সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
ঋজুর রহস্য ভেদ
মিঠুন মুখার্জী
বাবা-মার সঙ্গে আমার এই সতেরো বছরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় গেছি। কখনো সমুদ্রে, কখনো পাহাড়, আবার কখনো জঙ্গল দেখেছি। এক এক জনের এক এক রকম পছন্দ। কারো পাহাড়, কারোবা সমুদ্র, আবার কারো ঘন জঙ্গল। আমার কিন্তু ঘন জঙ্গল খুব পছন্দের। যখন ওঠে আমাজনের কথা কিংবা আফ্রিকার ঘন জঙ্গলের কথা, তখন আমার শরীরে একটা শিহরণ জাগে। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীদের দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আবার মাঝে মাঝে ভয় হয়। যদি কোনো বন্যপ্রাণীর খপ্পরে পড়ে যাই। তাহলে তো আর দেখতে হবে না। বাঘ, হরিণ, হাতি, বেবুন, সিংহ, ময়ূর, পাখি, সাপ, ভাল্লুক আরো কত রকমের প্রাণীদের বাস জঙ্গলে। বাঘের ডাক শুনলে আমার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। কত ঘুরেছি এই কয়েক বছরে। আমার বাবা নিজেই একজন ফরেস্ট অফিসার। বাবার জন্য জঙ্গলে অনেক গভীরে অনায়াসে চলে যেতাম। বাবার লাইসেন্সওয়ালা নিজস্ব একটা বন্দুক ছিল। নিজেকে রক্ষা করতে কখন কাজে লেগে যায়। বন্যপ্রাণীদের কোন বিশ্বাস নেই। যেকোনো সময় চরিত্র বদলে যেতে পারে।
আমার নাম মাস্টার রিতম সেন। বাড়ির ডাকনাম ঋজু। ছোটবেলা থেকে রোমাঞ্চকর কাহিনী, গল্প, উপন্যাস পড়তে খুব ভালো লাগে। 'চাঁদের পাহাড়' উপন্যাসটি আমার প্রিয় উপন্যাস। ফেলুদা-ব্যোমকেশ-টেনিদা-ঘনাদা আরও অনেক রকম গোয়েন্দা কাহিনীও এই বয়সে পড়ে ফেলেছি। জীবনে ওদের মতো একজন গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এখন আমি দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠেছি। ছোট-বড় রহস্যের উন্মোচন এরইমধ্যে করে স্কুলের টিচারদের খুব প্রিয় হয়ে গেছি। তারা আমাকে গোয়েন্দা ঋজু বলে ডাকেন।
কাজিরাঙা জঙ্গল-এর কথা কে না শুনেছে। আমার বাবা ওই জঙ্গলেরি ফরেস্ট অফিসার ছিলেন। বছর দুই হয়েছে ট্রানস্ফার হয়ে গেছে। বাবা ঐ জঙ্গলে থাকাকালীন আমি অনেকবার বাবার সঙ্গে গাড়িতে করে জঙ্গলের অনেক গভীরে গেছি। অনেক জন্তু জানোয়ার দেখেছি। খুব আনন্দে যেমন লাফিয়ে উঠলাম, তেমনি ভয়ও করত। একদিন বাবা আমাকে বিস্ময়ের সহিত বলেন--- "জানিস একমাস ধরে জঙ্গলের মধ্যে একটা রহস্য দানা বেঁধে রয়েছে! কিছুতেই সেটা সমাধান হচ্ছে না! তোকে তো সবাই গোয়েন্দা ঋজু বলে। দেখি তো এই রহস্যের উন্মোচন ঘটাতে পারিস কিনা। আমি বাবাকে বলি--- 'পুরো বিষয় আমাকে খোলসা করে বলো, নতুবা রহস্য ভেদ সম্ভব হবে না।' মাস্টার রিতম সেনের বাবা অশোক সেন তার ছেলের কাছে রহস্যের বিষয়টি তুলে ধরেন। বলেন --- "আজ থেকে এক মাস আগে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। এই পর্যন্ত চার থেকে পাঁচবার একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কী কারণে এটি হচ্ছে তা এখনও অজানা। আমার দীর্ঘ কুড়ি বছরের চাকরি জীবনে কোথাও এই ঘটনা ঘটেনি। এখানে দুবছর এসে পারিনি তার মধ্যে এরকম ঘটনা ঘটছে। প্রত্যেক সপ্তাহের শনিবার কিংবা রবিবার তিন-চারটি করে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী মরে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেন যে মারা যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!! এই পর্যন্ত মোট কুড়িটির মতো মৃত প্রাণী পাওয়া গেছে। তার মধ্যে হরিণ, মেছো বিড়াল, বাঁদর, গন্ডারও রয়েছে। কিন্তু কেন মরছে তার কোন কারন আমাদের কাছে নেই।
এরপর আমি বাবাকে বলি --- "এই রহস্য উন্মোচন করতে আমার বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আর আমার তোমার কাছে কতগুলো প্রশ্ন আছে, যেগুলির সঠিক উত্তর তুমি আমাকে দেবে। আচ্ছা বাবা এই জঙ্গলে মোট কতজন চাকরি করেন? যেখান থেকে মৃত প্রাণী গুলো পাওয়া গেছে সেখান থেকে তোমাদের অফিসে দূরত্ব কত? প্রত্যেক সপ্তাহের শনিবার কিংবা রবিবার এই মৃত প্রাণীগুলি কার এবং কখন নজরে এসেছে? আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বাবা একে একে দেন। তিনি বলেন--- ১)সব মিলিয়ে আমরা ছয়জন এই ফরেস্ট দেখাশোনা করি। আমরা দুজন ফরেস্ট অফিসার ও চারজন কনস্টেবল। বিকেল চারটের পর গভীর ফরেস্টে যাওয়ার কোন অনুমতি নেই। ২)যেখান থেকে মৃত প্রাণীগুলি পাওয়া গেছে সেখান থেকে অফিসের দূরত্ব এক থেকে দুই কিলোমিটার হবে। ৩) সব শনিবারেই যে প্রানীর মৃতদেহ গুলি পাওয়া গেছে তা নয়। কোন কোন সপ্তাহে রবিবারও পাওয়া গেছে। আর সব প্রাণীর মৃতদেহগুলি একই জায়গায় পাওয়া যায়নি। পাঁচশ মিটারের মধ্যে সমস্ত প্রাণীগুলো পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যেক সপ্তাহে যেদিন মৃত প্রাণী গুলি পাওয়া গিয়েছে তার বেশিরভাগ সময় সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। আর আমাদের ফরেস্টের গার্ড ও কনস্টেবল এই মৃত প্রাণী পাওয়া যাওয়ার খবরগুলি আমাকে দেন। বাবার কাছ থেকে সবকিছু শুনে আমি আমার তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাই।
অক্টোবর মাসের তৃতীয় শনিবার বাবার সঙ্গে সকাল সাতটার অনেক আগে ফরেস্ট অফিসে যাই। যে জায়গাগুলিতে প্রাণীগুলিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সেখানে বাবা ও দুজন কনস্টেবল নিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকি। মনে মনে স্থির করি আজ আসামিকে ধরবোই। সকাল আটটা পর্যন্ত আমরা গা-ঢাকা দিয়ে থাকি। কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনা। ভোরের আলো যখন সবে ফুটেছে , তখন আমরা জঙ্গলের ভিতরে গেছি। মনের সাহস নিয়ে যেমন এগচ্ছি, তেমনি মাঝে মাঝে বাঘের ডাকে শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। এরকম রোমাঞ্চকর পরিবেশে ভয়ও করছিল। আমরা ফিরে আসার সময় দেখি, ফরেস্ট অফিস থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে একটি মৃত হরিণ পড়ে আছে। দূর থেকে দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা রাস্তা ঘাসের উপর দিয়ে হেটে যাই। হরিণের কাছে গিয়ে দেখি হরিণটির মুখ থেকে ফেনা বেরচ্ছে। এরপর হাতে গ্লাভস পরে দু-চারটি ঘাস তুলে ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তারপর গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারি এটিতে এক ধরনের বিষ রয়েছে। যেটি অনেক আগে থেকেই ঘাসের উপর স্প্রে করা হয়েছিল। সেই ঘাস খেয়ে হরিণটি মারা গিয়েছে। অর্থাৎ আগেও যে প্রাণী গুলি মারা গিয়েছে সেগুলির মারা যাওয়ার কারণও এই বিষ।কিন্তু এভাবে প্রাণীগুলিকে মারার কারণ কি---মনে মনে প্রশ্ন জাগে আমার। আমার তদন্তের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ব্যাঘ্র সংরক্ষণ জায়গাগুলিতে যাওয়া একপ্রকার নিষিদ্ধ। তাই হয়তো এই জায়গাগুলিকেই বেছে নিয়েছেন অপরাধী। এরপর কিভাবে কি করতে হবে তা মনে মনে ঠিক করে ফেলি।
আমি বাবাকে আলাদাভাবে ডেকে বলি --- "এই কাজটা যেই করুক না কেন সে খুব চালাক। আমার মনে হচ্ছে খুব ভোরবেলা এই বিষ স্প্রেটা করা হচ্ছে, যাতে সূর্য উঠার আগেই সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন। আর যেহেতু শীতের সময় সেহেতু কেউ সন্দেহ করবে না। শিশিরের সঙ্গে বিষটি মিশে থাকবে। তাই পরের সপ্তাহে শনিবার ও রবিবার দুই দিনই ভোর পাঁচটার আগে আমাদের এখানে আসতে হবে। আর দেখতে হবে কারা এ কাজ করেন। এই কথাটা সকলের থেকে গোপন রাখতে হবে।" আমার কথামতো বাবা কথাটা সকলের থেকে গোপনে রাখে। কাকপক্ষীতেও টের পায় না।
পরের সপ্তাহের শনিবার ভোর পাঁচটার সময় আমরা ফরেস্টে আসি এবং গেটের বাইরে লুকিয়ে থেকে দেখার চেষ্টা করি ফরেস্টে ঢোকার গেট খুলে কারা ভিতরে ঢোকে। সকাল সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কারকে আমরা দেখতে পাই না। ওই দিন কোন প্রাণী মারা যায়নি। পরদিন অর্থাৎ রবিবার ভোর বেলা আমরা আবার ফরেস্টে ঢোকার গেটের কিছুটা দূরে লুকিয়ে থাকি। কিছুক্ষণ পরে আমরা দেখি ভোর পাঁচটা ত্রিশ নাগাদ দ্বিতীয় ফরেস্ট অফিসার নিশিকান্ত তিওয়ারি ফরেস্টে ঢোকার গেট খুলে ফরেস্টে প্রবেশ করেন এবং তার সঙ্গে ছিল তার শিফটের দুজন কনস্টেবল। বন্দুক নিয়ে একটি গাড়িতে করে তারা যেখানে বন্যপ্রাণীরা ঘাস খেতে আসে সেখানে যান। এই সবই আমরা পেছন থেকে লক্ষ করি। তারা যখন গাড়ি নিয়ে ফিরে আসেন, তখন তাদের গাড়িতে একটা ব্যারেল ও স্প্রে মেশিন দেখতে পাই। আমি ও বাবা বুঝে যাই এই এক মাস ধরে চলা এই ঘটনার মূল পান্ডা কে। এরপর বাবা বলেন --- "নিশিকান্ত বাবু একজন ফরেস্ট অফিসার হয়ে এই কাজ করতে পারলেন! কিন্তু কেন? ও তো আমার খুব ভালো বন্ধু। সকালের শিফটা ওর অসুবিধা হচ্ছে বলে আমি নিয়ে নিয়েছি। আর ও আমার সঙ্গে এমন করতে পারল !!" আমি বাবাকে বললাম--- "তোমার সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে কোন খারাপ রেকর্ড নেই। তাই উনি হিংসায় জ্বলে মনে হয় এ কাজ করেছেন। তোমার ডিউটির সময় ওই প্রাণীগুলি মারা যাচ্ছে মানে উপরওয়ালার কাছে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তোমার বদনাম হবে। এমনকি সাসপেন্ডও হতে পারো। আসলে বাবা বাঙালিদের সবাই হিংসা করে। কারণ, বাঙালি বুদ্ধির বলে সকলের থেকে এগিয়ে তো তাই।"
এরপর বাবা সোমবার সকাল আটটায় ফরেস্ট অফিসে আসেন। সেই দিন দুটি প্রাণী মারা যাওয়ার খবর পান তিনি। তিনি কোনো কথা না বলে একমনে নিজের কাজ করে যান। মজা দেখার জন্য মিস্টার নিশিকান্ত তিওয়ারি সেদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিসে এসে তার ঘরে চুপচাপ বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আর বাবার কানের কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে ওই প্রাণীগুলো মারা যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করছিলেন। বাবা অনেক ধৈর্য রাখার পর এক সময় হঠাৎ ফেটে পড়েন। তিনি নিশিকান্ত বাবুকে বলেন--- "আপনিই তাহলে সেই কালপিট যাকে আমি গত একমাস ধরে ধরার চেষ্টা করছিলাম, পারছিলাম না। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে প্রাণীগুলি মারা যাচ্ছে! 'ঘরের শত্রু বিভীষণ' যে আমার সঙ্গেই আছে তা আমি বুঝতে পারিনি।" সব শুনে নিশিকান্ত বাবু এমন ভাব করেন যে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়েছে। বাবাকে বলেন--- "আপনি আমার উপর দোষ চাপাচ্ছেন। আপনার ডিউটির সময় প্রানিগুলি মারা যাচ্ছে। কোথায় আমায় বিষয়টা ম্যানেজ করতে বলবেন। তা নয়। আপনি....। তাছাড়া আপনি যে আমাকে দোষারোপ করছেন আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে?" এই কথা শোনার পর বাবা রেগে আগুন হয়ে ওঠেন। নিশিকান্ত বাবুর শিফটের কনস্টেবল দুজন তখন সবে অফিসে এসেছেন। দুজন কনস্টবলকে বাবা ডাকেন। তারপর তিনি বলেন --- "আমি আপনাদের চাকরী খাব। আগে সব সত্য কথা বলুন।" দুজনে ভয় পেয়ে গরগর করে সব সত্য কথা বলে দেন। "নিশিকান্ত বাবু আমাদের চাকরি খাবার ভয় দেখিয়ে ও জোর করে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে এ কাজ করতে বাধ্য করেছেন স্যার। আমরা কেউই রাজি ছিলাম না। উনি চেয়েছিলেন আপনার গায়ে কালি ছিটাতে। উনি ভেবেছিলেন আপনার ডিউটির সময় বন্য প্রাণী মারা গেলে আপনার বদনাম হবে, এমনকি ট্রানস্ফার হতে পারে। তখন উনি আগের মতো একাই যত দুই নম্বরি কাজ সব চালাবেন।" বাবা জিজ্ঞাসা করেন দুনম্বরী মানে? আগে কি করতেন উনি? বাবার এই প্রশ্নের জবাবে একজন কনস্টেবল বলেন--- "আপনি জানেন না স্যার, আপনি আসার আগে অনেক স্যার এখানে এসেছেন। কিন্তু উনি নানান ভাবে তাদের ফাঁসিয়ে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছেন। কাঠ পাচারকারীদের সঙ্গে ও বন্য প্রাণীর চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিশিকান্ত স্যারের বড় হাত রয়েছে। তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা খেয়ে উনি লাল হয়ে গেছেন। এই ঘন জঙ্গলে কোথায় কি আছে তা উনার নখদর্পণে। উনি অনেক দিন যাবত এখানে আছেন, কিন্তু বন্যপ্রাণীদের জন্য খারাপ ছাড়া ভালো কাজ করেননি।
এরপর অন্য কনস্টেবল বলেন--- "আমরা যাতে কাউকে কিছু না বলি তাই ভয় দেখিয়ে আমাদের এতদিন ধরে দমিয়ে রেখেছেন উনি। রাতের অন্ধকারে গাড়ি গাড়ি দামি দামি কাঠ চালান করে দিয়েছেন উনি। আপনি আসায় ওই সব বন্ধ হয়ে গেছে। তাই উনি অন্যদের মতো আপনাকেও এখান থেকে তাড়ানোর জন্য এ কাজগুলো করেছে। আমরা একেবারে নির্দোষ। আমাদের ক্ষমা করে দিন স্যার।" বাবা কনস্টেবলদের বলেন, তোমরা যাও আমি দেখছি নিশিকান্ত বাবুর চাকরি কিভাবে থাকে। নিশিকান্ত তিওয়ারি ভয় পেয়ে বাবার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন-- "অশোকবাবু আপনি আমায় ক্ষমা করে দিন। আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিনও আমি খারাপ কাজ করব না।" কিন্তু বাবা তাকে ক্ষমা করেননি। তিনি মনে করেন পাপীকে ক্ষমা করে দিলে তার পাপের মাত্রাটা দিন দিন বেড়ে যাবে। তাছাড়া নিষ্পাপ পশুগুলোকে তিনি যেভাবে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছেন, তাতে তাকে ক্ষমা করে দিলে বড় ভুল হবে। তিনি চিঠি লিখে উপরের সাহেবদের সব জানান। নিশিকান্ত তিওয়ারিকে এই গুরুতর অপরাধের জন্য চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয় এবং ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। কনস্টেবল দুজনকে সেই যাত্রা আমার বাবা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন নিশিকান্ত বাবু জোর করেছিলেন বলেই এ কাজ করতে তারা বাধ্য হয়েছেন। তাদেরকে তিনি শেষবারের মতো ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেন।
সেই দিন বাবা কোয়ার্টারে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন--- " তোর জন্যই আসল অপরাধীকে ধরতে পারলাম। তুই এত অল্প বয়সে কিভাবে পারিস! তোর উপর আমার আশীর্বাদ রইল। তুই একদিন বড় গোয়েন্দা হবি। তোকে নিয়ে আমরা গর্ব করব। তোর জন্য আমার চাকরিটা যেতে যেতে থেকে গেল।"বাবার কথাগুলি শুনে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। আমি যে আমার লক্ষ্যের দিকেই এগোচ্ছি তা বুঝতে পেরেছিলাম।
এই ঘটনার মাস ছয়েক পর আরেকটি রহস্যের উন্মোচন ঘটাতে হয়েছিল আমায়। সেটি আমার স্কুলে। আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের প্রধান শিক্ষক মহাশয় একদিন আমাকে ডেকে বললেন-- গোয়েন্দা রিজু, তোমাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। তুমি এর আগে স্কুলের অনেক ছোট ছোট রহস্যের উন্মোচন ঘটিয়ে তোমার মেধা ও গোয়েন্দাগিরির পরিচয় দিয়েছো। শুনেছি তোমার বুদ্ধির বলে তোমার বাবার চাকরি যেতে যেতেও থেকে গেছে। এবার আমাদের একটা রহস্যের উন্মোচন ঘটিয়ে আমাদের বাঁচাও তো দেখি। গত দুমাস ধরে স্কুলের অনেক কিছু বিভিন্ন সময় চুরি যাচ্ছে। তুমিও এই দুমাস স্কুলে আসোনি। বাবার সাথে বাইরে ছিলে। কিন্তু চোরকে কোনোমতে ধরা যাচ্ছে না। এই সাইকেল, ঘড়ি, মানিব্যাগ, বাচ্চাদের খাবার আরো অনেক ছোট বড় জিনিস চুরি যাচ্ছে। এত ধরার চেষ্টা করেছি, তবুও চোর আমাদের ফাঁদে ধরা দেয় না। তুমি যদি চোরকে ধরে দিতে পারো তাহলে স্কুলের পক্ষ থেকে তোমায় পুরস্কৃত করা হবে। প্রধান শিক্ষকের কথা শেষ হলে ঋজু বলে--- স্যার আমার আপনার সঙ্গে কতগুলি গোপন কথা ছিল, যা অন্য কারো সামনে আমি জিজ্ঞাসা করতে পারবোনা। প্রধান শিক্ষক তার ঘরে থাকা দুজন শিক্ষক ও সনাতন দাকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে যেতে বললেন। এরপর আমি স্যারকে বললাম--- ১)আপনার কার কার উপর সন্দেহ? ২)এই চুরিগুলি কোন সময় হচ্ছে? সময়টা বললে আমার তদন্ত করতে সুবিধা হবে। ৩) বাইরে থেকে আমাদের স্কুলে কাদের আনাগোনা আছে? ৪)স্কুল কটার সময় পুরোপুরি সনাতনদা বন্ধ করেন? ৫) স্কুলের চাবি কার কার কাছে থাকে? প্রধান শিক্ষক এরপর এক এক করে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন--- ১) আমার সন্দেহ অনেকের উপরেই হয়। যেমন-- সনাতন, জল দেয় যে ছেলেটি, স্টুডেন্টদের মধ্যেও কেউ কেউ থাকতে পারে, স্যারদের মধ্যেও দু-একজনকে হয়। ২) সব গুলি যে একই সময় হয়েছে তা নয়। যেমন-- সাইকেল সপ্তাহে একদিন চুরি হচ্ছে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। কোন সপ্তাহে শনিবার, কখনো সোমবার। তবে দুদিনেই টিফিনের পর এই সাইকেল হারানোর খবরটা এসেছে। স্যার ম্যাডামদের মানিব্যাগ অনেকবার এই দু'মাসের মধ্যে চুরি গেছে। দুপুরের দিকে বাচ্চাদের খাবার টিফিনের আগেই চুরি হয়ে যাচ্ছে। স্কুলের তিনটি ঘড়ির মধ্যে দুটি বিভিন্ন সময়ে চুরি হয়ে গেছে। ৩) বাইরে থেকে আসার মধ্যে জল দেয় যে ছেলেটি, খবরের কাগজ দেয় আর মিড ডে মিলের খাবার পৌঁছে দিয়ে যায় সেই দু'জন। তবে এদের কারো নাম আমার জানা নেই। ৪) স্কুল চারটে তিরিশে ছুটি হওয়ার পর পাঁচটার মধ্যে সনাতন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। ৫) চাবি তিন গাছি। সনাতন, বাংলার শিক্ষক কাশি ভট্টাচার্য ও আমার কাছে থাকে।
এরপর আমি প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে বলি--- "স্যার সব দিকে নজর রাখার জন্য আমার পাঁচজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন। আপনার মত থাকলে আমার পাঁচজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে নিতে পারি কি?" স্যার বলেন--- "অবশ্যই নেবে। তবে তারা যেন স্কুলের হয়, নতুবা অন্যেরা আপত্তি করতে পারেন।" এরপর আমি রজত, রবিন, রনজিত, রঞ্জন ও রাজকুমারকে আমার এই কাজে নিই। তাদের বলি--- "আমার একটা তদন্তের কাজে তোদের সহযোগিতা করতে হবে। করবি তো?" সকলেই হ্যাঁ বলে। প্রথমে আমরা ছয় জন বিভিন্ন ব্যক্তি ও জায়গায় এক সপ্তাহ নজর রাখি। জল দিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে নজর রাখে রজত, খবরের কাগজ দেওয়া ছেলেটির উপর রবিন, মিড ডে মিলের খাবার দিয়ে যাওয়া ছেলে দুটির উপর রনজিত, সনাতন দা ও বাংলা শিক্ষকের উপর আমি নিজে, গ্যারেজে নজর রাখতে রঞ্জনকে বলি এবং স্কুলের ঘড়ি ও আসবাবপত্রের উপর রাজকুমারকে নজর রাখতে বলি। তাদেরকে বলে দিই কোন কিছু দেখলেই আমাকে সত্বর বলতে। তারা যেন কোনো কথা না বলে। প্রথম সপ্তাহে কিছু ধরা পড়ে না। দ্বিতীয় সপ্তাহে নজরদারি বাড়িয়ে দিই। দ্বিতীয় সপ্তাহের সোমবার প্রথম গেট খোলে সনাতনদা। আমি দশটার আগে স্কুলে আসি। আড়ালে থেকে উনার গতিবিধির উপর নজর রাখি। দেখি স্যারদের ঘর পরিস্কার করতে করতে হঠাৎ একটি দেয়াল ঘড়ি সনাতন দার আনা একটা বড় ব্যাগের মধ্যে নিয়ে নেয়। তখনও স্কুলে কেউ আসেনি। প্রধান শিক্ষক আসলে তাকে গিয়ে বলেন --- "স্যার, দোতলার ঘড়িটা চুরি হয়ে গেছে। কে যে নিচ্ছে!" আমার খুব হাসি পায় কথাটা শুনে। তবে আমি তখনই কিছু বলিনা। মঙ্গলবার টিফিন বেলায় দেখি বাংলার শিক্ষক ইংরেজি শিক্ষিকার সাইড ব্যাগের চেইন খুলে টাকার ব্যাগটা চটজলদি তুলে নেন। ঘরে সে সময় কেউ ছিলনা। আমি বাইরে থেকে লক্ষ করি। ঐদিন রনজিত মিড ডে মিলের খাবার দিয়ে একজন ছেলেকে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে সাইকেল গ্যারেজ থেকে একটি নতুন সাইকেল উঁচু করে পাঁচিলের বাইরে ফেলে দিতে দেখে। আর অন্যজন তালার লক কাটার দিয়ে লক কেটে সাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। সে এসে এই খবরটা আমাকে দেয়। আমি সব চেপে থাকি। বুধবার আমি সারা স্কুলটা ভালো করে নজর রাখি। দ্বিতীয় পিরিয়ডের পর সপ্তম শ্রেণীর একটি ছেলে বাথরুমে গেলে তার পাশের একটা বন্ধু তার টিফিন খুলে বেঞ্চের তলায় লুকিয়ে খেয়ে খালি টিফিন বক্সটা ব্যাগে রেখে দেয়। বৃহস্পতিবার আবার রঞ্জন দেখে দশম শ্রেণীর রিপন ও দীপন নামক দুজন ছাত্র ক্লাস চলাকালীন বাথরুমে এসে দুটি সাইকেলের বেল ও ছোট সাইকেলের সিট কভার খুলে নিয়ে পকেটে ভরে। ও এসে আমাকে সব জানায়। সবকিছু আমার কাছে জলের মত পরিস্কার হয়ে যায়। আমি শুক্রবার প্রধান শিক্ষককে গিয়ে সব বিষয়টি খুলে বলি। তিনি সব শুনে বলেন--- "তাহলে আমি কাল দ্বিতীয় পিরিয়ডের পর একটা মিটিং ডাকছি। আজই নোটিশ পাঠিয়ে দিচ্ছি। যাদের নাম তুমি বললে প্রত্যেককে মিটিংয়ে থাকতে বলব। তুমি ও তোমার পাঁচজন বন্ধুও থাকবে। তারপর সামনাসামনি সব মোকাবিলা হবে। দোষীদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে।" আমি স্যারের কথা শুনে স্যারের ঘর থেকে চলে আসি এবং আমার পাঁচ বন্ধুকেও কালকের মিটিংয়ে থাকতে বলি।
পরদিন দুই পিরিয়ডের পর দশ নম্বর হলঘরে মিটিং শুরু হয়। সনাতনদা, বাংলার স্যার, মিড ডে মিলের দুজন ছেলে, সাইকেলের পার্টস চুরি করা ছাত্র দুটি, জল দেওয়ার ছেলেটি, খবরের কাগজ দেওয়া ছেলেটি, আমরা ছয় জন, প্রধান শিক্ষক মহাশয়, অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কর্মীগণ মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। আমরা ও প্রধান শিক্ষক মহাশয় ছাড়া কেউই বুঝে উঠতে পারছিল না কিসের জন্য এই মিটিং। এরপর প্রধান শিক্ষক রাকেশ মুখোপাধ্যায় বলেন, গত দু'মাসের সমস্যা আজ এই মিটিংয়ে সমাধান হবে। যারা যারা স্কুল থেকে চুরি করেন তারা চিহ্নিত হবেন এই মিটিংয়ে। এই কথা শোনার পর যারা চুরি করেন তাদের মুখ একেবারে ছোট হয়ে যায়। চোখে-মুখে টেনশন লক্ষ করা যায়। এরপর নাম ধরে ধরে প্রধান শিক্ষক মহাশয় কে কি চুরি করেছেন সব বলে দেন। অন্যান্যরা অবাক হয়ে যান। লজ্জায় চোরদের মাথা হেট হয়ে যায়। সনাতন দা ও বাংলা স্যারের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে। প্রত্যেকে প্রধান শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চান। তাদের ভুল স্বীকার করেন। এ পর্যন্ত যা যা চুরি গেছে এবং যে যা নিয়েছেন প্রত্যেককে এক সপ্তাহের মধ্যে তা ফিরিয়ে দিতে বলেন তিনি। নতুবা তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে তিনি বাধ্য হবেন। আর যদি না এনে দিতে পারেন তবে আর্থিক মূল্য ধরে দিতে হবে। বিপদে পড়ে সকল চোরেরা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর আমায় ডেকে তিনি সবার সামনে বলেন--- "এই অসম্ভব কাজ সম্ভব করেছে আমাদেরই দশম শ্রেণীর ছাত্র মাস্টার রিতম সেন। আমরা তাকে গোয়েন্দা ঋজু বলে ডাকি। এত অল্প বয়সে তার এত নিখুঁত বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। আমি আশীর্বাদ করছি ও বড় হয়ে একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান গোয়েন্দা হবে। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম যদি ও এই রহস্যের সমাধান করতে পারে, তাহলে ওকে আমি স্কুল থেকে পুরস্কৃত করবো। সেই কথামতো আগামী সোমবার ওকে আমরা পুরস্কৃত করবো। সোমবার প্রধান শিক্ষক মহাশয় ও অন্যান্যরা মিলে ফেলুদা সমগ্র ও একটি বাইনোকুলার দিয়ে আমায় পুরস্কৃত করেছিলেন। আমায় গোয়েন্দা হয়ে ওঠার পথে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন।
0 comments:
Post a Comment