সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


   ট্রেকিং


  দীপক পাল



          বিকালের আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও এখন ঝির ঝির করে বৃষ্টি নামলো। সৌম্য আর বিশ্বরূপ পার্কের বাম দিকের কোনার বেঞ্চটিতে বসে সামনে পুজোয় কিভাবে সময় কাটাবে তাই নিয়ে আলোচনা করছিল। এইসময় বাবলা ছাতা মাথায় একজন ভদ্রলোককে নিয়ে হাজির। বললো, 'এই দেখ, সমরদাকে নিয়ে এসেছি। এই সেই সমরদা যার সাথে কাশ্মীরে গিয়ে জুসমার্গে এক ভাল্লুকের খপ্পরে পড়ে আমার জানটাই যেতে বসেছিল।

          সমরদা নামটা বহুবার বাবলাদার কাছে  শুনেছে ওরা। যিনি মাউনটেনিয়েরিং ইনস্টিউশনের সদস্য এবং বহু ট্রেক করেছেন। চশমার পিছন দিকে  উজ্জ্বল একজোড়া চোখ, প্রায় ছয় ফুটের এক সুন্দর কিন্তু শক্তপোক্ত চেহারা। সমরদা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ' নমস্কার, তোমাদের কথা আমি বাবলার কাছে বহুবার শুনেছি। বাবলা  খুব সাহসী কো অপারেটিভ ও কর্মঠ ছেলে। ওকে নিয়ে ট্রেক করা যায়। হ্যাঁ জুসমার্গে ভাল্লুকের একটা ব্যাপার হয়েছিল বটে। ওই ঘটনা নিশ্চয়ই বাবলার কাছে শুনেছ। যাকগে আমি তোমাদের সাথে আলাপ করতে এলাম।

কেমন আছো তোমরা। তোমাদের মধ্যে কে সৌম্য আর কেই বা বিশ্বরূপ?'

       সৌম্য আর বিশ্বরূপ হৈ হৈ করে নিজেদের পরিচয় দিল, আর বলল, সমরদা অনেক শুনেছি আপনার কথা বাবলাদার কাছে। আজকে আপনার কাছে ট্রেকিং এর গল্প শুনতে চাই। এই বৃষ্টিতে দারুন জমবে।

নিশ্চয়ই বলবো, আসলে দিদি অর্থাৎ বাবলার মা দুপুরে এমন ভুঁড়ি ভোজ খাইয়েছে যে জমিয়ে আড্ডা না মারলে পেটের কিছু হজম হবে না।'

          সবাই বেঞ্চে ঠেসা ঠেসি করে বসলো।

পার্কে ওরা ছাড়া দুটো কুকুর পাশের বেঞ্চের তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে নির্বিকার হয়ে।

'শোনো তাহলে,' সমর শুরু করলো, আমি আর আমার এক ট্রেকিং তুত বন্ধু সৌরভ যে আমাদের ইনস্টিটিউশনের সদস্যও, দুজনে মিলে কাশ্মীরে গিয়ে দাকসুম থেকে ট্রেক করে সিমথান পাস হয়ে কিথয়ার হয়ে জমবু যাচ্ছিলাম। প্রায় দুদিনের বেশি সময় লাগে। আপেল আর আখরোট খেতে খেতে ও গল্প করতে করতে মেন রাস্তা ছেড়ে কিছুটা নিচের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একসময় দেখি পায়ে চলা রাস্তাটা একদম সরু হয়ে একেবারে পাহাড়ের গায়ে মিশে গেছে। অনেক নিচে দিয়ে মোটা ফিতের মত একটা নদী বয়ে চলেছে। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ভাবছি এখন কি করবো। অনেক ওপর দিয়ে একটা মেষপালক যাচ্ছিল তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটাই আসল রাস্তা। কিন্তু আমরা আবার পিছন গিয়ে ঠিক ওখানে যদি যেতে চাই তবে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। মাথার ওপরে একটা ছোট গাছ ছিল, আমি একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে গাছের একটা ডাল ধরে ওপরে উঠে গেলাম। মেন রাস্তা ওখান থেকে একদম কাছে।

সৌরভের হাইট ৫'৫", তাই বোধহয় ও একটু ভাবছিল, একটু সময় নিচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে ওই  একটা গাছ ছিল ওখানে, নাহতো সারা বছর বরফ থাকার দরুন কোনো গাছ ওখানে বাঁচে না। যাই হোক সৌরভও একসময় ওপরে উঠে এলো। 

তারপর........' কথাটা সমরের মুখে আটকে গেলো কারণ কোথায় যেন একটা বাজ পড়লো আর তার সাথে একটা বাদলা হাওয়ার কাঁপুনি ধরালো যেন। ঠিক এই সময় আকাশের ঐ আলোতে সবাই দেখতে পেলো একটা লোক আপাদস্তক রেনকোটে  ঢাকা একটা মানুষ পার্কের ঘোরানো গেট পেরিয়ে পার্কে প্রবেশ করলো। তারপর একবার সামনে, ডানদিকে ও পরে বামদিকে তাকিয়ে এদিকে আসতে লাগলো। তার সারা গা বেয়ে জল ঝরছে। টলতে টলতে সে এসে আমাদের পিছনে দাঁড়ালো, তারপর মাঠের ওপর দিয়ে উঠে একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,  সমর এখানে আছিস তো?' সমর বলে উঠলো,  সৌরভ নাকি? কি কান্ড? এতো দারুন টেলিপ্যাথি। তুই কেনো এমন পুরো শরীর ঢেকে ঢুকে আছিস? চোখটা পর্যন্ত ঢাকা। তোকে চেনার কোনো উপায় নেই। গলার আওয়াজে বুঝলাম যে তুই। তা  তুই তো পিন্ন্ডারি গিয়েছিলি, সেখান থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরলি কি করে? তাও একেবারে এখানে। সেটাই বা সম্ভব হলো কি করে? হ্যাঁরে তুই সৌরভ তো?'

          সৌরভ নামে ভদ্রলোক এর কোনো জবাব দিল না। শুধু একটু থেমে থেমে বললো, ' তুই তো পিঠের ব্যথার জন্য আমার সাথে যেতে পারলি না, এদিকে আমি পিন্ডারি গ্লসিয়ার দেখে খাতি হয়ে সুন্দর দুঙ্গার পথ ধরলাম। সঙ্গে ছিল গাইড। পথে একটা রেলিংহীন সরু সাঁকো পেরোতে গিয়ে হঠাৎ স্লিপ করে নিচে একটা খরস্রোতা নদীতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি আমি নদীর এক পারে একটা বড় পাথরে আটকে আছি আর পায়ের কিছু অংশ জলের তলায়। চতুর্দিকে উঁচু উঁচু পাহাড় ঘেরা এক নির্জন পরিবেশ। শুধু একটা বহমান জলের শব্দ। বহু কষ্ট করে ওপরে রাস্তায় উঠে একটা দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারী ট্রাকে করে আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালাম। তারপর ট্রেনে করে হাওড়া। ইনস্টিটিউশন বন্ধ দেখে তোর বাড়ি গেলাম।

শুনলাম তুই এখানে এসেছিস। বাবলার কথা তোর কাছে শুনেছি আর সন্ধ্যে হলে ওরা এই পার্কে এসে বসে গল্প করে। ভাবলাম তুই নিশ্চয়ই এখানে আসবি। দেখলাম তুই আছিস। '

          সমর বললো, ' সবই তো বুঝলাম, কিন্তু তোর তো আরো অন্তত ৭/৮ দিন পরে ফেরার কথা  কিন্তু তুই এরই মধ্যে ঠিক এই জায়গায় আসলি কি করে?  যদি এসেও থাকিস তাহলে একেবারে আমার কাছে কেন?  ইনস্টিটিউশনএই বা যোগাযোগ করিস নি কেনো?

          এমন সময় হঠাৎ চারিদিক  কাঁপিয়ে গোটা আকাশটা ফালা ফালা করে কাছে কোথাও প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো। তার সাথে একটা  ঠান্ডা বাতাস আর একটা তীব্র আর্তনাদ শোনা গেলো। সকলের গা দিয়ে একটা শিরশিরানি বয়ে গেল যেন। সম্বিত ফিরতে সামনে কাউকেই দেখা গেলনা। শুধু সামনেই নয় পার্কের কোথাওই দেখা গেলনা।

          সমর কাঁপা গলায় বললো, ' বাবলা, আমাকে এখনই ফিরতে হবে। সৌরভ বোধহয় আর বেঁচে নেই। আমাকে এখনই একবার ইনস্টিটিউশনে গিয়ে সৌরভের খবর দিয়ে তার দেহটার খোঁজ করতে হবে। চলি, এবারে আর তোমাদের সাথে আড্ডা দেওয়া হলোনা। পরে কোনোদিন হবে নিশচয়ই।

বাবলা চল তাড়াতাড়ি।' ওরা উঠে পড়ল। সঙ্গে সৌম্য আর বিশ্বরূপ দুজনেই উঠে পড়ল। এরপর আর এখানে থাকার সাহস ওদের কারো নেই। তাড়াতাড়ি সবাই গেটের বাইরে বেরিয়ে যে যার বাড়ির দিকে দৌড় দিল। বৃষ্টি যেন আরো জোরে নামলো।

1 comments:

Amaresh Biswas said...

রোমাঞ্চ জাগানোর মত দুর্দান্ত গল্প। অপূর্ব লাগলো।