সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
নস্যি বিভ্রাট
তানিয়া ভট্টাচার্য
১
“যেদিন থেকে আমি নস্যি নিয়েছি, সেদিন থেকে ক্লাসে প্রথম হয়েছি ।” রমণীস্যার তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মাঝখানে একটিপ নস্যি নিয়ে বেশ দর্প সহযোগে কথাটি বললেন । তারপর দুই নাকের ছিদ্রে বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে তা গুঁজে দিয়ে খান দুই পেল্লায় হাঁচি দিলেন । হাতটা কাঁচিপাড় ধুতিতে মুছে পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে নাক মুছলেন । এ দৃশ্য ভাদু আর টুসুর খুব চেনা । রোজই পড়তে বসে দেখে। চোখের চশমাটা হাঁচির তাড়সে নাকের ডগায় ঝুলে পড়েছে রমণীস্যারের। তিনি চশমাটা খুলে পাঞ্জাবি দিয়ে মুছে আবার পরলেন । বললেন, “বুঝলে তোমরা ? প্রথম হওয়াটা এমন কিছু অসম্ভব কাজ নয় । কারোর খেলাধুলো করলে মাথা খোলে, আমার নস্যিতে খুলেছিল ।”
ভাদু, টুসু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ।
রমণীস্যার যদিও তাঁর নস্য গ্রহণের তথ্যকে নস্যাৎ করে প্রথম হওয়ার তথ্যটিকেই প্রতিপাদ্য করেছিলেন, কিন্তু বোঝানোর রকমফেরে খুদে ছাত্রছাত্রী দুটি বুঝে ফেলল অন্যকিছু ।
ভাদু চোখ পিটপিট করে বলল, “স্যার নস্যি নিতে আপনার ভয় করেনি ?”
ভাদু ক্লাস সিক্সের বেজায় ফিচেল ছেলে । স্কুলের মাস্টাররা তার প্রশ্নবাণে সর্বদা জর্জরিত । তার সব প্রশ্ন সবসময় ফেলে দেওয়ার মত হয়ও না । কিন্তু বেখাপ্পা প্রশ্ন, সিলেবাসের বাইরে গিয়ে প্রশ্ন, এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে প্রশ্ন তার মাথায় একটু বেশীই খেলে । তাই নস্যি নিতে রমণীস্যার ভয় পেতেন কিনা এমন প্রশ্ন তার পক্ষে করা খুবই সম্ভব ।
রমণীস্যার ভাদুর আপাত মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে গলায় অল্প স্নেহ টেনে এনে বললেন, “দূর ক্ষ্যাপা ! ভয় পাব কেন ? আমার বাপ, তার বাপ, তার বাপ, গুষ্টিসুদ্ধ সক্কলে ঢালাও নস্যি নিতেন । এ তো খুব সোজা ব্যাপার । ভগ্নাংশ, আসন্নমানের চেয়ে ঢের সোজা ।”
-“সত্যি ?” টুসুর চোখ জুলজুল করে উঠল । সহজ সরল মেয়েটি সবকিছুতেই বিশ্বাস মাখিয়ে প্রশ্ন করে । বয়সে ভাদুর চেয়ে এক বছরের বড় হলে কি হবে, উল্টে ভাদুই টুসুকে শাসনে রাখে । বেলের মোরব্বা বড়মার বয়াম থেকে টুসু চুরি করলেও কোনদিন বড় টুকরোটা পায়নি । বরাবর ভাদু বড় টুকরোটা নিয়ে ছোটটা তাকে দিয়েছে । তখনও বিশ্বাস মাখিয়ে ও প্রশ্ন করেছে, “আমাকে বড়টা দিবি না ?” উল্টে ভাদু বলেছে, “কাল তুই তিনবার হেঁচেছিলি না টুসু ? আমি পষ্ট শুনেছিলাম । জানিস সর্দি লাগলে বেলের মোরব্বা খেতে নেই । তাও তো তোকে এক টুকরো দিলাম । এখন এটাই খা । পরেরবার বড়টা নিস ।” বলাই বাহুল্য সেই পরেরবার কোন বারই আসেনি ।
টুসুর সেই সরল সোজা প্রশ্নের মুখে পড়ে রমণীস্যার বললেন, “সত্যি নয় তো কি ! আমিই কি ছাই পড়া পারতুম না কি ! বাবা যে তাঁর সাড়ে তেরোটা ছড়ি আমার পিঠে ভেঙেছিলেন সে কি এমনি এমনি ?”
-“সাড়ে তেরোটা ছড়ি ? সে কিরকম ব্যাপার ?” ভাদু কৌতূহলী হল ।
-“চোদ্দ নম্বর ছড়িটার কোণা ভেঙেছিলেন প্রথমে । পুরো ছড়িটাই প্রায় আস্ত ছিল । সেটাকেই অর্ধেক ধরেছি ।”
-“কিন্তু স্যার, ওই ছড়িটাকে ঠিক অর্ধেক ধরা তো উচিৎ হয়নি ।” ভাদু ফোড়ন কাটল । “সম্পূর্ণ ছড়িটার মাপ পেলে, আর ভাঙা টুকরোটার মাপ জানলে একটা আসন্নমান হিসেব করতে পারতুম । যাক গে, তারপর কি হল ?”
রমণীস্যার কটমটিয়ে তাকালেন ভাদুর দিকে । “গতবারের মাসিক পরীক্ষায় একটাও আসন্নমানের অঙ্ক তোর মেলেনি, না ভাদু ?” বেশ জোর দিয়ে বললেন তিনি ।
ভাদু ফিচেল হেসে মাথা নিচু করল ।
-“আপনার খুব লেগেছিল, তাই না স্যার ?” টুসু বলল ।
টুসুর মনে ভীষণ মায়া । ভাদু ছাড়া সে কক্ষনো কাউকে মারে না । কিছুদিন আগেই রাঙাকাকিমা হাত ভর্তি কাচের চুড়ি কিনে দিয়েছিলেন ওকে । লাল, কালো, সাদা, সবুজ মেশানো দু’ডজন বাহারি রেশমি চুড়ি । একডজন হাতে পরে আরেকডজন মায়ের আলতা সিঁদুরের বাক্সে তুলে রেখেছিল টুসু । ভাদু কোন ফাঁকে ওই একডজন চুড়ি শান বাঁধানো মেঝেতে সাজিয়ে পাথর মেরে মেরে টিপ প্র্যাকটিস করছিল কেউ খেয়াল করেনি । টুসু দেখতে পেয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় । কিন্তু ততক্ষণে তার আধা ডজনেরও বেশী চুড়ি ভেঙে গেছে । ছুটে এসে ভাদুর মাথার চুল ধরে ঝাঁকিয়ে দেয় ও । ভাদুও পাল্টা আক্রমণ চালায় । টুসুর কাচের চুড়ি পরা হাত সজোরে চেপে ধরে । হাতের চাপে পলকা কাচের চুড়ি ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে যায় । একটুকরো ভাঙা কাচ দিয়ে টুসুর হাত ফালাফালাও হয়ে যায় । খুব কেঁদেছিল টুসু । মায়ের হাতে যদিও ভাদু এরপর বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়েছিল, কিন্তু তাতে তো আর টুসুর ব্যথা কমেনি, কাচের চুড়িও জোড়া লাগেনি ।
ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থানের ওপর হাত বোলাল ও । রমণীস্যার টুসুর দিকে তাকালেন । ওর বড় বড় সরোবরের মত আয়ত চোখের কোণ ঘেঁষে একটা বড়সড় জলের ফোঁটা যেই না ভেসে উঠেছে অমনি রমণীস্যার বলে উঠলেন, “ব্যথা কেন লাগবে না মামনি, খুব লেগেছিল, বেজায় লেগেছিল । কিন্তু এখন আর ব্যথা নেই ।”
-“তারপর কি হল ?” ভাদু অধৈর্য হয়ে উঠল ।
-“তারপর একদিন কি জানি কেন, খুব নস্যি নেবার শখ হল । ঠাকুর্দার নস্যির ডিবে থেকে একচিমটি নস্যি নিয়ে দিলাম টান । কায়দা দেখাই ছিল । বাবা, ঠাকুর্দাকে রোজ দেখতাম নস্যি নিতে ।” রমণীস্যার বললেন ।
-“তারপর ?” ভাদু জিজ্ঞাসা করল ।
-“তারপর আর কি ! মাথাটা এক ঝটকায় যেন সাদা হয়ে গেল । অ্যাক্টিভ ভয়েস, প্যাসিভ ভয়েস, সন্ধি, সমাস, জীবনানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, আসন্নমান, সিঁড়িভাঙ্গা, কম্প্রিহেনশান, ধাতুরূপ, শব্দরূপ সব জলবৎ তরলং হয়ে গেল । চাইকি একদিনে আস্ত ইলিয়াডও পড়ে ফেললাম ।”
-“তারপর ? তারপর ?” ভাদু, টুসু একসঙ্গে ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠল । ভাদুর আসন্নমান কিছুতেই আয়ত্ত হয়না । আগের পরীক্ষার মত আসন্ন পরীক্ষায়ও আসন্নমানকে নিয়ে ও ভয়ে ভয়ে আছে । টুসুর অ্যাক্টিভ ভয়েস, প্যাসিভ ভয়েসের প্রশ্নে সব গোলমাল হয়ে যায় । ওদের চোখের সামনে সাফল্যের চাবিকাঠিটা যেন রমণীস্যার দুলিয়ে দিলেন ।
-“তারপর আর কিছুই না । তারপর থেকে প্রতিবারই ক্লাসে প্রথম হতে লাগলাম।” রমণীস্যার বললেন । একটু থেমে আবার বললেন, “মোদ্দা কথা হল ক্লাসে প্রথম হওয়াটা কোন বড় ব্যাপারই নয় । প্রতি বছর কেউ না কেউ হচ্ছে ।যে কেউ যখন তখন হয়ে যেতে পারে । তোমরা চেষ্টা কর । তোমরাও পারবে।”
ভাদু ফিসফিসিয়ে বলল, “টুসু, তুই বড়, তুই চেষ্টা কর । তুই যদি পারিস, তবে আমি চেষ্টা করব ।” টুসু চোখ মটকিয়ে ভাদুকে চুপ করতে বলল ।
পড়াশুনো আর কয়েক কদম এগোতে না এগোতেই রাঙাকাকু ঘরে এলেন । নাহারকাটিয়ার সক্কলে একবাক্যে বাঙালি ডাক্তারবাবুকে চেনে । অবশ্য আসামের এই আধা শহর আধা গ্রামটিতে ভালো ডাক্তার ক’জনই বা আছে ডাক্তার নীহাররঞ্জন বটব্যালের যেমন প্রতাপ তেমনি দরাজ দিল । অত্যন্ত সুদক্ষ ডাক্তার বলে সব মহলেই তার বেজায় খাতির । রাঙাকাকু ঘরে ঢুকেই গুরুগম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “ভাদু টুসুর লেখাপড়া কেমন চলছে মাস্টারমশাই ?”
রোগাভোগা রমণীস্যার বরাবরই রাঙাকাকুর সামনে থতমত খেয়ে ফেলেন । আজও ঢোঁক গিললেন । তারপর নাকের ডগাটা একবার চুলকে নিয়ে বললেন, “ভালোই তো । ভালোই পড়ছে ।”
-“হুঃ”, মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে রাঙাকাকু বললেন, “ভালোই যদি পড়ছে তবে নম্বর বাড়ছে না কেন ? দেখুন মাস্টারমশাই, আমার দাদা, মানে ভাদু টুসুর বাবা আমার হাতে ওদের রেখে বর্ডারে গেছেন ডাক্তারি করতে। তাই বুঝতেই পারছেন আমার কতটা দায়িত্ব । আজ যদি ওরা লেখাপড়া ভালো করে না করে তাহলে দাদা ফিরলে দাদাকে কি জবাব দেব ?”
-“চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু । ওরা এবার ভালো ফল করবেই ।” মাথাটা একটু ডানদিকে হেলিয়ে রমণীস্যার বললেন ।
-“তা ভালো । পড়ান, পড়ান । মন দিয়ে পড়ান ।” রাঙাকাকু বললেন ।
রমণীস্যারকে কথা বলতে ব্যস্ত দেখে ভাদু টুসুর দিকে চোখ টিপে ইশারা করল। টুসু এই ইশারা বিলক্ষণ বোঝে । ভাদুর মাথায় যখন কোন দুষ্টু বুদ্ধি খেলে তখন চোখ টিপে আগে টুসুকে সাবধান করে যেন আগ বাড়িয়ে ও কিছু না বলে । মাথা নেড়ে ও সায় দিল । ভাদু অঙ্ককষার খাতাটাকে সুযোগ বুঝে টেবিলের ওপর রাখা রমণীস্যারের নস্যির ডিবের ওপর ফেলল । তারপর আস্তে আস্তে খাতাটাকে টুসুর দিকে টেনে এনে টুক করে টুসুর কোঁচড়ে ডিবেটাকে
ফেলল । টুসু যেন ওঁত পেতেই ছিল । চিলের মত ছোঁ মেরে চক্ষের পলক ফেলার আগেই ফ্রকের পকেটে চালান করে দিল ও । তারপর ভালো মুখে সারা সন্ধ্যে “হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন” পড়ে কাটিয়ে দিল ।
রাতে ভাদু টুসু দুজনেরই ঘুম এল না । রোজ যেখানে সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ঢুলতে থাকে, আজ রাত বারোটা অবধি জেগে জেগে সকলের ঘুমনোর অপেক্ষা করতে লাগল । আর মাত্র কয়েকটা মিনিট । তারপর কাল থেকে ওরা দুজনেই নিজের নিজের ক্লাসের ফার্স্ট বয়, ফার্স্ট গার্ল হয়ে যাবে এই চিন্তায় বেজায় উত্তেজিত হয়ে পড়ল । বড়মা ঘুমোলে দুজনে দুপাশ থেকে নেমে চুপিচুপি বারান্দায় এল । ইংরাজি ‘এল’ আকৃতির বারান্দার একপ্রান্তে রান্নাঘর । নিঃশব্দে শিকল খুলে ওরা রান্না ঘরে এসে আলো জ্বাললো, তারপর দরজা ভেজিয়ে দিল। পকেট থেকে টুসু রুপোলী রঙের নস্যির ডিবেটা বের করে আলোতে ধরল । ডিবে তো নয়, যেন ভাদু টুসুর ভাগ্য ঝকমকিয়ে উঠল । নস্যি নিতে আর কোন বাধা নেই । কায়দা তো দেখাই আছে । রোজ রমণীস্যারকে দেখে ওরা ।
২
সারা দিনমানে এককড়ার দাঁও জোটেনি হারানের । আজ হাটবারেও যদি দাঁও না জোটে তাহলে যে তার বাপ-পিতেমোর ব্যবসাতে লালবাতি জ্বলবে আর ক’দিনের মধ্যেই তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে ! হারান ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল । সে চোর হতে পারে, তবে জাত চোর । শিল্পীও বলা যায় । বাতাসের মত লোকের পাশ দিয়ে যখন বয়ে যায় পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগ যেমনকে তেমন থাকে, শুধু টাকাগুলো গায়েব হয়ে যায় । মহিলাদের গলার চেন এমন নিঃশব্দে খুলে নিতে পারে যে একবেলা মহিলারা বুঝতেই পারে না তাদের গলা খালি । কানের ঝুমকো এমন নিঃসাড়ে ঝেঁপে দেয় যে মেয়েরা মনে করে ‘আজ বোধহয় দুল পরিইনি’ । এ হেন হারানেরও আজকাল দাঁও জুটছে না । জুটবে কি করে ? যুগের কেতা যে বন-জঙ্গলকেও ছাড়ছে না । পোড়ামুখোরা আজকাল যে কেউ টাকা পয়সা নিয়ে বেরই হয় না । ব্যাঙ্ক থেকে কতগুলো ছাইপাঁশ ডেবিট কার্ড না ক্রেডিট কার্ড বের করেছে, ওই দিয়েই বাজার হচ্ছে, দোকান হচ্ছে । আর যেখানে অনামুখো কার্ড চলে না সেখানে মোবাইল ফোন দিয়ে টাকা পাঠাচ্ছে । মোবাইল সটকালেও চলত । কিন্তু মোবাইল তো কেউ পকেটেই রাখেনা । প্রাণ ভোমরার মত হাতে চেপে রাখে । হাতের মুঠোর ভেতর থেকে কিভাবে জিনিস গায়েব করতে হয় ঠাকুর্দা জানত বটে । কিন্তু হারান কোনদিনই শিখে উঠতে পারেনি । শিখবে কি করে? হারানের খুব ছোটবেলায়ই তো ঠাকুর্দা দেহ রাখল । তার বাপ খুব একটা উজ্জ্বল চোর ছিল না । মাঝেমাঝেই ধরা পড়ে যেত । কপালে হাটুরে মারও জুটত । গায়ে ব্যথা নিয়ে কয়েকদিন ব্যবসায় বেরত না, বাড়িতেই থাকত । তখন হারানকে তার বাপের গল্প শোনাত । ছোট্ট হারান চোখের পলক না ফেলে সেসব গল্প শুনত আর ভাবত কবে ঠাকুর্দার মত এলেমদার চোর হবে । ছোট থেকেই অনেক দাঁওপ্যাঁচ হারান নিজে নিজে শিখেছে, বাপকেও শিখিয়েছে । বাপ তার গর্ব ভরে বলত “তুই একদম তোর ঠাকুর্দার মত । জাত শিল্পী ।”
সে সব কতদিন আগেকার কথা । ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হারান নীহার ডাক্তারের বাড়ির দিকে এগোল । সামনের সোমবার থেকে দুগ্গাপুজো শুরু । মানে হাতে আর তিনটে মোটে দিন । ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পুজো হয় । হারানের খোঁচর নীলমণি সারাদিন তক্কে তক্কে থেকে দেখেছে ডাক্তারবাবু আজ ব্যাঙ্ক থেকে দুগ্গার গয়নাগাঁটি এনে বাসায় রেখেছেন । ঠাকুরঘরের সিন্দুকে সব গয়না ভরে রেখে মোটা আধমণি একটা তালা ঝুলিয়েছেন । চাবি তাঁর মায়ের আঁচলে বাঁধা । “নীলমণিটা কাজের ছেলে । ওকে এবার ভালো করে ব্যবসার তালিম দিতে হবে” ভেবে হারান ডাক্তার নীহাররঞ্জন বটব্যালের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল । দুর্গার গয়না পেতে হলে প্রথমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হবে । মাঠের সমান উঠোন পেরিয়ে লোহার গ্রিল খুলে প্রথমে ডাক্তারবাবুর মায়ের ঘরে ঢুকে তাঁর আঁচল থেকে চাবি হাতাতে হবে । কাজটা সোজা নয়, কারণ বাড়ির বাচ্চাদুটো ওঁর সাথেই শোয় । ওদের ঘুম বেজায় পাতলা । ওদের ঘুম না ভাঙিয়ে কাজটা করতে হবে । তারপর ঠাকুরঘরে ঢুকে সিন্দুক খুলে গয়না সটকাতে হবে । বিস্তর কাজ । বাড়ির মানচিত্রটা নীলমণি বেড়ে বানিয়ে দিয়েছে। পেটে ব্যথার নাটক করে বিকেলবেলা নীহার ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ আনতে গিয়ে পাঁচ মিনিটে জরিপ করে নিয়েছে পুরো বাড়িটা । সেই হিসেবে ছবি এঁকে হারানকে বুঝিয়ে দিয়েছে কোন দিক দিয়ে এগোনো উচিৎ । মনে মনে কার্তিককে স্মরণ করে হারান সেই মত আমগাছটার সামনে এল । এই আমগাছটার একটা ডাল রান্নাঘরের ছাতে এসে পড়েছে । ছাতের দরজাটা যদি একবার খুলে ফেলা যায় তাহলে তরতরিয়ে বারান্দায় নেমে আসা যাবে । আর বারান্দায় নামলেই তো অনেকটা কাজ এগিয়ে গেল । হারান উদ্যম নিয়ে আমগাছের ডাল বেয়ে আরামসে রান্নাঘরের ছাতে নিঃসাড়ে নেমে পড়ল । নাহারকাটিয়ায় পুজোর আগেই ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে দেয় । তাই জানালা দরজা সব বন্ধ । একদিকে এটা হারানের জন্য সুবিধেরই । এক ঘরের খুটখাট শব্দ অন্য ঘরে যাবে না । চক্ষের পলকে ও সিঁড়ির দরজার খিল খুলে ফেলল । আজকাল অনেকে ঘুমপাড়ানি ওষুধ ছিটিয়ে চুরি করে । হারান সে সবের বিপক্ষে । সে চুরির সময় কাউকে অজ্ঞান করায় বিশ্বাসী নয় । নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের স্বাস্থ্যকে আঘাত করতে তার মন চায় না । টাকা পয়সা মানুষ আবার কামিয়ে নিতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্য একবার গেলে ফিরে পাওয়া কঠিন । তাছাড়া তার মত গুণী শিল্পীও যদি আর পাঁচজনের মত ছোট কাজ করে, সহজ কাজ করে তবে তাকে আর শিল্পী বলে মানবে কে ? বারান্দায় নেমে সোজা ডাক্তারবাবুর মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল হারান । আলতো করে দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেল । একটু চমকালো ও । এভাবে তো দরজা খুলে যাওয়ার কথা নয় । ডাক্তারবাবুর মা রীতিমত সন্দেহপ্রবণ বলে সারা নাহারকাটিয়া একবাক্যে জানে । পাশের বাড়িতে দুপুরবেলা কেউ যদি বলে “বলাই ফিরলি নাকি ?”, তিনি সন্দেহ করেন বলাইয়ের নির্ঘাত শরীর খারাপ হয়েছে । আকাশ দিয়ে দুটো কাক পরপর উড়ে গেলে তাঁর সন্দেহ হয় নির্ঘাত কেউ ভাত ফেলেছে আশেপাশে । এ হেন মানুষ দরজা খুলে ঘুমোবেন বলে বিশ্বাস হয়না হারানের । তার মানে কেউ নিশ্চয়ই উঠেছে । উঁকি মেরে কলঘর দেখে হারান । দরজা হাট করে খোলা কলঘরের, আলোও নেভানো । ডিঙি মেরে বারান্দার অপর প্রান্তটা দেখে সে । রান্নাঘরের দরজা বন্ধ । কিন্তু তলা দিয়ে খুব সরু একটা আলোর রেখ দেখতে পায় হারান । ‘এ তো ভালো কথা নয়’, মনে মনে ভাবে ও । বিনিদ্রিত গেরস্ত বাড়িতে রাত-বিরেতে আলো আসবে কোথা থেকে ? কে জ্বালবে ?
হারান রান্নাঘরের দরজায় কান পাতল ।
৩
“ডাক্তারবাবু একটু দরজাটা খুলুন না ।” রমণীস্যার জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে তারস্বরে বললেন । মাথা ব্যথায় তাঁর প্রায় পাগল পাগল অবস্থা । সেই সন্ধ্যেবেলায় নস্যি নিয়েছিলেন । তারপর থেকে নস্যির ডিবে গায়েব । ভাদু টুসুকে পড়িয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকে আর ডিবেটা পাচ্ছেন না । তাঁর স্পষ্ট মনে আছে টেবিলের ওপর রেখেছিলেন । তারপর ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলছিলেন । তারপর আর মনে নেই । হিসেব মত ডিবেটা তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে থাকার কথা । কিন্তু না, নেই তো । টেবিলের ওপর ছিল না যখন তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিশ্চয়ই পকেটে ঢুকিয়েছিলেন, এ কথাটাই তিনি ভেবেছেন । কিন্তু যত সময় পার হয়েছে তত মনে হয়েছে যে নস্যির ডিবে এই বাড়িতেই আছে । ভাবতে ভাবতে একসময় যখন তাঁর সব ভাবনা থেমে গেছে, তখন তিনি থাকতে না পেরে ছুটে এসেছেন ভাদু টুসুর বাড়িতে । দিনের আলোতে পাড়ার যে কুকুরগুলো আলসেমি করে এধারে ওধারে পড়ে থাকে, রাতের অন্ধকারের ওগুলোই যেন এক একটা বাঘ । বিস্কুট খাইয়ে ওদের কাবু করতে হারান জানলেও রমণীস্যার জানেন না । তাই তাঁকে ওভাবে চেঁচাতে দেখে কুকুরগুলোও সদর দরজার সামনে জমা হয়ে গিয়ে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল । এমন বিদঘুটে আওয়াজে কি আর কেউ ঘুমিয়ে থাকতে পারে ? সারা বাড়ির আলো জ্বালিয়ে সকলে বেরিয়ে এল যে যার ঘর থেকে । আশপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল প্রতিবেশীরা । রামকানাইবাবুর বাবা সন্ধ্যেবেলা থেকেই আফিম খেয়ে ঢোলেন, তিনিও উঠে এলেন । চারদিকের গোলযোগে যখন প্রায় হারানের চক্ষু চড়কগাছ তখন উপায়ান্তর না পেয়ে রান্নাঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে চমকে উঠল ও । ভাদু টুসু তখন দু’জনে দু’টিপ নস্যি নিয়ে সবেমাত্র নাকে গুঁজেছে ।
-“হ্যাঁচ্চো ।”
-“হ্যাঁচ্চো ।”
-“হ্যাঁচ্চো ।”
-“হ্যাঁচ্চো ।”
ক্রমাগত “হ্যাঁচ্চো” “হ্যাঁচ্চো” রবে সারাবাড়িতে সাড়া পড়ে গেল । রাঙাকাকু ভীমবেগে রান্নাঘরে পৌঁছে দেখেন হাঁচতে হাঁচতে ভাদু আর টুসুর তখন প্রায় দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় । ওদের সামনে ধরা পড়ে গিয়ে হারান চোর তখন খাবি খাচ্ছে । এর মধ্যে রাঙাকাকিমা গিয়ে সদর দরজা খুলে দিতেই রমণীস্যার ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন । হাঁচির আওয়াজে ততক্ষণে তাঁর কাছে এটুকু অন্তত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে তাঁর নস্যির ডিবে রান্নাঘরেই আছে । রাঙাকাকু হারানের ঘাড়টিকে নিজের থাবার মধ্যে বেশ যুৎ করে ধরে বললেন, “এটাকে আজ পুলিশে দেব ।” হারান থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ছাড়ান দেন বাবু । আর হবে না ।”
-“আর হবে না কি বলছ হে ! তোমাকে সেই লায়েকই ছাড়বে না পুলিশ ।” রাঙাকাকু বললেন ।
বড়মা আর মা এগিয়ে গিয়ে ভাদু আর টুসুকে ধরতে গেলে রাঙাকাকু হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “কেউ ওদের ধরবে না । ওরা হাঁচতে থাকুক । এটাই ওদের শাস্তি। সারাজীবন যেন মনে থাকে নস্যি চুরির ফল ।”
রমণীস্যার রান্নাঘরে ঢুকে মাটিতে নস্যির ডিবেকে পড়ে থাকতে দেখে লাফিয়ে গিয়ে তুলে নিলেন । তারপর একটিপ নস্যি দুই নাকের ছিদ্রতে গুঁজে বেদম জোরে হেঁচে বললেন “আঃ ।” শব্দে রাঙাকাকু অবধি চমকে উঠলেন । আর সেই ফাঁকে হারান তাঁর হাত ছাড়িয়ে একলাফে বারান্দায়, দ্বিতীয় লাফে সদর দরজায়, আর তৃতীয় লাফে রাস্তায় পৌঁছে গেল । রাস্তার কুকুরগুলো কতদূর অবধি হারানের পিছু নিল জানা গেল না । তবে তারপর থেকে হারানকে আর কোনদিন নাহারকাটিয়াতে দেখা যায়নি । রামকানাইবাবু কাশীতে গিয়ে হারানের মত দেখতে একজন সাধুকে দেখেছিলেন । আশপাশের লোকদের থেকে নাম শুনেছিলেন ‘মৌনীবাবা’। কথা বলেন না । শুধু নস্যি টানেন ।
0 comments:
Post a Comment