সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


 রাজেনের রূপকথা 

অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী 


 

অনেক অনেক দিন আগে যখন  দেশে রাজা ছিল আর ছিল রাজ প্রাসাদ, তখন সৈন্যরা ঘোড়ায় উঠে ছুটে চলত দূর দেশে , যখন পাখিদের মুখে , পশুদের মুখেও মানুষের ভাষা শোনা যেত, ঠিক সেই সময়ে উদয়পুর রাজ্যে বাস করত এক চাষার ছেলে তার নাম ছিল রাজেন। রাজেনের বাবা, ঠাকুর্দা সবাই চাষা  কিন্তু রাজেনের ছিল পড়ার নেশা, যার জন্য তার বাবা তাকে বরাবর বকা-বকি করত আসল কারণ ছিল অন্য। রাজেন যখন পড়তে বসত তখন সে শুধু পড়তেই থাকত।  সময় , দিন সব কেটে যেত , কিন্তু বই থেকে তার মুখ আর কিছুতেই উঠত না বাড়ির কোন কাজ  সে করত না, বলা ভাল করতে চাইত না। তাই তার বাবার মনে খুব অশান্তি ছিল।

একদিন রাজেনের বাবা ছেলেকে ডেকে বলেই দিল - দেখ বাবা, তুমি চাষার ছেলে, শুধু পড়াশোনা করবে আর অন্য কোন কাজ করবে না, এভাবে কি করে চলবে ? মাঠে তোমাকে যেতেই হবে

রাজেন মাথা নামিয়ে বাবাকে জবাব দিল - আমার পড়তেই  ভাল লাগে, আর কিছু ভাল লাগে না। কাজ করতেও ভাল লাগে না শুধু মনে হয় ওই পুঁথি গুলো আমায় ডাকে

-         ওসব পুঁথি পড়ে কি হবে? তুমি চাষার ছেলে, রাজার ছেলে তো নও

রাজেনের বাবা বিরক্তি সুরে ছেলেকে জবাব দেবার পরে রাজেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাতে কর্নপাত না করে বাবা বলে গেল- যদি পড়াশোনা করতে হয়, জঙ্গলে চলে যাও। পড়াশোনা করলে ঘরে ঠাঁই হবে না

বাবা চলে যাবার পর থেকেই রাজেন বারবার তার পুঁথি গুলো দেখল আর ভাবল কি করবে? তার পর সমস্ত পুঁথি কে গামছায় বেঁধে বিছানার পাশে রেখে দিল

রাত নামল, আর রাজেন তখন গায়ে ফতুয়া পরে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরল। মাথায় গামছা বাঁধা পুঁথির ভাণ্ডার বাবা আর মা যে ঘরে শুয়ে আছেন সেই ঘরের কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে একবার তাদের দেখে দূর থেকে প্রনাম করে গৃহত্যাগ করলো হাঁটতে হাঁটতে সে চলেছে অনেক দূর, প্রথমে গ্রাম পেড়িয়ে নদী তারপর জলা জমি পেড়িয়ে ভোর রাতে এসে পৌছাল  তিশারির জঙ্গলে তখন আলো ফোটেনি, তাই রাজেন এসে বসল একটা গাছের নিচে।



বসে বসে সে খানিক ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ কাদের কথায় তার ঘুম ভেঙে গেল কারা যেন তাকে নিয়েই কথা বলছে  

-         শুনেছ, এখানে এই গাছের নিচে যে বসে আছে তার কি নাম ?

-         শুনেছি, রাজেন না ?

-         হুম তুমি জানো সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ?

-         তাই ! বুড়ো বাবা মা কে ফেলে ?

-         হ্যাঁ, শুধু কাজ করবে না বলে।

-         তাই না কি ?

-         হ্যাঁ আসলে সে তো পড়াশোনা করতে খুব ভালবাসে কিন্তু সে তো জানেনা, যে রাঁধে সে চুল বাঁধে

-         তাহলে তার কি হবে ?

-         কি হবে ? রাত নামতেই সেই রাক্ষস টা চলে আসবে আর তার সাথে যুদ্ধ করে তো কেউ পেরে ওঠেনা , তাই তার হাতেই মরতে হবে ?

-         মরতে হবে ? বল কি?

-         হুম। কিন্তু

-         কিন্তু ? কিছু কি

-         করার আছে কিন্তু তা কি রাজেন করতে পারবে?

-         কি করার আছে ?

-         সেটা বলতে পারি, কিন্তু চুপ- যেন কেউ শুনতে না পায়।

গাছের নিচে বসে থাকা রাজেন বসে বসে আরও সতর্ক হয়ে যায়, ভাবতে থাকে- আমার কথা যখন বলছে, তখন আমাকে শুনেই তার সমাধান করতে হবে। এই পাখি দুটো নিশ্চয়ই ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী যারা জানে আমার সমস্ত কথা

রাজেন আরও সতর্ক হয়ে , কানা খাড়া করে তাদের কথা শোনে

-         তবে শোন , এখান থেকে বিশ  ক্রোশ দূরে একটা বিশাল পুকুর আছে, ঠিক তার পাশে একটা বট গাছের পাশে একটা গর্ত রয়েছে, তার ভেতরে আছে একটা পুঁথি। সেই পুঁথিতে একটাই বাক্য লেখা আছে, সেই বাক্যের মানে যে উদ্ধার করতে পারবে, সেই হয়ে যাবে রাজা, আর তার হাতের মধ্যে এসে জগতের সব সম্পদ। আর এই রাক্ষসকেও সে মেরে ফেলতে পারবে

-         বাহ !

-         বাহ নয়। সেই পুঁথি হাত দিলেই একটা বিশাল দশ মুখো সাপ এসে দাঁড়াবে সামনে, আর সে এক থেকে একশো গুনবে। সেই গোনার মধ্যেই যদি রাজেন বলে দিতে পারে ওই বাক্যের কি মানে, তবেই সে বাঁচবে, নয়ত সাপ তাকে খেয়ে ফেলবে

এই কথা বলেই একটা ছড়া বলে চুপ করে গেল তারা। সেই ছড়া রাজেনের কানে বেজে চলেছে

পুঁথির সাথে দেখবে যদি

রঙের বাহার অতি

জানবে পুঁথি বলছে তোমার

জীবন মানেই ক্ষতি

পুঁথির পাশে জলের ফোঁটা

জীবন মানে জল

অক্ষরে তার ঢালুক মধু

আসমুদ্র হিমাচল ।।

ছড়াটা মুখস্তের মতো পড়তে পড়তে রাজেন সেই গামছা ভরা পুঁথি গুলোকে সযত্নে গাছের নিচে রেখে নিজেকে প্রস্তুত করলো। এক বার ভাবল , এই পাখিদের কথায় এগিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে ? তারপর নিজেই ভাবল তার কাছে আর কি কোন অন্য পথ আছে ? তাই শেষে ঠিক করলো -না সে যাবে , তাকে যেতেই হবে

ভোরের সুর্য তখন পুর্ব দিকে সবে লাল হয়ে উঠেছে, তার দিকে তাকিয়ে , প্রনাম করে সে এগিয়ে চলল সামনে জঙ্গল আরও গভীর হয়, আরও আলো কমে আসে যদিও সুর্য তখন ভোরের থেকে সকালে যাচ্ছে। রাজেনের পাশ দিয়ে কখনও যে কত পশু লাফিয়ে লাফিয়ে পেড়িয়ে যাচ্ছে তার কোন হুঁশ নেই। সে জানে পৌঁছাতে হবে সেই  বিশাল পুকুরের পাশে ।আর খুঁজতে হবে সেই বিশাল বট গাছ।  সে হাঁটছে হাঁটছেই হঠাৎ সে দেখতে পেল দূরে একজন দাড়িওয়ালা বুড়ো সে অবাক হল এতো বিশাল জঙ্গলের মধ্যে একটা বুড়ো হাতে একটা লাঠি নিয়ে বসে আছে একটা পুকুরের পাশে   আরে এতো সেই বিশাল পুকুর, আর তার পাশে বিশাল বট গাছ। কিন্তু বুড়ো লোকটাসাদা আলখাল্লার মতো বিশাল লম্বা একটা পোশাক পরলেও লোকটা কিন্তু বেঁটে লোকটা এক মনে জলের দিকে চেয়ে আছে , আর রাজেন গিয়ে দূর থেকে তার দিকে একবার চেয়ে খুঁজতে শুরু করলো সেই গর্তটা কোথায় সেই পুঁথি ? বুড়ো মানুষটা কিন্তু তখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে জলের দিকে অদ্ভুত লাগল তার। তার মাথার ওপর শঙ্কুর মতো  সাদা লম্বা টুপি ছিল, তার ঠিক ওপর একটা গোল মুক্তোর মতো কিছু চকচক করছে কিন্তু রাজেনের এত কিছু দেখার সময় নেই



বিশাল পুকুরের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে আর খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে বট গাছে ঈশান কোণে খুঁজে পেল সেই গর্তটা   সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে, আর কিছুক্ষনের মধ্যে সন্ধ্যে নেমে গেলে আর খোঁজা যাবেনা সে জানে। হঠাৎ সেই বুড়ো লোকটা যেখানে বসে ছিল তার ঠিক পাশটিতে একটা গর্ত দেখতে পেল, আর সেই গর্তের ভেতর থেকে খুব ক্ষীন ভাবে দেখা যাচ্ছে একটা আলো।

 কিন্তু একি! বুড়ো লোকটার হাতের ছড়িটা সেই গর্তের মধ্যে ! রাজেন নিচু হয়ে বুড়োটাকে দেখছে যাতে তাকে দেখে সেই মুখ তুলে তাকায়।  কিন্তু লোকটার দৃষ্টির কোন পরিবর্তন হয় নি সে যেমন দেখছিল ঠিক তেমন- দেখছে। হাত ঢুকিয়ে পুঁথি যেই বার করতে যাবে, বুড়ো লোকটার হাতের লাঠি আরও শক্ত হয়ে গর্তের মুখে এমন ভাবে ঢুকে যাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে তার হাত সমেত পুরো শরীরটা সেই গর্তের মধ্যে ঢুকে যাবে।

রাজেনের কষ্ট হচ্ছে আর তার হাতের অর্ধেকটা গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। সে চিৎকার করে সেই বুড়ো লোকটাকে বারবার জানান দিলেও বুড়োর মুখের কোন বিকৃতি নেই, সে কোন দিকে দেখছে না।  সে শুধু  জলের দিকে তাকিয়ে আছে   আর গর্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে রাজেন, এখন তার অর্ধেক শরীর, এরপর

রাজেনের মাথা আর চোখ যখন গর্তের মধ্যে ঢুকে গিয়ে হাঁসফাঁস দশা ঠিক তখন- চোখে পড়ল সেই পুঁথি তার অর্ধেক শরীর টা তখন গর্তে, তার চোখ খোলা , আর পুঁথির ভেতর থেকে আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কি তার রঙের বাহার ! তার চোখ জ্বলে যাচ্ছে, আবার কখনও মনে হচ্ছে এমন ছবি তো সে আগে কখনও দেখেনি ! একি অদ্ভুত ছবি !

কিন্তু তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যেন, কিছুতেই এই গর্তের মধ্যে এমন ভাবে থাকতে পারছে না বাকি শরীর যেমন কে তেমন বাইরেতে আছে, সে গর্তের ভেতরেও পুরোপুরি ঢুকতে পারছে না, আবার গর্ত থেকে বেরতেও পারছে না এদিকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার মনে পরছে ছড়ার প্রথম অংশটা -

পুঁথির সাথে দেখবে যদি

রঙের বাহার অতি

জানবে পুঁথি বলছে তোমার

জীবন মানেই ক্ষতি

বাঁচার পথ বুঝি আর নেই, ধীরে ধীরে যখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা লম্বা ঝটকায় তার প্রান যেতে বসে ছিল একটা হাত হঠাৎ করে এসে মুহুর্তে তার পা দুটোকে টেনে গর্ত থেকে বার করে ছুঁড়ে দিল দুরের মাটিতে সমস্ত শরীর নিয়ে যখন সে পড়ল মনে হল তার শরীরের হাড়গোড় গুলো যেন আস্তে আস্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল দেখল, এইবার সেই বুড়োটা  হাসতে হাসতে  লাঠি নিয়ে উঠে লাফিয়েই যাচ্ছে, লাফিয়েই যাচ্ছে মনে হতেই পারে একি বীভৎস নাচ ! কিন্তু নাচ নয়। যে অদ্ভুত বীভৎসতা   হঠাৎ তার চোখে পড়ল রাজেনের হাতের পুঁঁথিটা রাজেন নিজেও লক্ষ্য করেনি কখন যে পুঁথিটা তার হাতের সঙ্গে চলে এসেছে। যন্ত্রনা আর বুড়োটার অবাক লাফানো দেখে সে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বুড়োটা যেই তার হাতের পুঁথি দেখল, সঙ্গে সঙ্গেই কাঁদতে শুরু করে দিল সেই প্রচণ্ড কান্না, যার আওয়াজ কান ফাটিয়ে দিচ্ছে, সাথে তার কান্নার জল প্রচণ্ড বেগে চোখ থেকে বন্যার মতো দ্রুত গতিতে  ঝরে পুকুরে যাচ্ছে। নিমেষে পুকুরের জল বেড়ে চলেছে।  এই দৃশ্য দেখে পশু পাখি সবাই প্রাণ ভয়ে  ছুটতে শুরু করল। এক ভয়ঙ্করের আগমন বার্তা যেন নিয়ে আসছে এই কান্না। কি ভয়ঙ্কর ! রাজেন বুঝতে পারছে না এখন সে কি করবে পুকুরের জল চোখের পলকের মধ্যে বেড়েই চলেছে কান্না কি ভাবে থামাবে ভাবার আগে রাজেন একবার হাতের পুঁথির দিকে দেখল, আর সেই পুঁথি খুলতে যাবার মুহুর্তেই সে দেখল, পুকুরের জলের মধ্যে ঢেউ শুরু হয়েছে, বিশাল ঢেউ আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে গাছ, বট গাছ পেরিয়ে সুদূর আকাশে উঠে যাচ্ছে



অবাক চোখে এসব দেখার মুহুর্তেই আরও অবাক করা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল যখন বুড়ো লোকটা পলক ফেলার আগেই সেই ঢেউ তে ঝাঁপ দিল।  রাজেন কিছু ভাবার আগেই সেই ঢেউ এর ভেতর থেকে  বেরিয়ে এল বিশাল একটা সাপ। দশ মাথাওয়ালা সাপ টা তখন জিভ লক লক করে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুরু করলো- এক, দুই

রাজেন বুঝতেই পারছে তার হাতে সময় কম, তাই সে পুঁথিটাকে খুলে সেই বাক্যটা পড়ল - দিনের শেষে ঘুমের দেশে, শীত ঘুম যেই আসে

     স্বপ্ন ঘিরে রাখে তাকে, আকাশ বাতাস হাসে   

মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে শীত, ঠাণ্ডা কিন্তু সামনে থাকা দশ মাথার সাপের লকলকানি তার মাথার মধ্যে থাকা সমস্ত বুদ্ধিকে কোথায় যেন চেপে দিচ্ছে কেউ। না সে শুনতে পারছে না আর কিছু সময় কেটে যাচ্ছে- ত্রিশ, একত্রিশ, বত্রিশ

রাজেন একবার ভাবল ছুটে পালিয়ে যাবে তারপর যখন সে ছুটে পালাতে যাবে ভাবছে, দেখল সাপ তার চারদিকে, দশটা মাথা তাকে মাঝখানে রেখে তার চারিদিকে যেন নরক কাণ্ড তৈরি করেছে- বাহান্ন, তিপান্ন

কি মানে এই বাক্যটার ? কি মানে ? এদিকে একটু করে সাপের মাথা তার সামনে চলে আসছে চোখ বন্ধ করে রাজেন যেন শেষ বার তার বাবা-মা-এর মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কিছুতেই ভাবতে পারছিল না , কারন ভাববে কি করে ? কানের সামনে সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার শুধু চলেছে- তিরাশি, চুরাশি

না , আর সময় নেই, এবার মৃত্যুর পালা। সচেতন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে রাজেন হাঁটুর ওপর বসে হাত জোর করে বলে উঠল- হে নাগ মহাশয়, আমাকে

এরপরের কিছু কথা বলার আগেই, সেই সাপ আরও জোরে দোলা শুরু করল। সে পঁচানব্বই এর পর সব কথা থামিয়ে দ্রুত বেগে দশটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্রুত গতিতে আকাশের দিকে উঠে গেল। যত উঠছে আকশের দিকে, আকাশ থেকে ততই মণি-মুক্তের বৃষ্টি নামছে আর সবশেষে বুড়োর টুপিটা উড়তে উড়তে নামছে, আর রাজেনের হাতের ওপর এসে টপ করে পড়ল টুপির মাথায় বিশাল মণি।  মণি টাকে নিজের চোখের সামনে  তুলে আনতেই সেই মণির মাঝখানে দেখতে পেল কিছু একটা ঝলমল করছে কি সেটা ? ভাল করে আরেকবার দেখল সে। আরে এতো একটা রাজ প্রাসাদ কি অপুর্ব রাজপ্রাসাদ ! সেই প্রাসাদটা শুধু ঘুরেই চলেছে।  কি অদ্ভুত যেন সত্যি ! কি অদ্ভুত ! কিন্তু এটা কি সত্যি? এই রাজপ্রাসাদ কি রয়েছে !



মণিটাকে হাতে নিয়ে যেই উঠতে যাবে ঠিক তখনই জঙ্গলের মধ্যে প্রচন্ড ঝড়, আর সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটে আসছে এক বিশাল শরীর কে সেচারিদিক অন্ধকারে যেন কালো ঝড় বইছে ! আরে সেই ঝড়ের মধ্যে থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসছে এক বিশালাকায় দৈত্য। যার বিশাল হাতের মধ্যে সেঁদিয়ে রয়েছে চকচকে তলোয়ার রাজেন বুঝতেই পারছে- এক ভয়ানক দানব তার দিকেই আসছে উফফ! এটাকি সেই রাক্ষস যার কথা ব্যাঙ্গমা- ব্যাঙ্গমী বলেছিলকি ভয়ানক তার চিৎকার ! কানে আঙ্গুল দিতে হয়, কিন্তু তার তো সে কাজের সময় নেই, তাকে পালাতে হবে। সে এবার ছুটতে শুরু করলেও ঝড়ের গতির সাথে সে কি পারে তাল মেলাতে? রাক্ষস তখন তার কাছকাছি আসতেই, পড়ে থাকা গাছের ডাল লেগে রাজেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে, আর তার হাতে থাকে বিশাল মণিটা পাথরে লেগে ভেঙে গেল। মুহুর্তেই তার প্রচন্ড , উজ্জ্বল আলোয় ঠিকরে পড়ল রাক্ষসের চোখে রাজেন বুঝতে পারছে সেই উজ্জ্বল আলোয় রাক্ষসের চোখ বোধহয় অন্ধই হয়ে গেছে কিন্তু দানবের শক্তি তো কমেনি; সে চোখের ওপর হাত দিয়েও রাজেন কে ধরার জন্য হাত বাড়াচ্ছে যত হাত বাড়াচ্ছে, রাজেন পিছিয়ে যাচ্ছে এক পা এক পা করে কিন্তু আর তো যাবার জায়গা নেই, একদম বিশাল পুকুরের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আর পালানোর রাস্তা তার কাছে নেই, কিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে রাক্ষসের হাত।

রাজেন দেখল আর সময় নেই, কিছুই করার নেই। তাকে পুকুরে ঝাঁপ দিতে হবে, কিন্তু সেই বিশাল পুকুর কতটা গভীর, কি আছে তার নিচে-সে কিছুই জানে না ! রাক্ষস অন্ধ চোখেই এগিয়ে আসতে আসতে তার পা গিয়ে পড়ল ভাঙা মণির ওপর, আর পড়তেই সেই উজ্জ্বল আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে গেল এমন ভাবে যে রাক্ষসের সমস্ত শরীরটাকে নিমিষে গলিয়ে সেই ভাঙা টুকরোর মধ্যে এমন ভাবে নিয়ে চলে গেল যেন বরষার জল মুহুর্তে পুকুরে এসে মিশে যায়, আর মিশেই যায় এরপরের অত্যাশ্চর্য্য দৃশ্য দেখে সেতো শুধু অবাক নয়, ভাবছে সে কি বেঁচে আছে না কি সব স্বপ্ন! বড় মণিটার সেই ভাঙা টুকরোগুলো নিজে নিজেই একসাথে জড় হয়ে গেল আবার পুরনো অবস্থাতেই ফিরে এল। রাজেন দেখছে সন্ধ্যে নেমে আসছে, আর তার রক্তাভ আলোর মধ্যে তার চারপাশে পরে থাকা সমস্ত মণিগুলো মুগ্ধতার মতো জ্বলছে আর সেই বড় মণিটা যে আলো তার চোখে ফেলছে তাতে রাজেনের ঘুম পেয়ে গেল শুয়ে পড়ল ঠিক পুকুরের পাশে

সকালে যখন ঘুম থেকে উঠেছে তখন সুর্য মাথার ওপর। আগের সন্ধ্যের মতোই সমস্ত মণি তার চারপাশে ছড়ানো আর সেই বড় মণিটা পরে আছে যেমন আগের দিন পড়েছিল সে দেখছে পাখিরা কিচিরমিচির করে গান করছে, হরিণ লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াচ্ছে সে খুব দ্রুত সেই মণি গুলোকে নিয়ে একসাথে জড় করলো, তারপর তার গায়ের জামাটা খুলে তার মধ্যে সবগুলোকে বেঁধে রওনা দিল

এরপর অনেক বছর পরের কথা তখন রাজেন তার টোলে বসে আছে। ছাত্রছাত্রীরা পড়ছে সে যত মণি সংগ্রহ করে এনেছিল, তার অর্ধেক বিক্রি করে সে গ্রামে দুটো টোল খুলেছে, সাথে একটা পাঠাগার কিন্তু সেই বড় মণিটা সে বিক্রি করেনি, কারন সেই মণির একটা বিশেষত্ব আছে সেই মণি অনেক রাতে রাজেনের সাথে কথা বলে আর তাকে শোনায় দেশ বিদেশের অদ্ভুত ঘটনা, যা রাজেন সকাল হলেই তার ছাত্রছাত্রীদের শোনায়, আর তারা মুগ্ধ হয়ে রাজেনের দিকে তাকিয়ে ভাবে- কত কি ঘটে যা তাহা / মনে হয় সবই যদি সত্য হত-আহা

0 comments: