সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
এক মফস্বলী বৃদ্ধার বইমেলা দর্শন
অনুরাধা মুখার্জি
বলা বাহুল্য মফস্বলী বৃদ্ধাটি লেখিকা স্বয়ং। শুধু মফস্বলীই নয়,কলকাত্তাইয়া বাঙালির ভাষায় মেড়ো কিংবা ছাতুখোর মফস্বলী।জন্ম-কর্ম বিহারে,কর্মাবসান অধুনা ঝাড়খণ্ডে।
যদিও কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রথম সূত্রপাত ১৯৭৬ সনে, তখন আজকের বৃদ্ধাটি তার জীবনের তৃতীয় দশকে সদ্য পদার্পণ করেছে ও তখন পর্যন্ত সে সম্পূর্ণ সুস্থ কিন্তু প্রবাসী হওয়ার দরুণ ব্যাপারটি সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল না।তাই প্রথমবারের বইমেলা দেখার সৌভাগ্য থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল আর সেই দুঃখ তাকে আজীবন বহন করে চলতে হয়েছে ।পরে সংবাদ সূত্র থেকে বইমেলার পিছনের সব ভাবনা-চিন্তা, উদ্যোক্তাদের নাম ধাম ও সম্পূর্ণ ইতিহাস সংগৃহীত হলেও সেসব সর্বজন বিদিত তথ্যপঞ্জীর উল্লেখ করে লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করার প্রশ্ন ওঠে না।
এরপর থেকেই বইমেলা দেখার জন্য বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠলাম। নানা আকারের বইয়ের দোকান ঘুরেছি, লাইব্রেরীতে ভালোই যাতায়াত ছিল,সে পাড়ার লাইব্রেরী হোক বা কলেজ ইউনিভারসিটির,বিহার স্টেট লাইব্রেরি এমনকি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও বই নাড়াচাড়া করার অভিজ্ঞতা আছে। অনেকের ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ ও দেখেছি হতবাক হয়ে। কিন্তু আস্ত একটা মেলা শুধু বইয়ের এ না দেখলেই নয়, না দেখলে আমার মনুষ্য জন্মই বৃথা। কিন্তু বইমেলার নির্ধারিত সময়ে মাঝেসাঝে সরস্বতী পুজোর একদিন ছুটি ছাড়া অন্য কোনো ছুটি থাকে না, তাই বাইরে থেকে কোলকাতা এসে মেলা দেখা সম্ভবপর নয়,আর সেই সময়ে কলেজে ফুল সেশন চলে, তখন ব্যক্তিগত কারণে ছুটি নিতে নিজের বিবেকই সায় দেয়না। এইভাবেই কেটে যায় সাতের দশক,আর তার পরেই ঘটে যায় আমার জীবনে চরম বিপর্যয়। ফলস্বরূপ কোনো বার কোলকাতা থাকলেও মেলা দেখা ঘটে ওঠে না সঙ্গীর অভাবে। আত্মীয় স্বজনের বক্তব্য বইমেলায় অতটা হাঁটাহাঁটি আমার খোঁড়া পায়ে সম্ভব নয়, তাছাড়া মেলার বিখ্যাত ধূলিরাশি আমার পোষ্য হাঁপানি রোগটির পক্ষে ক্ষতিকারক। অতএব মনের সাধ মনে চেপে রাখা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না।
অবশেষে একবার,বইমেলা তখন সাবালক হয়েছে আর আমি নিজেও আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখে গিয়েছি তখনই জানতে পারলাম যে সেবারের বইমেলার থীম ফ্রান্স, আমার স্বপ্নের দেশ। আশৈশব অক্সফোর্ডে পড়ার ও প্যারিসে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এসেছি যার কোনোটিরই বাস্তবায়ন সম্ভবপর ছিল না, তাই অন্তত ফ্রান্সের প্যাভিলিয়ন দেখেই মনের সাধ পূর্ণ করা যাক।তাই ঠিক করলাম এবার আমি যাবোই যাবো। দেখি কে আমার পথরোধ করে?
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,তবে একলা চলো রে।"অতএব ছুটি ইত্যাদি নিয়ে কোলকাতা এলাম। কিন্তু আমাদের গ্রাম্য ভাষায় একটা প্রবাদ আছে না--কপালে না থাকলে ঘি,ঠকঠকালে হবেকি? আমারও সেই দশাই হলো। সেবারই ১৯৯৭সালে মেলায় আগুন লেগে পুড়ে গেল রাশি রাশি বই, মৃত্যু হলো এক পুস্তকপ্রেমী দর্শকের।মেলা দেখার স্বপ্ন,স্বপ্নই রয়ে গেল, টিভিতে পোড়া, আধপোড়া বইয়ের রাশি দেখে চোখের জল সামলাতে পারলাম না। তারপর থেকে আর কখনও বইমেলায় যাওয়ার কথা চিন্তাও করিনি। দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়েছি অনিয়মিত ভাবে আয়োজিত চাইবাসা বইমেলায়--সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছি আদিবাসী-মূলবাসী সম্পর্কিত কিছু ভালো বই ও ফাদার কামিল বুল্কে রচিত ইংলিশ-হিন্দি ও হিন্দি- ইংলিশ অভিধান ও ডাঃ মুন্ডু প্রণীত মুন্ডারি-হিন্দি অভিধান।আজ অবশ্য সেই সংগ্রহের কিছুই আমার কাছে নেই,কলেজ লাইব্রেরিতে দিয়ে চলে এসেছি। আরেকবার,সেও নয়ের দশকের শেষ দিকে শ্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত পশ্চিম বঙ্গ গ্রন্থ মেলায় গিয়েছিলাম ও বেশ কয়েকটি বইও সংগ্রহ করেছিলাম।তবে সেই মেলায় একটি ঘটনা ঘটেছিল যেটির স্মৃতি অন্য সব স্মৃতি ছাপিয়ে আজও মনে গেঁথে আছে। সেই ঘটনাটিই বলি। আমি তো প্রথম স্টল থেকেই কিছু না কিছু বই কিনে চলেছি, আমার বোনের ভাষায় হাবাইতার মতো।তাই খুব তাড়াতাড়িই আমার বাজেট শেষ, এবার নিশ্চিন্ত মনে স্টলে স্টলে ঘুরছি,এমন সময়ে একটি মেয়ে নিঃশব্দে আমার পার্সে হাত ঢুকিয়েছে, বোধ হয় নবীশ,তাই আমি বুঝতে পেরে তার হাতটি চেপে ধরেছি। কিন্তু মেয়েটি অশঙ্ক, আমার চোখে চোখ ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ভগ্নীপতি আমায় বলল- ছেড়ে দিন দিদি, সঙ্গে দলবল আছে। ঝামেলা বাধাতে পারে। অনিচ্ছা সত্বেও ছেড়ে দিতে হলো, কিন্তু মনে একটা ক্ষোভ ছিল যে অন্যায়ের প্রতিবিধান না করে সয়ে যেতে হলো।তবে পরে জরাসন্ধের একটি গল্পের কথা মনে পড়ে মন শান্ত হলো-কে জানে কি পরিস্থিতিতে মেয়েটিকে এই পথে নামতে হয়েছে।আর নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম যে 'আদেখলে'র মতো প্রথমেই বই কিনে টাকা শেষ করে দিয়েছিলাম বলে টাকাগুলোর সদুপযোগ হলো, নাহলে তো সেগুলি 'ন দেবায়,ন ধর্মায়' হত। তাই ঐ গ্রন্থ মেলার বাকি স্মৃতি বিস্মরণের যবনিকান্তরালে চলে গেলেও এটি মনে রয়ে গিয়েছে। যাক এগুলির কোনো টাই কোলকাতা বইমেলা -দর্শনের অভিজ্ঞতার অনুরূপ নয়।
এরপর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে অবসর নিয়ে স্থায়ীভাবে কোলকাতা বাসী হতে এই শতাব্দীর প্রথম দশক প্রায় শেষ। ততদিনে কোলকাতা বইমেলা ও অনেক মামলা মোকদ্দমা রূপী প্রতিকূলতা সামলে, বেশ কয়েকবার ঠাঁই নাড়া হয়ে বাইপাস সংলগ্ন মিলনমেলায় স্থিতু হয়েছে।আমার মাথায় আবার পোকা নড়ে উঠলো এবার বইমেলা যেতে হবে। এখন একা থাকি ফ্ল্যাটে,কেউ নেই বাধা দেবার, এবার আমাকে রোখে কে?না এবার ও বাধা,যাবো কিকরে?বাসে চড়তে পারিনা, যাওয়ার সময় পাওয়া গেলেও ফেরার পথে ট্যাক্সি পাওয়া অসম্ভব।সে অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে গানের ফাংশন শেষে ফেরার পথে অসীম দুর্ভোগ ভুগে। সর্বোপরি ঐ মেলার অতখানি পথ আমার বইয়ের বোঝা বহন করবে কে? আর যদি বইই না কিনি তাহলে মেলায় গিয়ে লাভ কি।তাই সেবার ও মেলায় যাওয়া হলোনা।তবে পরের বার মেলায় যাওয়ার সঙ্কল্প স্থির করে এক দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিলাম ও নিজের সাধ্যানুযায়ী একটি নিজস্ব বাহন কিনলাম ও চালকের পোস্টে নিয়োগ করলাম একটি চালাক চতুর অল্পবয়সী ছেলেকে,নাম সোমনাথ। অবশেষে আমার স্বপ্ন সফল হলো ২০১১তে। পার্কিং লটে গাড়ি লক করে সোমনাথ চলল আমার সঙ্গে। প্রথমেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেট-সজ্জা দেখলাম। বার্ধক্য এক আশ্চর্য জিনিস, প্রথম বারের গেট- সজ্জার পরিকল্পনা ছিল শিল্পী শুভাপ্রসন্নের ও উদ্বোধন করেছিলেন তদানীন্তন রাজ্যপাল ডায়াস সাহেব।কিন্তু এবারের শিল্পীর নাম জানিনা, ভুলে গিয়েছি, শুধু মনে আছে এবারের থীম ইউ.এস.এ. ।তবে সত্যি বলছি বিদেশি সাহিত্য সম্বন্ধে আমার জ্ঞান অতি সীমিত ফলে আগ্রহ ও নেই বিশেষ। আমার সমস্ত আকর্ষণ বাঙলা সাহিত্য ঘিরে,তাও সাহিত্যের খুব উচ্চ মার্গে আমি বিরাজ করিনা। আমার আগ্রহ, ছোট গল্প, উপন্যাস,জীবনী, আত্মচরিত, স্মৃতি কথা, রম্যরচনা, সুখপাঠ্য প্রবন্ধ , স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ও বিশেষ কয়েক জন কবির কবিতা সংগ্রহ।দেশ পত্রিকায় দাগ দিয়ে পছন্দেরবই,লেখক ও প্রকাশনা সংস্থার নাম একটি ছোট নোটবুকে নোট করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। যাইহোক বইমেলার ও আমার যাত্রাপর্বের ইতিহাস তো অনেক হলো, এবারে এলো ভূগোলের পালা,যাতে আবার আমি নেহাত অজ্ঞ,তাই সোমনাথ আমার নোটবুক নিয়ে গেটের পাশে ম্যাপ দেখে দেখে নিজের মনে গন্তব্য পথের একটা নকশা এঁকে নিল। অবশেষে পা বাড়ালাম। কিন্তু এগুবো কি করে!দু'পা যেতে না যেতেই সামনে বিছিয়ে রয়েছে নানারকম ও নানাজনের ছবি,ফটো, গ্রিটিংস কার্ড, পটচিত্রের সম্ভার। আমার চোখ,মন ও পা সব আটকে গেল সেখানে। কিছু খরিদ্দারি হলো, তারপর সোমনাথের ধমক খেয়ে এগোলাম। প্রথম গন্তব্য আনন্দ প্রকাশন। কিন্তু ওরে বাবা এত বড়ো লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে বই কেনার সামর্থ্য আমার নেই, তার থেকে গড়িয়াহাটের আনন্দের দোকান থেকে কেনা যাবে, তার পর ভীড়ে ঠেলাঠেলি করে দে'জ পাবলিকেশন,পত্রভারতী, শেষে নোটবুক রইলো নিজের জায়গায়,আমি যেখানে ভীড় কম দেখি সেখানেই ঢুকে পড়ি ও সর্বত্র ই কেনার মতো কিছু না কিছু পেয়েই যাই। এইভাবে প্রথম বছর ঝুলিতে ভরলাম কৃত্তিবাসী রামায়ণ,কাশীদাসী ও রাজশেখর বসুর মহাভারত, সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার বই,অমলেশ ত্রিপাঠী র স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী পর্বের ইতিহাস, সুকুমার সেনের আত্মজীবনী, পরশুরাম সমগ্র ও ব্যোমকেশ সমগ্র, কুমার প্রাসাদ মুখোপাধ্যায়ের কুদরতে রঙ্গীবিরঙ্গী, সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষের ট্রিলজি। সত্যজিতের শঙ্কু সমগ্র। এবার আমার পার্সের ও আমার পায়ের চলার ক্ষমতা শেষ । আর শেষ সোমনাথের ধৈর্য্য ও ভার বহনের ক্ষমতা । অতঃপর ফুডকোর্টে বসে দুজনের দুকাপ কফি পান করতে করতে কিছু ক্ষণ মেলার "নজারা" দর্শন।এই উৎসব উৎসব ভাব টা কিন্তু সত্যি ই খুব ভালো লাগছিলো, খুব উপভোগ করলাম। শরীর ক্লান্ত হলেও মন অনেক দিন পর খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠলো।১৯৮৩ সনে মেলা প্রাঙ্গণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রী অশোক কুমার সরকারের আকস্মিক প্রয়াণের পরের বছর থেকে তাঁর স্মৃতিতে যে বক্তৃতা মালার আয়োজন করা হয়, সেই বক্তৃতা শোনার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সোমনাথের প্রবল আপত্তিতে সেই ইচ্ছা ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে আসতে হলো আর তার পর পায়ের ব্যথা কম করতে ব্যথানাশক ওষুধের সাহায্য নিতে হলো। শরীরে প্রচন্ড ক্লান্তি অথচ মনে তেমনি স্ফূর্তি,এরকম বৈপরীত্য আগে কখনো বোধ করেছি কিনা জানিনা।এই হলো আমার প্রথম কোলকাতা বইমেলা দর্শন।
এরপর আরো বছর পাঁচেক আমি মেলায় গিয়েছি।যেবার বাংলাদেশ থীম ছিল, সেবার খুব উপভোগ করেছিলাম।ঐ বিশাল প্যাভিলিয়ন আর কতো বইয়ের সম্ভার। বেশ কয়েকটি বই আমি কিনেছিলাম, তার মধ্যে একটি ছিল শ্রীমতী ইলা মিত্রের জীবনী।এই মহীয়সী মহিলার রাজনৈতিক জীবন, তাঁর আত্মত্যাগ, নির্ভীক সাহসিকতা ও চূড়ান্ত নির্যাতনের ইতিহাস কিন্তু এপার বাংলায় সেভাবে চর্চিত হয়নি।কেন? তিনি যে রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, সেই মতবাদে বিশ্বাসীরা এই বাংলায় সংখ্যালঘু বলে? জানিনা, বুঝতে পারি না।যাই হোক ঐ বইটি আমার অমূল্য সংগ্রহের একটি।
এই কবছরে বইমেলা থেকে বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি জিনিসের সংখ্যা ও উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ,সেটি দূরদর্শনের স্টল থেকে সংগৃহীত ক্লাসিক্যাল ম্যুজিক (ভোকাল ও ইন্সট্রুমেন্টাল)এর সিডি।
আরেকটি আকর্ষণ বইমেলার প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন দেখার সুযোগ পাওয়া যায় ও বেশ কিছু সংগ্রহ করা যায়। আমাদের ছাত্র জীবনে পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র সদনের মুক্তমঞ্চে এরকম বহু লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ করে কবিতা পত্রিকা নাড়াচাড়া করার সুযোগ পেতাম।
না! কোনো বার ই আমার কোনো লেখক,কবি , বিশিষ্ট শিল্পী বা পরিচিত বুদ্ধিজীবীর দর্শন ঘটেনি, তার সৈদ্ধান্তিক কারণ আমি স্রষ্টা কে সৃষ্টির মাধ্যমেই জানতে/চিনতে পছন্দ করি, তাঁদের সই সংগ্রহ করতে বা ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হতে পছন্দ করিনা। অল্পবয়সেই করতাম না,এই বয়সে তো প্রশ্নই ওঠে না।আর ব্যবহারিক দিক হলো আমি যে সময়ে মেলা-প্রাঙ্গণে থাকতাম, সেই সময়টা সাধারণত বিশিষ্ট বর্গের ব্যক্তিরা মেলায় আসতেন না। এই কবছরে মেলায় ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তার মধ্যে একটির উল্লেখ করি। একবার কয়েকটি ইংলিশ বই কেনার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি নামী প্রকাশনার স্টলে ঢুকে বইয়ের সারিতে নজর বোলাচ্ছি, সোমনাথ যথারীতি দুই বিগশপার বই নিয়ে কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।সেইসময় একজন সেলসম্যান আমাকে চেঁচিয়ে বলল--এই যে ঠাকুমা এখানে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাওয়া যায় না।
আমি অবশ্য বিশেষ কিছু মনে করিনি,কারণ একেতো পলিতকেশী অতি সাধারণী এক বৃদ্ধা,যার পরণে অত্যন্ত সাধারণ তাঁতের শাড়ি । সর্বোপরি সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না,চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।আমরা মানুষ কে তার বহিরঙ্গ দেখে বিচার করতে অভ্যস্ত। কিন্তু সোমনাথ অত্যন্ত রগচটা, একেবারে তরুণ তুর্কি,সে সমস্ত বই কাউন্টারে রেখে চেঁচামেচি শুরু করে-- দেখুন মাসিমা লক্ষ্মীর পাঁচালি কিনেছেন কিনা?সে এক সীন!অবশ্য স্টলের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী এসে ক্ষমা চাইলেন। আমি এই ব্যবহারে একদম অবাক হইনি কারণ প্রায় তিরিশ বছর আগে আমার মাতৃসমা এক প্রতিবেশিনীকেও অনুরূপ ব্যবহার পেতে হয়েছিল ' ইংলিশ সাহিত্যের ইতিহাস' কিনতে এসে। আমি তো তবু সাধারণ গল্পের বই ই কিনতে এসেছিলাম। অর্থাৎ ত্রিশ বছরেও আমাদের মানুষ বিচার করার দৃষ্টি ভঙ্গি একটুও বদলায়নি। যাইহোক সব ঘটনার একটা ভালো দিক থাকে, তাইতো এতো বছর পরও লেখাটার শীর্ষক ভাবতে একটুও দেরি হয়নি।তবে আমার আচার আচরণের গ্রাম্যতা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নই , বরং আমার এই সাদাসিধে মফস্বলী ভাবটাই ধরে রাখতে বেশি আগ্রহী।
এইভাবে একাদিক্রমে বছর ছয়েক সোমনাথ কে সঙ্গে করে আমার বইমেলা ভ্রমণ চললো। সোমনাথ কে সারথী হিসাবে পেয়ে শুধু বইমেলাই নয়, প্রচুর গানের অনুষ্ঠান শুনেছি, দেখেছি মনপসন্দ বহু নাটক ও সিনেমা। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়েস ও রোগ শরীরের দখল নিতে শুরু করলো, ইতিমধ্যে পরীক্ষা মূলক ভাবে বৃদ্ধাশ্রমবাসী হয়েছিলাম, বছর চারেক আগে ফাইনালি গাড়ি বিক্রি করে, ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে পাকাপাকি ভাবে বৃদ্ধাবাস-বাসী হলাম, এবার শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মন ও স্থবির হয়ে গেল।
এই যাহ্!কখন যেন বেলাইন হয়ে গিয়েছি। এবার বইমেলা দর্শন শেষ করার আগে কিছু নিন্দাচর্চা করে নিই।
আমার নিজস্ব ধারণা বইমেলায় দর্শনার্থীদের একটি বড়ো অংশের বইয়ের সঙ্গে কোনো যোগ নেই, তাঁরা উপভোগ করেন শুধু মেলা। এঁরা শীতের দুপুরে সুসজ্জিত হয়ে বেড়াতে আসেন, বই ছাড়া মেলার অন্যান্য স্টল থেকে টুকিটাকি কেনাকাটা করেন, প্রচুর খাওয়া দাওয়া সারেন, ফটো তোলেন, বড়োজোর বাড়ি ফেরার আগে কোন শিশু পাঠ্য রাইমসের বই কিনে বাড়ি ফেরেন। কারণ বড়ো দের জন্য বই কেনাটা এঁদের কাছে নেহাতই অপচয়।হ্যাঁ,রাইমসের বই,ছড়ার বই নয়। এঁদের কাছে 'জ্যাক এ্যান্ড জিল' 'হাড়টিমাটিমের' থেকে বেশি প্রিয়। অথচ আমার এক অবাঙালি বান্ধবী,যার বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান যেকোনো বাঙালির কাছে ঈর্ষণীয়, অন্যান্যদের বলতো "আর কিছু না হোক, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা শিশু সাহিত্য পড়ার জন্য বাংলা ভাষা শেখা দরকার।" অথচ এদের ভীড়ের ঠেলায় সত্যিকারের বই প্রেমীদের যাতায়াত,মেলা প্রাঙ্গণে চলাফেরা,স্টলে বই দেখা সবেতেই অত্যন্ত অসুবিধা ভোগ করতে হয়।তাই আমার একটা প্রস্তাব আছে যে বইমেলায় প্রবেশ মূল্য থাকা নিতান্ত প্রয়োজন ও সেই সঙ্গে বই মেলার কাছাকাছি একই সময়কালে অন্যান্য দ্রব্যসম্ভার, বিশেষত প্রচুর খাদ্য সামগ্রী নিয়ে একটা মেলা আয়োজন করা নেহাত জরুরি।আরেকটা জিনিসও আমার মনে হয় প্রত্যেক শিল্পীই তার শিল্প কলা দর্শকের সামনে দেখাতে চায়।তাই যদি বইমেলার মতো গান মেলা বা চিত্রমেলা(নানান ধরণের চিত্র) আয়োজন করার পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে।
যাইহোক সম্পাদক মহাশয় বলেছিলেন আমি যা-ইচ্ছে-তাই লিখতে পারি আমার মতো করে,তাই আমার এই যথেচ্ছাচার। কোনো মননশীল, বিশ্লেষণ ধর্মী লেখার ক্ষমতা আমার নেই। কাজেই এই লেখাটি এক ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধার আবোল তাবোল বুকনি হিসাবেই বিচার করবেন আশাকরি।
0 comments:
Post a Comment