সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
সুমন
অনিন্দ্য পাল
এক.
বুকটা দুরু দুরু করছিল রাতুলের। কাকিমা দেখা করে যেতে বলেছেন। রাতুল জানে কেন ডেকেছেন কাকিমা। দোতলার ঘরে পড়াচ্ছিলেন হিমেল স্যার। পড়ানো প্রায় শেষের দিকে কিন্তু আজ রাতুলের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। স্যার আনসিন প্যাসেজটা কাজ দিয়েছিলেন। অন্যদিন হলে সবার আগেই রাতুলের খাতা জমা পড়ে যেত কিন্তু আজ এখন খানিকটা বাকি আছে তার। ভোকাবুলারি আর টাইটেলটা করা হয় নি এখনও।
"রাতুল, দেখা করে যাবি কাকিমার সঙ্গে" - বলে স্যার টেস্টপেপারটা বন্ধ করে নীচে নেমে গেলেন। আর যারা পড়ছিল তারাও কেউ কেউ আড় চোখে তাকে দেখে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে নেমে গেল নীচে। রাতুল তার তাপ্পি দেওয়া চটের ব্যাগে খাতা-বই ভরে নামতে যাবে, তখনি দেখলো সিঁড়িতে সুমন দাঁড়িয়ে আছে।
-- চল। বলে সুমন তার একটা হাত ধরলো।
রাতুল চুপ করে থাকলো। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে দুজনে নেমে এল নীচে। সুমনের সঙ্গে তার ঘোরা বারন। এটা হয়েছে রাতুলেরই দোষে। সে দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই সুমনকে তার সঙ্গে বাড়িতে নিয়ে গেছিল। তাদের মাটির উঁচু ঘর-দাওয়া। সুমন দাওয়ায় উঠে বসলে রাতুলের মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-- কী নাম তোর? রাতুল আর তুই এক ক্লাসে পড়িস?
-- হ্যাঁ, কাকিমা। আমি রাতুলের বন্ধু। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। আমার নাম সুমন।
-- ও, সুমন। সুমন কী? মানে টাইটেল কী?
-- ইসলাম। মানে সুমন ইসলাম।
রাতুলের মা আর কোনও কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেছিলেন। তারপর কিছুক্ষণ পরে সুমন চলে গেলে রাতুলকে একচোট নিয়েছিলেন মা আর ঠাকুমা।
"এ বাড়িতে মোল্লা একদম আনা যাবে না। আর আজ থেকে তোরও সুমনের সঙ্গে মেলামেশা একেবারে বন্ধ। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু..." বলে সেদিন ঠাকুমা কড়া নিষেধ জারি করে দিয়েছিল। তবে সুমন এসবের কিছুই জানে না।
নীচে নেমে রাতুল দেখল, কাকিমা সিঁড়ির পাশেই রান্নাঘরে রান্না করছেন। তাকে ডেকে বললেন,
-- তুই বোস ওই বেঞ্চটাতে। আর ওটা কে? সুমন ! তোর তো কোন বাকি নেই। তুই চলে যা।
সুমন মাথা নীচু করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
কয়েক মিনিট বসে থাকার পর কাকিমা এলেন। হাতে একটা পুরনো ডায়রি। সেটা খুলে বললেন,
-- সেপ্টেম্বর, অক্টোবর দু’মাস টাকা দিসনি তুই। এই নভেম্বর পড়লো। আজ পাঁচ তারিখ। পরদিন যদি দুমাসের মাইনে একসঙ্গে না আনতে পারিস তবে আর পড়তে আসার দরকার নেই। এটা বিনা পয়সার কোচিং নয়। তোরা খাবি, পরবি সব করবি আর মাস্টারের মাইনে দিতে গেলেই যত এ না! যা, বাড়ি গিয়ে বলবি বাবাকে।
রাতুলের বুকের উপর যেন কেউ একটা বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। কেউ যেন তার গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে চলে গেল। এই সব কথা বাবাকে গিয়ে বলবে কী করে? বাবা তো আজ এক মাসের উপরে শয্যাশায়ী। ট্রেন কম্পার্টমেন্টে হকারি করতে করতে রাতের ট্রেনে আসছিল, লাইনের পাশে রাখা বাঁশ পায়ে ঢুকে তেরোটা সেলাই। কোন উপার্জন নেই। একবেলা কোনমতে খাওয়া জুটছে। কদিন পর সেটাও হবে না।
স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রাতুল। স্যার তখন একটা সর্ট প্যান্ট পরে খেতে বসছেন। এক থালা ধবধবে সাদা ভাত, বেশ অনেকটা শাক, একটা বড় মাছের দাগা। কাকিমা বাটিতে করে আরও একটা কিছু নিয়ে এলেন।
রাস্তায় পা দিতেই রাতুল দেখলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমন। এগিয়ে এসে রাতুলের কাঁধে হাত রাখতেই হু হু করে কেঁদে উঠল সে। কান্না জড়ানো গলায় বললো,
-- আমার বোধহয় আর পড়াশুনা হবে না রে সুমন।
সুমন তার চোখের জল মুছিয়ে বললো,
-- চল , বাড়ি যাই।
দুই.
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল রাতুলের। আজ শনিবার না। ইংরেজি পড়া আছে তো। দেরি করে গেলে আবার হিমেল স্যার খুব বকেন। বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়েই কাকিমার কথাগুলো মনে পড়ল রাতুলের, " দুমাসের মাইনে যদি একসঙ্গে না আনতে পারিস তবে আর পড়তে আসার দরকার নেই।"
থমকে আবার বসে পড়ল রাতুল। অনেকটা কষ্ট বুকের ভিতর থেকে গলার কাছে উঠে আসতে লাগল।
বাইরে রাতুলের মা তখন একটা বস্তায় ঘুঁটে নিয়ে চক্কোত্তিদের বাড়ি যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। হঠাৎ একটা সাইকেলের ঘন্টির শব্দে মুখ তুলে দেখলেন, বাড়ির সামনের রাস্তায় সুমন দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন, সেদিন ও চলে যাওয়ার পর সমস্ত ঘর দাওয়া আবার করে গোবরজল দিয়ে মুছিয়েছিলেন রাতুলের ঠাকুমা। আজ আবার যদি সুমন ওঠে দাওয়ায় তাহলে খুব মুশকিল হবে।
-- কাকিমা, রাতুল পড়তে যাবে না?
রাতুলের মা মুখটা তুলে বললেন,
-- না, ও বললো স্যার মাইনে চেয়েছে। এখন তো আমাদের খুব টানাটানি চলছে, তাই দিতে পারবো না। আর না দিতে পারলে স্যার পড়াবে না। থাকগে নিজে নিজে করুক। সেই তো খেটে খেতে হবে।
-- কাকিমা ওকে একটু ডেকে দিন না। একটা কথা আছে।
বিরক্ত হয়ে রাতুলের মা বললেন,
-- বললাম তো যাবে না ও। তুই চলে যা।
-- দিন না কাকিমা একবার ডেকে। খুব দরকার।
-- এতো ভারি নাছোড়বান্দা।
কোনও ভাবে সুমনকে নিরস্ত্র করতে না পেরে চেঁচিয়ে ডাকলেন,
-- রাতুল, এই রতু বাইরে আয়।
রাতুল ঘরে বসে সব শুনতে পাচ্ছিল। এবার মায়ের ডাক শুনে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে সোজা সুমনের কাছে চলে এল।
-- রাতুল, চল পড়তে যাবি। রাতুলের হাতটা ধরে বললো সুমন।
-- না রে। মা বললো এখন অত টাকা জোগাড় করতে পারবে না।
-- টাকা দেওয়া হয়ে গেছে।
অবাক হয়ে রাতুল তাকিয়ে থাকলো সুমনের মুখের দিকে। রাতুলের মা বস্তায় ঘুঁটে ঢোকাতে ঢোকাতে কান খাড়া করে রেখেছিলেন, ওদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। সুমনের কথাটা কানে যেতে তিনিও চমকে উঠলেন।
-- টাকা দেওয়া হয়ে গেছে মানে? কে দিল? হতবাক রাতুল সুমনকে জিজ্ঞাসা করল। তার মনে হল সুমন মজা করছে, মনটা খারাপ হয়ে গেল রাতুলের।
-- সত্যি বলছি, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। স্যার তোকে পড়তে যেতে বলেছে।
-- টাকাটা কে দিল সেটা তো বলবি?
-- আমার দাদি। মানে ঠাম্মা। ঠাম্মার একটা পিতলের ঘড়া ছিল। কেউ ব্যবহার করে না বলে সেটা বেচে দিয়ে স্যার কে টাকাটা দিয়ে দিতে বললো। আমি বাড়ি ফিরে সেদিন বলেছিলাম, তোকে সেদিন কাকিমা যা যা বলেছিলেন। শুনে দাদি খুব কষ্ট পেয়েছে।
তারপরেই রাতুলের একটা হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!
-- আমি আসছি। এক ছুটে ঘরে ঢুকে গেল রাতুল।
রাতুলের মা এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন। কখন যে তার হাত থেকে ঘুঁটের বস্তাটা খসে পড়ে গেছে, বুঝতেই পারেন নি। চোখ ফেটে জল আসছিল তার, কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না সুমনের দাদি আর রাতুলের ঠাকুমার মধ্যে এতটা পার্থক্য হল কী করে?
ততক্ষণে রাতুল বইপত্র নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। রাতুলের মা জলে ভরা চোখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবলেন, বয়সে তো বড়, নাহলে আজ তোকে প্রণাম করতাম বাপ, তা যখন পারবো না, তখন ...
রাতুল তাদের গোবরজল নিকানো মেটে বারান্দা থেকে নেমে আসতে আসতে দেখলো তার মা সুমনের মুখটা দুহাতে ধরে তার কপালে একটা গভীর চুমু এঁকে দিচ্ছে।
0 comments:
Post a Comment