সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
বাঁধন
মিত্রা হাজরা
ঝন ঝন করে আওয়াজ হলো--- নীচের তলা থেকে। এই---এ-ই, শুনছো! কি, হলো--- কি! নীচে কিছু পড়ার আওয়াজ হলো---, সাথে চিৎকার, বেশ করেছি, আরো করবো, চুপ করে থাকবে তুমি। আমি চুপ করে থাকবো, আর তুমি পাড়া মাথায় করবে?
শুরু হলো--- বুড়ো বুড়ির কেত্তন! রাতের বেলায় ও শান্তি নেই, এবার দেখছি আমাদের ই বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে।
শোনো না--- চলো একবার নীচে গিয়ে দেখি, যাবে? ছাড়ো তো, শুয়ে পড়ো, বলে চাদর টেনে সমর পাশ ফিরে শোয়। অগত্যা মালা নীচের তলার ঝগড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে।
অরূপ রায় আর রমা রায়ের রায় ভিলাতে ওরা ভাড়া থাকে ওপরের তলায়। পরদিন সমর অফিস বের হয়ে গেলে মালা নীচের তলায় মাসিমার ঘরে এসে চক্ষুস্থির-----ঘরে প্রলয় ঘটে গেছে। আয়নার কাচ ভেঙে মেঝেতে পড়ে, ঘর দোরের অবস্থা--ওহ, জলের জাগ ওলটানো, বুড়ো বুড়ির চোখ রাতজাগা লাল। ওকে দেখে হাউমাউ করে ওঠেন রমাদেবী---দেখ কান্ড মালু মা,তোমার মেসোমশাই এর কান্ড! কি হলো আবার দুজনের! মেসোমশাই গজরাচ্ছেন --ও আমার পাটা যে পুড়ে গেল তার বেলা? এই বুড়োকে পুড়িয়ে মারলে বুড়ির সুবিধা হয়। কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না তাহলে-----।
হয়েছে টা কী! বলুন একে একে। তোমার মেসোমশাই এর পায়ে ব্যথা, তাই জল গরম করে হট ওয়াটার ব্যাগ এ সেঁক দিতে গেলাম,বলে বুড়ি আমায় পুড়িয়ে মারার তাল করছে।
আর উনি কি যুধিষ্ঠির? আয়নার কাঁচে জলের গ্লাস ছুঁড়ে কে মারলো জিজ্ঞাসা করো?
বেশ করেছি, কেন বললে--আমি মরলে আরো দুটো হাত গজাবে, তখন চার হাতে খাবে!
কি করা যায়--- এই বুড়ো, বুড়িকে নিয়ে---বলল বুলির মা আসেনি কেন এখনো, আমি ফোন করছি, আপনারা সাবধানে পা ফেলুন, কাচে পা কাটবে তো, সেদিনের মত থামলো সব। মালা চিনি ছাড়া চা করে দিয়ে গেল নিচেয়। বুলির মা এসে বলল--বৌদি, আমি এবার কাজ ছেড়ে দেব নিচের, নিত্য দিন ঝগড়া আর ভালো লাগেনা বাপু। আরে না--- না, ও কাজ কোরোনা, মাসিমার কষ্ট হবে। বুড়ো মানুষ, কত আর একা করবেন? সেই মায়ায় তো কাজ ছাড়ি না বৌদি, জেঠিমার দয়ার শরীর, খাবার , জামাকাপড় কম দেয় না আমায়, সুখে অসুখে টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করে। তবে ঐ ঝগড়া!
দেহ আর মনের মধ্যে ঠিক কোন জায়গায় ব্যথার বাস? ভাবতে থাকে মালা। আজ পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে-- তাদের কোনো সন্তান হয়নি এখনও। কত জন ডাক্তার, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছেন--- কোনো সমস্যা নেই।তবুও সন্তান হয়নি। মালার মা মেয়ের জন্য, তাবিজ কবচ সব গড়িয়ে পাঠিয়েছে, তবুও ভয় হয় মাঝে মাঝে, বুড়ো হলে ও আর সমর এভাবেই ঝগড়া করে দিন কাটাবে নাকি!
সেদিন ঝিঙেফুল বিকেল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল মালা।জানলা দিয়ে তাকালো বাইরের আকাশের দিকে, নীল হয়ে আছে-- বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে লালে লাল হয়ে আছে, বড় সুন্দর বিকেল। হঠাৎ মনে হলো--- আরে কি ব্যাপার, আজ নীচে থেকে কোনো আওয়াজ নেই কেন? চটিটা পায়ে গলিয়ে নীচে নেমে এলো সে----মাসিমা! কে! মালু-মা !ভিতরে এসো,এসে দেখলো মাসিমা বিছানায় শোয়া। আরে দেখোনা মা, তোমার মেসোমশাই আজ আমাকে উঠতে দেয়নি একদম, সকালে মাথা টা একটু ঘুরে গিয়েছিল। গায়ে হাত দিয়ে মালা বলল- আপনার তো জ্বর মাসিমা, আমাকে ডাকেন নি কেন? ডাক্তার লাগবে তো, কল দিই ডাক্তার বাবু কে? না মা, তোমার মেসোমশাই এর বন্ধু ই ডাক্তার, দেখে ওষুধ দিয়ে গেছেন।
এরপর ক দিন ধরে দেখলো দুটো মানুষকে মালা। নিজে ওপর থেকে রান্না করে পাঠিয়ে দেয়। মাসিমার জন্য সুপ বানায়-- একদিন বলল আমি খাইয়ে দিই, মাসিমাকে, মেসোমশাই বললেন---- ন মা, তুমি তো কত কি ই করছো, আমি খাইয়ে দেব। জ্বর উঠছে, নামছে, আর মেসোমশাই দিনরাত এক করে সেবা করে চলেছেন। সমর ডাক্তার ওষুধ ফলটল কিনে আনছে, আর জলপটি দেওয়া থেকে খাওয়ানো সব করছেন মেসোমশাই।
সেদিন সন্ধ্যায় মালা নীচে গিয়ে দেখে মাসিমা খাটে বসে আছেন, মেসোমশাই কথামৃত পড়ে শোনাচ্ছেন। ওকে দেখেই দু জনে হাসলেন, উজ্জ্বল চোখে মেসোমশাই বললেন---- আজ আর জ্বর নেই তোমার মাসিমার। মালা অবাক হয়ে এ কদিন ওনাদের দেখছে। এই যে ঝগড়া ঝাটি এ সব তাহলে কী!
সমুদ্র কে নীচে থেকে দেখেনা শঙ্খচিল ,সফেন জলরাশি পেরিয়ে সে উড়ান ভরে। সমুদ্রের ফোঁপানি রাতের নীরবতা ভাঙে, জল ছুঁয়ে ঝিনুকের মালা পরে শুধু ই বালিয়াড়ি। অকারণে ঝগড়া করেন দুজনে, একেই কি বলে ভালোবাসা, নির্ভরতা। ঐ ঝগড়া ঝাটি র মধ্যেই বাঁধন শক্ত হয়ে আছে, ভালোবাসার বাঁধন ।তাতেই স্বপ্নের মত কাটে দাম্পত্য জীবন।
3 comments:
গল্পটা পড়েই মন ভালো হয়ে গেল। খুব সুন্দর।
সব কিছু নিয়েই জীবন। মান অভিমান ঝগড়াঝাঁটি ভালবাসা সব কিছুই থাকে সেখানে।
ভালো লাগলো গল্পটি।
Post a Comment