সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
আজকের বাঙালি এতো মূর্খ কেন?
ড. পার্থ ব্যানার্জি
এটা একটা বিরাট সাবজেক্ট। একদিনে একটা লেখায় সবকিছু বলা যাবেনা। খুব সংক্ষেপে বলছি। আপনারা চাইলে আলোচনাটা চালিয়ে যেতে পারেন। তবে, ভরসা নেই বিশেষ কেউ তা করবেন। আমার কথা আমি বলে গেলাম। বাকিটা থাকবে ভবিষ্যতের হাতে।
বেশির ভাগ বাঙালি কোনো কিছু পড়েনা আর। সম্পূর্ণ জ্ঞান ও তথ্যের ভাণ্ডার -- ইংরিজিতে যাকে বলে নলেজ বেস -- তা দাঁড়িয়ে আছে গ্রেপভাইন চ্যাটের ওপর। অর্থাৎ, লোকের মুখে শোনা কথা -- যার কোনো রেফারেন্স নেই, কোনো ভিত্তি নেই। রেফারেন্স বলে যে একটা ব্যাপার আছে, তাই অসংখ্য লোক জানেনা।
যে যা খুশি পোস্ট করছে ফেসবুকে। নিজের লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে কল্পিত বিবেকানন্দের উক্তি চালিয়ে দিচ্ছে। জঘন্য বানানে সেন্টিমেন্টাল, কাঁদুনে আলোচনা করছে, ছবি পোস্ট করছে, আর হাজার হাজার লাইক পাচ্ছে।
এখানে আমেরিকায় যেমন ইডিয়েটদের হাতে বন্দুক আছে, আর তাই দিয়ে এই সব অশিক্ষিত ইডিয়েটরা যত্রতত্র মানুষ মেরে ফেলে, আমাদের দেশে তেমনই এখন মূর্খদের হাতে সোশ্যাল মিডিয়া আছে, আর তাই দিয়ে মানুষের মনকে মেরে ফেলে দিবারাত্র। যারা প্রশ্ন করে, চ্যালেঞ্জ করে, ভুল ধরিয়ে দেয়, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কথাবার্তা বলে, তাদের কুৎসা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, বা সবার সামনে অপমান করে শুইয়ে দেয়। বেশির ভাগ সময়ে এই অপমান ও কুৎসা সহ্য করতে না পেরে মানুষ সরে যায় আলোচনা থেকে। এবং মূর্খরা ও হিংস্ররাই জিতে যায়।
আমার মনে আছে অনেক উদাহরণ, যেখানে আমি বাঙালিদের হাতে এই ভার্বাল ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছি। না, এরা সবাই মোদীপন্থী হনুমান ব্রিগেড নয়। ল্যাজ খোঁজার জন্যে এখন আর শুধু গেরুয়াবাহিনিকে দোষ দিইনা। এর মধ্যে কংগ্রেস আছে, কমিউনিস্ট আছে, তৃণমূল আছে, রাজনীতি করেনা এমন লোকজন বিস্তর আছে। হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান আস্তিক নাস্তিক সব আছে। এদের মধ্যে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর, কেউ স্কুল শিক্ষক বা শিক্ষিকা। কেউ ওদেশে থাকে, কেউ বা এদেশে।
দুটো তিনটে উদাহরণ দিচ্ছি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। খুব জনপ্রিয় একটা কলকাতার বাঙালি গ্রুপে এই তিনটে অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। (১) বলেছিলাম, উত্তমকুমারের বেশির ভাগ ছবি না হলেও কোনো ক্ষতি ছিলোনা। (২) বলেছিলাম, জামাইষষ্ঠী একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রথা। এবং (৩) বলেছিলাম, শোলে একটি বাজে এবং হাস্যকর ফিল্ম। একসঙ্গে বলিনি, অনেক দিন পর পর প্রসঙ্গ এসেছিলো, তাই বলেছিলাম। এবং একটাও খারাপ শব্দ ব্যবহার করিনি, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি, এবং কোনো নিয়মকানুন ভঙ্গ করিনি। কিন্তু শুরু হলো এক পর্ব!
তারপরের কয়েক সপ্তাহ রাতে ঘুমোনোর সময়ে মনে হতো, আমি খাট থেকে খানিকটা উপরে উঠে ভেসে আছি, আর চতুর্দিক থেকে অসংখ্য লোক আমাকে ঘিরে হাসছে। কেউ কেউ লাফাচ্ছে, আর চিৎকার করছে। সে এক দুঃস্বপ্ন!
এমন কী, বাড়িয়ে বলছিনা -- কারণ আইনজীবীর কাছে যেতে হয়েছিল। ডেথ থ্রেট পর্যন্ত এসেছে এইসব কথা লেখার জন্যে। আর একবার এরকম হয়েছিল আমেরিকার পশ্চিমি বাঙালিদের হাস্যকর দুর্গাপুজো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। অন্যদের কাছে শুনেছি, সূর্যগ্রহণ নিয়ে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কথা বলতে গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর কাছে অতি শান্ত, ভদ্র গৃহবধূকে এই সেদিন একঘরে করে দিয়েছে একদল বাঙালি। "শিক্ষিত" বাঙালি তারাও।
অর্থাৎ, কোনো চ্যালেঞ্জ করার জায়গা বাঙালির মনে আর নেই। এই প্রশ্নহীন আনুগত্য -- সে উত্তমকুমারই হোক, জামাইষষ্ঠীই হোক, সূর্যগ্রহণ, বা শোলে। এই জিনিষ আগেও ছিল, যখন কলকাতায় থাকতাম, তখনও এই অন্ধ আনুগত্য দেখেছি -- মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল নিয়ে, বা হেমন্ত-মান্না নিয়ে। বা কংগ্রেস সিপিএম নকশাল। কিন্তু সত্তরের দশক থেকে এসব মাত্রাছাড়া হতে আরম্ভ করেছে।
এর মধ্যে গত তিরিশ বছর সম্পূর্ণ মগজধোলাই হয়েছে টিভির মাধ্যমে, যেখানে একটা খবর বা একটা মতামতকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে, প্রশ্ন করার জন্যে কোনো জায়গা দর্শককে, শ্রোতাকে দেওয়া হয়নি। রেডিওর সময়েও কিছুটা তাই ছিল, কিন্তু তখন গণমাধ্যম কিছুটা পেশাদারিত্ব বজায় রাখতো। সরকারি চ্যানেলে হয়তো ইন্দিরা গান্ধীর বা নেহরুর ভজনা করা হতো, কিন্তু একটা ব্যুরোক্রেসি ছিল বলে যে যা খুশি বলতে পারতোনা। একটা বৈধকরণ, একটা রিসার্চ, তথ্য যাচাই করা এসব ছিল। মিডিয়ার সম্পূর্ণ প্রাইভেটাইজেশনের যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে খবর, তথ্য এবং তথাকথিত বিশেষজ্ঞের মতামত ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
তারপর এসেছে আমেরিকার ঘরে ঘরে মেশিন গানের মতো দেশের ঘরে ঘরে সোশ্যাল মিডিয়া- ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম।
0 comments:
Post a Comment