠে গাছে চড়ে পেট ভরে পিঠে খায় আর গান গায়, -- তাই রে নাই রে নাই রে না/তাই রে নাই রে নাই রে না/খাচ্ছি পিঠে, গাছে চড়ে/মনের সুখে পেটটি ভরে/তাই রে নাই রে নাই রে না/চিতোই পিঠে, সরুচাকলি/পাটিসাপটা, ক্ষীরের পুলি/তাই রে নাই রে নাই রে না/চাও যদি ভাই খেতে পিঠে/আর দেরি না, এস ছুটে/তাই রে নাই রে নাই রে না . . . . . . . ।

যে এসে রাখালের কাছে পিঠে চায়, সরল মনে তাকেই সে পিঠে দেয়।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে পিঠগাছে উঠে পিঠে খাচ্ছে, কাঁধে এক মস্ত ঝোলা নিয়ে এক বুড়ি এসে হাজির হল গাছতলায়। রাখালের কাছে সে পিঠে চাইল। আর রাখালও যথারীতি তাকে পিঠে দিল।

কিন্তু বুড়ি হায় হায় করে উঠে বলল, -- এটা তো কাশিতে পড়ল! নিই কী করে? 

রাখাল গাছের মগডালে বসেছিল। সেখান থেকে গাছের নীচে ভাল দেখা যায় না। বুড়ির কথা শুনে রাখাল তাই আরো একটা পিঠে পেড়ে বুড়িকে দিল।

বুড়ি কিন্তু সেটাও নিল না। বলল, -- এ হে, এটা থুতুতে পড়েছে। ও খোকা, আমি বুড়িমানুষ। ভালো দেখতে পাই নে। একটিবার গাছ থেকে নেমে এসে আমার হাতে দে না, ভালমানুষের বাছা।

আসলে বুড়ির মনে ছিল অন্য মতলব। রাখাল গাছ থেকে নেমে এলেই সে তাকে ঝোলায় পুরে নিয়ে চম্পট দেবে।

রাখাল ছেলেমানুষ, এসব কথা জানে না। সে তাই বুড়িকে পিঠে দিতে গাছ থেকে নেমে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি তাকে ঝোলাতে ভরে ঝোলার মুখ বন্ধ করে দিল। তারপর ঝোলা কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে পড়ল।

বুড়ি রাখালকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখে দিল। বুড়ির সঙ্গে থাকত বুড়ির ছেলে আর ছেলের বউ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে এনে বুড়ি তাদের মন্ত্র পড়ে হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া বানিয়ে দিত। তারপর তার ছেলে হাটে নিয়ে গিয়ে তাদের বিক্রি করে টাকা আনত ঘরে। সেই টাকা দিয়ে তাদের তিনজনের পেট চলত।

রাখালকে নিয়ে বুড়ি যখন বাড়ি এল, ছেলে তখন সেইসব পশুপাখি নিয়ে হাটে গিয়েছে। তার ফিরতে তখনও সাত-আট দেরি। বুড়ি তাই রাখালকে ঘরে আটকে রেখে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। 

বুড়ির ছেলের বউয়ের কাছে এই খবর জেনে রাখাল ভাবতে লাগল, কী করে এখান থেকে পালানো যায়। কিন্তু অনেক ভেবেও সেখান থেকে পালানোর কোনো পথ সে দেখতে পেল না।

দু দিন দু রাত সেখানে কাটানোর পরে রাখালের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বুড়ির ছেলের বউ রোজ নদীতে চান করতে যায়। সঙ্গে রাখালকেও নিয়ে যায়। সেই সময় নদী সাঁতরে পালানোর একটা সুযোগ আছে। কিন্তু বউটা সাঁতার জানে। যদি পালাতে গিয়ে তার হাতে সে ধরা পড়ে যায়!

তার চেয়ে শাশুড়ি বুড়ির সঙ্গে যদি নদীতে যাওয়া যেত কোনোভাবে, তাহলে তার পক্ষে পালানো অনেক সহজ হত। কারণ বুড়ি চোখে ভাল দেখে না।

এ কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আপনা থেকেই সুযোগটা এসে গেল তার সামনে। বুড়ির ছেলের বউ একদিন রাখালের কাছে তার সাদা ঝিকঝিকে দাঁতের রহস্য জানতে চাইলে রাখাল জানাল, উনুনে কোদাল পুড়িয়ে সেই গরম কোদাল দিয়ে সে রোজ দাঁত মাজে। তাই তার দাঁত এমন সাদা।

তার কথা শুনে বুড়ির ছেলের বউ যেই গরম কোদাল দিয়ে দাঁত মাজতে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই সে পুড়ে মারা গেল।

তারপর আর কী?

পরদিন বুড়ি রাখালকে নিয়ে নদীতে চান করতে গেলে রাখাল বুড়ির চোখে কম দেখার সুযোগ কাজে লাগাল। সাঁতার কাটতে কাটতে সে নদীর অন্য পারে চলে গেল। এই দেখে বুড়ি রাখালকে প্রাণপণে ডাকতে লাগল, -- ও রাখাল, যাস নে। কথা শোন। ফিরে আয়। মাণিক আমার, সোনা আমার!

পাড়ে উঠে রাখাল তার দু হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বুড়িকে কাঁচকলা দেখিয়ে বলে, -- দূর হ ডাইনি বুড়ি! এই নে, এবার কাঁচকলা খা!

এই বলে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে দৌড়ল। বাড়ি এসে দেখল, তার জন্য কেঁদে কেঁদে মা তার দু চোখ প্রায় অন্ধ করে ফেলেছে।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে মা তো আহ্লাদে একেবারে আটখানা হয়ে গেল! আর ডাইনি বুড়ির হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পেরে রাখালের আনন্দও যেন আর ধরে না! এক ছুটে সে গিয়ে পিঠে গাছে উঠে বসল। তারপর পিঠে খেতে খেতে মনের আনন্দে গান ধরল, --- তাই রে নাই রে নাই রে না . . . . . . . . . .

0 comments: