সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
বর্ষা,খিঁচুড়ি আর প্রশান্ত
সুব্রত সাহা
তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।আর সেই সঙ্গে বিকট শব্দে মুহুর্মুহু বাজ পড়াও চলছে! না ঠিক একটানা নয়,মাঝে মধ্যে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু হয়ে যাচ্ছে! লাগাতার এই ছিঁচকাঁদুনি আর ভাল্লাগছে না!এই অতিমারীর আবহে দীর্ঘদিন কর্মহীন ঘরবন্দী একঘেয়ে জীবনযাপনের পর সবে একটা নতুন কাজে যোগ দিয়েছে। তেমন বলার মতো কিছু নয় যদিও;ওই সোজা কথায় যাকে বলে অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ সেটাই সে করছে এখন।সাইকেলে করে বিভিন্ন মুদিখানা ও ষ্টেশনারী দোকানে দোকানে ঘুরে অর্ডার সংগ্রহ করা এবং তারপর মহাজনের ঘর থেকে চাহিদা অনুযায়ী সেই সব সামগ্রী সংগ্রহ করে দোকানগুলোতে ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া।এই কাজ করে ওই সামান্য যা কমিশন হিসেবে থাকে তাতে তার আর মায়ের দুজনের সংসার কোনমতে চলে যাচ্ছে।তাদের এই ছোট্ট মফস্বল শহরেও একই কাজে আরও কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। কাজে একটু গাফিলতি হলেই মানে ঠিক সময় মতো অর্ডার নেওয়া এবং অতি সত্ত্বর পাই টু পাই সব মাল ঠিকমতো সাপ্লাই দিতে না পারলেই অন্য যোগানদার কাজটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেবে।তারউপর দোকানদারদের চ্যাটাংচ্যাটাং কথাও হজম করতে হবে,"সময় মতো মাল সাপ্লাই দিতে না পারলে সেই অর্ডার নেন কেন?!শুধু শুধু আমার খরিদ্দাররা ঘুরে যাচ্ছে! আপনি দিতে না পারলে বলে দিন না,আমি অন্য লোককে দেখে নেব।অর্ডার -সাপ্লায়ারের তো অভাব নেই দেশে! "তাই এই সামান্য কাজটাতেও এতটুকু হেলাফেলা করে সময় নষ্ট করার কোনো উপায় নেই। দমদেওয়া কলের পুতুলের মতো ঠিকসময়ে নড়েচড়ে দৌড়-ঝাঁপ করে নিজের কর্তব্য করে আসতে হবে।নইলে নিজের আর তার চিরদুঃখিনী মায়ের বেঁচে থাকার রসদ আসবে কোথা থেকে! তাই শান্তস্বভাবের প্রশান্তও আজ এই বিরক্তিকর বৃষ্টিকে চুপ করে মেনে নিতে পারছে না!বড্ড অসহ্য লাগছে তার।নিজেকে খুব অসহায়ও মনে হচ্ছে! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তার পক্ষে কাজ করা খুব কষ্টকর হয়ে উঠছে। তারউপর সস্তার রেনকোটটাও খারাপ হয়ে গেছে, একটু জোরে বৃষ্টি হলেই আর জল মানাতে পারছে না।ভিজে গায়ে কাজ করতে করতে সর্দি-গর্মি লেগে গেছে। গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মত আবার এই সময়ে রয়েছে সংক্রমণের ভয়।কী যে করবে আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে। মা ঘরে বসে ব্লাউস বানানোর কাজ করে তাকে কিছুটা সাহায্যের চেষ্টা করছিলো,তো এই লক ডাউনের গেরোয় সে কাজেও ভাঁটা পড়েছে,ব্লাউসের অর্ডারও আর কেউ সেভাবে দিচ্ছে না!
বেলা প্রায় ন'টা বেজে গেলো।সেই কোন ভোর রাত্রি থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে! ঘন্টাখানেক আগে বৃষ্টির তোড়টা একটু কমেছিল। তখনই প্রশান্ত তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু সাইকেলটা টেনে নিয়ে বেরোতে যাবে ঠিক সেই সময়েই আবার ভীষণ জোরে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লো।মুহূর্তের মধ্যে তাকে প্রায় ভিজিয়ে দিল।সুতরাং, অগত্যা আাবার ঘরে ফিরে এসে সেই থেকে জানালায় বসে অপেক্ষা করছে বৃষ্টিটা কখন একটু ধরবে, সে দিনের কাজ সারতে বেরোবে।কিন্তু অপেক্ষাই সার!বৃষ্টি থামা তো দূরের কথা একটু ধরারও কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না।শুধু বৃষ্টি হলেও না হয় কথা ছিল,সঙ্গে রয়েছে ওই ভয়ংকর বজ্রপাত!গত দুদিনে বজ্রাহত হয়ে বেশ কয়েকটা প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।এই অবস্থায় মা তাকে কিছুতেই বাইরে বেরোতে দেবে না!কখন যে বেরোতে পারবে, নাকি আজ আর বেরোনোই হবে না কে জানে!এদিকে ভাঁড়ে তো মা ভবানী! অবশ্য আবহাওয়া দপ্তর থেকে পূর্বাভাসে বলাই হয়েছিল পাঁচদিন ব্যাপী এই দুর্যোগ চলবে।তার মানে আজকের দিন ছাড়াও আগামী আরও দুদিন ধরে এরকমই দুরবস্থা চলবে, যদি আবহাওয়া অফিসের কথা ঠিক হয়।আর হবেও মনে হচ্ছে!আজকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাস আর আগের মতো ভুলভাল হচ্ছে না যে!বোধহয় উন্নত যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে আজকাল!এইসব নানারকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাইরের দিকে তাকিয়ে অঝোরধারায় সামনের নারকেল গাছটার মসৃণ পাতার উপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলির অনর্গল পতনসংঘর্ষের পর চতুর্দিকে ছিটকে যাওয়া দেখতে দেখতে কখন যেন আনমনে ছেলেবেলার সেই ফেলে আসা মধুর স্মৃতিবিজড়িত হারানো দিনগুলোতে ফিরে গেছিল, যে দিনগুলোর কথা সে আজকাল আর মনে করতে চায় না,কারণ ওগুলো মনে পড়লেই তার এখন ভীষণ কষ্ট হয়!সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে সেদিনগুলো তার জীবনে একসময় সত্যিই এসেছিলো কিন্তু আজ সেগুলো যেন কোনো অচেেনা অতীত;কোনোদিনই আর তার জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই!
বাবা,মা আর সে মিলে ছিল তাদের ছোট্ট সংসার--প্রাচুর্যে্র সুখ না থাকলেও স্বচ্ছলতার শান্তির কোনো অভাব ছিল না তাদের পুরোনো আমলের দু'কামরার সাদামাটা দালানবাড়িটাতে।শহরের ভীড় থেকে সামান্যই দূরে তাদের বাড়িটা বেশ একটু খোলামেলাই বলা যায়।দালানঘরদুটির সামনে বড়সড় উঠোন এবং পিছনে ও দু'পাশে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে,যেখানে কয়েকটা আম,কাঁঠাল আর নারকেল গাছ ও আছে, তার বাবা-মায়ের নিজেদের হাতে লাগানো ভালোবাসার স্মৃতিচিহ্ন!বর্ডার লাগোয়া কোনো এক গ্রাম থেকে এক ঝড়-বাদলের দিনে তার আপাতনিরীহ অথচ দৃঢ়প্রত্যয়ী মা ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো তার চালচুলোহীন ট্রাক-ড্রাইভার বাবার সঙ্গে ঘর বাঁধবে বলে।বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে শেষে বিথারীর এই জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছিলো নিজেদের সুখের নীড় বাঁধবার জন্য!জ্ঞানলাভের পর থেকে আজ অবধি কখনও কোনো আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় নি।বাবাও কোম্পানির ট্রাক নিয়ে বেশিরভাগ সময়ে বাইরে বাইরেই কাটাত ওই বিভিন্ন পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে মালপত্র ডেলিভারির কাজে।শুধু ওই ঘোর বর্ষার দিনগুলোতেই যখন রোড ব্লক হয়ে যেত ধ্বস নেমে গিয়ে সেই সময়টাতেই বাবাকে কিছুদিন টানা কাছে পেতো।সেই দিনগুলোতে তাদের কী যে আনন্দে কাটতো একসাথে! সে সব তার স্মৃতিতে এখনও অমলিন।সেগুলো ছিল তার জীবনের সেরা মুহূর্ত! বাবার সঙ্গে সে সকালে বাজারে যেতো।এখনও সে বেশ মনে করতে পারে,সবচেয়ে বড় সাইজের পদ্মার ইলিশের মাঝখানটা কিনতো বাবা সুবলকাকার কাছ থেকে। বাবাকে দেখে বাজারের সব মাছওয়ালাদের সে কী ডাকাডাকি!আজও যেনো তার কানে স্পষ্ট বাজছে!বাবা কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে সুবলকাকার কাছ থেকেই মাছ নিত।বলত,"বুঝলি শান্টু, ওই সুবলদা লোকটা বড্ড ভালো। সুবলদা সাহায্য না করলে আজ আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হ'তো না রে।ওই সুবলদাই আমাকে ওই জায়গাটার খোঁজ দিয়েছিল,শুধু তাই-ই নয় মালিককে বলে কিছু টাকা ধার রাখতেও সাহায্য করেছিল। পরে অবশ্য আমি দু'তিন খেপে ওই টাকা শোধ করে দিই।"
ঝিরঝিরে বর্ষার দুপুরে মায়ের হাতে রান্না খিঁচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা খেয়ে শুয়ে শুয়ে বাবার মুখে পাহাড় আর জঙ্গলের নানা গল্প শুনতে শুনতে শান্টু যেন এক স্বপ্নের রাজ্যে পৌঁছে যেতো,যে স্বপ্নের রাজ্যের সে ছিল একমাত্র আদরের রাজকুমার!একেকদিন বাবা ওকে নিয়ে পাশের কাঁদরে মাছ ধরতে যেত ছিপ নিয়ে। বাবা খুব ভালই ছিপ ফেলতে পারতো।কি অনায়াসে টপাটপ মাছ ধরে ফেলতো বঁড়শিতে কেঁচোর টোপ দিয়ে।বড় বড় শোল,তেলাপিয়া ল্যাটা আরও কত রকমের মাছ যে উঠতো তার সবের নাম সে জানে না!ওইসব মাছ বঁড়শি থেকে কায়দা করে খুলে নিয়ে বাবা ওর হাতে দিত আর ও টুপ করে চুবড়িতে রেখে দিত।কি যে আনন্দ হ'তো তা বলে বোঝানো যাবে না! ওই মাছভর্তি চুবড়ি নিয়ে দুপুর গড়িয়েওরা বাড়ি ফিরলেই মা কপট রাগ দেখিয়ে বলতো,"ওই যে ফিরলো বাপ-বেটা বিশ্বজয় করে ধনরত্ন নিয়ে,এবার আমাকে এই অবেলায় মশার কামড় খেয়ে ওগুলোর বন্দোবস্ত করতে হবে!,, আর এই যে শান্ত! বাবাকে পেয়ে যেন সাপের পাঁচপা দেখেছে!পড়াশোনা সব লাটে উঠেছে! সারা দিনরাত বাপের ট্যাঁকে-ট্যাঁকে ঘুরছে দেখো!"
মুখে এসব বললেও মা মনেমনে কিন্তু ভীষণ খুশি হ'তো, তা কাজ করতে করতে মায়ের গুণগণানিতেই বোঝা যেতো।আর হবে নাই বা কেনো?এই তো মাত্র কয়েকটা দিনের সুখের যাপন!বর্ষার দাপট একটু কমতে না কমতেই তো আবার মালিকের জোর তলব শুরু হয়ে যাবে। শান্টুর বাবা আবার পাড়ি দেবে কোনো দূর পাহাড়ের দুর্গম রাস্তায় লোহালক্কড় বোঝাই ভারী ট্রাক নিয়ে জীবন হাতের তালুতে ভ'রে!প্রশান্তও ধীরে ধীরে বড় হ'তে হতে এগুলো বুঝতে শিখছিলো আস্তে আস্তে। ও অতশত না বুঝেও আব্দারের সুরে বাবাকে একবার বলেছিলোও যে, "বাবা তোমাকে আর অতদূরে গাড়ী নিয়ে যেতে হয় না।এখানেই গাড়ী চালাও না কেনো?" শুনে বাবা হো হো করে হেসে উঠেছিল, "হ্যাঁ, বাবা ঠিক বলেছিস, এবার ফিরে এসে আমি এখানেই গাড়ি চালাবো।কিন্তু মুশকিল হলো আমার তো নিজের গাড়ি নেই, মালিকের গাড়ি। মালিক যেখানে পাঠায় সেখানেই তো আমাকে গাড়ি নিয়ে যেতে হয়!আর এই মালিকের বেশির ভাগ কাজই ওই দিকেই।আর আমি তো একা যাই না,আমাদের পাঁচ-সাতটা ট্রাক একসাথে সার দিয়ে যাই,সবাই মিলে যেনো একটা পরিবারের মতো! তাছাড়া দুর্গম পথে যেতে হয় বলে আমরা মজুরিও তো একটু বেশিই পাই বুঝলি।তুই যখন বড় হবি,অনেক লেখাপড়া করে বড় চাকরি-বাকরি করবি তখন আমি আর গাড়ি চালাবো না, কী বলিস শান্টু!" এরকম কত স্বপ্ন যে দেখত তারা মেঘলা বিকেলের আবছা আলোয় দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে বসে তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই!
এভাবেই সুখেদুঃখে,আনন্দে-বিষাদে তাদের দিন,মাস,বছর গুলো কেটে যাচ্ছিলো একরকমভাবে।দেখতে দেখতে প্রশান্তও শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে। হাইস্কুলে ক্লাস টেনে উঠেছে সবে।পড়াশোনাও খুব একটা খারাপ করে না,মোটামুটি ক্লাসের প্রথম দশজনের মধ্যেই সে থাকতো সে।ওরা খুব আশায় বুক বেঁধেছিলো যে ও লেখাপড়া করে খুব শীগগিরই বাবামায়ের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে।কিন্তু হায়! বিধাতা বোধহয় অলক্ষ্যে বসে অন্য কিছুই ভাবছিলেন!
ওর স্পষ্ট মনে আছে সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার, ১৩ই আগস্ট ২০১৯ সাল।স্বাধীনতা দিবসের দুদিন আগে।সিকিমের কোনো একটা দুর্গম জায়গায় কনস্ট্রাকশন সাইটে মাল খালাস করে সঙ্গীদের সাথে ফিরে আসছিলো বাবা।দলে মোট ছ'টা ট্রাক ছিল সেই দলে।বাবা চালাচ্ছিলো পাঁচনম্বর ট্রাকটা।সন্ধ্যায় গাড়ি ছাড়ার মুখে ফোন করে জানিয়েছিল মাকে,কলকাতার অফিসে কিছু কজকর্ম সেরে পরদিন মানে ১৪ তারিখ রাতেই ত৷ তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসবে।শুনে তো ওর আনন্দ আর ধরে না,বাবা এসে তাহলে ক্লাবের মাঠে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ওর সক্রিয় অংশগ্রহণটা স্বচক্ষে দেখতে পাবে। ও এবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের "কুলি মজুর" কবিতাটা আবৃত্তি করবে।
১৪ তারিখ সারাদিন ধরে বেশ কয়েকবার রিহার্সাল করে নিল ও।একটুও ভুলুচুক সে করতে চায় না!আর মাঝে মাঝেই মার কাছে জানতে চেয়েছে বাবা আর ফোন করেছে কি না,কতদূর এসেছে এইসব নানান কথা।কিন্ত প্রতিবারেই তাকে হতাশ হতে হয়েছে।বিকেলে আবার জিগ্যেস করায় মা বলেছিল, " না রে শান্ত,কাল সন্ধ্যেয় রওনা হওয়ার সময় সেই যে ফোন করেছিল,তারপর তো আর কোন কল আসে নি,আমি দুপুরে একবার কল করেছিলাম কিন্তু পাই নি।মনটা বড় খচখচ্ করছে রে!কোনোদিন তো এমন হয় নি। কোথাও দাঁড়ালেই কল করে খোঁজখবর নিয়েছে।আজ যে কী হ'ল কে জানে!" শেষমেশ আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে শান্টু মাকে বললো অফিসে ফোন করে একটা খবর নিতে। অফিসে বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় অবশেষে ফোনটা রিসিভ করলো কিন্তু না করলেই বোধহয় ভালো হ'ত।কারণ লোকটা যা বললো তা শুনে ওদের মাথায় যেন শ্রাবণের গোটা মেঘলা আকাশটাই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো। ফেরার পথে গতকাল মাঝরাতের দিকে একটা সাংঘাতিক বাঁক ঘুরতে গিয়ে তাদের একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গভীর খাদে পড়ে গেছে।খুব সম্ভবতঃ চালক এবং খালাসী দুজনের কেউই আর আস্ত নেই। স্থানীয় লোক এবং পুলিশে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।ম্যানেজার বাবু স্পটে গেছেন। এর থেকে বেশি আর কিছু জানাতে পারবো না বলেই কলটা কেটে দিয়েছিলো।কিন্তু যা বোঝার ওরা বুঝে নিয়েছিলো।
একটা চরম বিপদের আশঙ্কায় সারাটা রাত্রি না খেয়ে না ঘুমিয়ে মা-ছেলে কান্না বুকে চেপে উৎকন্ঠা র প্রহর গুণতে গুণতে ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টির শীতলতায় যখন একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ঠিক তখনই ঘড়াং ঘড়াং ঘট্ করে গাড়িটা এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই ধড়মড়িয়ে উঠে দুজনেই ছুটে গিয়েছিল। ততক্ষণে কয়েকজনে ধরাধরি করে রক্তে লাল হয়ে যাওয়া সাদা কাপড়ে মোড়া একটা তালগোল পাকানো শরীর নামাচ্ছে! দমকা হাওয়ায় মুখের ঢাকাটা একটু সরে যেতেই ওর মুখ দিয়ে অপার্থিব আর্তচিৎকার বেরিয়ে এসেছিল!মুখের জায়গায় যেন একতাল রক্তের জমাট একটা পিণ্ড!মা তো আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হ'য়ে গেছিলো!দেশের স্বাধীনতাদিবসের সকালে অভিশাপের বাদলা হাওয়ার দমক এসে যেনো তাদের সব স্বপ্নকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
কোম্পানির তরফ থেকে কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলো কিন্তু তাতে আর কী হয়!মা সেলাইফোঁড়াইয়ের কাজ ধরলো আর ও মায়ের অমতেও পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে একটা মশলার কারখানায় কাজে লেগেছিল। কিন্তু করোনা এসে আবার সব ওলট-পালট করে দিল।ওর কারখানার কাজটা চলে গেল।এই বর্ষা আর যার কাছেই যত রোমান্টিকতাই বয়ে আনুক না কেন ওর এবং ওর মত অনেক সর্বহারার কাছেই একটা অভিশাপের কাল!এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে ওর চোখগুলো যেন ঝাপসা হয়ে এসেছিল,কখন যে পাক্কা দুটো ঘন্টা পেরিয়ে গেছে জানালায় ঠায় বসে ও টেরই পায় নি।বাইরে তখনও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে, চারদিক ওর চোখের মতোই ঝাপসা।
"শান্তু,এ্যাই শান্তু,বুঝলি বাবা,আজ আর তোর বেরিয়ে কাজ নেই। এমনিতেই দোকানপাট সব বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গেছে। আর এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আবার শরীর খারাপ হলে বিপদের শেষ থাকবে না।তারচেয়ে বরং ফোনে একটু সবাইকার সাথে কথা বলে নে।তারপর স্নাান করে আয়। অনেকদিন পর দুজনে একসাথে বসে খিঁচুড়ি আর বেগুনভাজা খাই!"
হঠাৎ মায়ের কথায় যেন শান্টুর সম্বিৎ ফিরলো।ঝাপসা দুচোখের কোণ বেয়ে পতনোন্মুখ আনন্দাশ্রুর ফোঁটাগুলো মুছতে মুছতে বলল,"হ্যাঁ মা,ঠিকই বলেছো,তুমি সব রেডি কর,আমি এক্ষুনি আসছি! "
0 comments:
Post a Comment