সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
জোড়-বিজোড়
শৈবাল চক্রবর্তী
আজ আচমকাই অমিয়র সাথে মিহিরের দেখা হয়ে গেল। অফিস ছুটির পর গাড়ির জট কাটিয়ে যখন মিহির বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছে, একটা ক্যাব প্রায় গায়ের উপর এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু বলার আগেই পিছনের দরজা খুলে মধ্য তিরিশের মাঝারি উচ্চতার কেউ নেমে জড়িয়ে ধরলো তাকে। -- "মিহিইইর নাআ?!"
মিহিরের ন্যাংটাবেলার বন্ধু এই অমিয়। প্রায় পনেরো বছর আগে, জীবিকার তাগিদে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিল। আজ আবার ধূমকেতুর মত হাজির হয়ে যখন আবদার করল-- "চল কোথাও বসি", মিহির এড়িয়েই যেতে চাইছিল তবু পারল না। কথায় কথায় সেন্ট্রাল এভিনিউ কফি-হাউসের কাছেই একটা পানশালায় এসে উঠল। চাঁদনিচক পাড়ায় অফিস হওয়ার সুবাদে মিহিরের এখানে টুকটাক যাওয়া আসা আছে।
চেয়ার টেনে বসেই অমিয়র
ঘোষণা, -- "দ্য ট্রীট ইজ মাইন!" তারপর লম্বা শ্বাস ছেড়ে হেঁকে উঠল, --"ওফ! কত্তো
বছর পরে দেখা, লেকিন ঠিক পহেচনা।" মিহির স্মিত হাসে। অমিয়কে ভাল করে দেখে। সেই
ডাকাবুকো ছেলে। আজ চোখে বাহারি ফ্রেমের চশমা, গায়ে ব্রাণ্ডেড টিশার্ট, হাতে
দামী ঘড়ি, বহুমূল্য আঙটি, ত্বকে মসৃণতা। অমিয়র উচ্ছ্বাসের
বাহুল্যে মিহিরের অস্বস্তি কিছু কমে। বুঝতে পারে, আজ
ফিরতে দেরী হবে। অমিয় যতক্ষণে খাবার অর্ডার দেয়, মিহির নীপাকে দেরী হবার কথা
টেক্সট করে জানিয়ে দেয়। তারপর ধীরেসুস্থে জিজ্ঞাসা করে--"কবে এলি,...... কোথায় উঠেছিস?"
--"কাল রাতে। ভি.আই.পি. রোডে.....রিগ্যাল গেষ্টহাউস। প্রচুর
কাজ, বুঝলি। বিজনেস ম্যাটার্স।" বলে অমিয় চারপাশটা একবার দেখে নেয়।
মিহির মনে মনে প্রস্তুত হয়। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আবদার করলে যে করে হোক কাটাতে হবে। সুবিধে হল পুরোনো পাড়ায়
সে আর থাকে না। অবশ্য অমিয়র রকমসকমে মনে
হয় এ'পাড়ার কোনো খবরই সে রাখে না। সেই কবে মুম্বাই গিয়ে গুছিয়ে বসেছে। কি একটা মাঝে ঘটেছে, তা নিয়ে গিঁঠ বেঁধে নিশ্চয় এখনো থেমে নেই। জীবন কারো থেমে
থাকেনা। আশঙ্কার চিনচিনে ভাবটা কমে। আরাম বোধ হয় মিহিরের। অন্য এক ভাবনা মাথায়
ছড়ায়। অমিয় কাজে এসেছে। কিছু কাজ তো তারও হতে পারে। বন্ধু অর্থবান হলে ক্লায়েন্ট
হতেই বা কতক্ষণ।
এবার খাদ্য, পানীয় দুই হাজির। অমিয় চটক
ভাঙায় --"কি বস, কি এত ভাবছ?" মিহির মাথা নাড়িয়ে বলে-- "তুই তোফা আছিস। আমায় দেখ, চাকরির পাশে আবার ইন্সিওরেন্সের দালালি। বাজার দেখছিস! বিয়ে,
বাচ্চা, স্কুলের ফী,
ফ্ল্যাটের ইন্সটলমেন্ট.... খরচার কোনো মা বাপ নেই রে।" মিহির যেন ছিপ ফেলে।
ফিস-ফ্রাইতে একটা বড় কামড় বসায় অমিয়। তারপর লম্বা
চুমুক দেয় গ্লাসে। আনমনে বলে ওঠে --
"তবু
তো আপনজনের কাছেই আছিস। সেই যে চলে গেলাম সব ছেড়ে। কতগুলো বছর। মুম্বই-বস্তি,
রদ্দিঘাট, সস্তার বড়াপাঁউ। অনেক রগড়েছি।" অমিয়র স্বর ঝিমিয়ে আসে।
মিহির বলে-- "কিন্তু আজ তুই বড়
বিজনেসম্যান।"
ডান হাত ছড়িয়ে অমিয় হাঁকে --
"এয়াঃ! তোর বিজনেসম্যান..... "টেবিলের উপর ঝুঁকে বলতে থাকে-- "কি না করেছি,
হোটেল-বয়, মাল ফেরী, ডাব্বাগিরি,
জুয়াবাজি!
মিহির শোনে। -- "তারপর?"
-- "ওখানে রুপিয়া হাওয়ায় ভাসে, ধরতে জানা চাই। ফির ওহি রুপিয়া লাগাও, ফায়দা উঠাও ঔর উঠাতে যাও।" দম নিতে থামে অমিয়। গলাটা ভিজিয়ে গ্লাস খালি করে। আবার নতুন পেগ আসে।
মিহিরের চোখ এবার উজ্জ্বল। হাল্কা মনে গ্লাসে চুমুক দেয়। আরো শুনতে চায় টাকার
ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
--"তুই এক কাজ কর। এসব চাকরি, ছোটামোটা দালালিতে কিছু হবেনা। স্টক-মার্কেটে টাকা লাগা। "আন্তরিক শোনায় অমিয়কে। --"মার্কেট আমার গুলে খাওয়া।" ইশারায় মিহিরকে কাছে ঝুঁকতে বলে।--"আমার নিজের দশ বড়াপেটি এখানে খাটছে।
বন্ধুবান্ধবদের পঁচিশ। প্রফেশনাল লোক আছে দেখভালের জন্য। আমার ফাণ্ডে দশ-বিশ
লাখ জমা কর। আন্ডা পাড়তে টাইম লাগবেনা।"
মিহিরের পুলক জাগে। ভাবে এখন শুধু বুঝিয়ে কাজটা তোলা। এবার বলেই ফেলে। -- "অত টাকা আমার কই ভাই। তুই বরং আমার একটা উপকার কর। একটা বড়
লাইফ ইন্সিওরেন্স বানা। দারুণ সব পলিসি আছে। তুই তো ক'দিন
আছিস। কালই সব বুঝিয়ে দেব।"
অমিয় চুপ। মিহিরও থমকায়। ঠিক তখনই হই হই করে হেসে ওঠে অমিয়।--" আমার লাইফ ইন্সিওর করবি? মরলে
শালা নেবে কে? বৌ তো বিয়ের দু'বছর পরেই ভেগেছে। মালকড়ি, গয়না
সঙ্গে নিয়েই গেছে। ছানাপোনাও নেই।...........
সত্যি তুই জানিস না কিছু?!
--"আবার বিয়ে কর।" মিহির একটু তুতলে যায়।
--"তোর ইন্সিওরেন্সের জন্য? হাঃ হাঃ হাঃ ......... ফোট শালা,
দিব্বি আছি! কোনো সওয়াল জবাবে নেই।"
আবার চুপ। সময় যায়। দুজনেই গ্লাসে চুমুক দিতে থাকে।
--"একটা থাপ্পড়ের অনেক দাম
দিতে হল।" অবশেষে ধরা গলায় অমিয় বলে। -- "আমি জুয়াড়ি, টাকার ভুখা, দুনম্বারি,
শুনতে শুনতে ক্ষেপে গিয়ে
একদিন...... এই মিহির! তুই তো জানতিস, পাড়াতেও সবাই জানত, ও
তো রাজি ছিল। ওকে বলেই তো গিয়েছিলাম। যেটুকু কামাতাম, বাঁচিয়ে
বাড়িতে আর ওকে খরচাও পাঠাতাম। ফের একদিন ফোন করে প্লেনের টিকিট পাঠালাম। চলেও এলো।"
চুপ করে যায় অমিয়। পরপর দুটো হেঁচকি তোলে। ফের শুরু করে, --"সচ বলবি মিহির, তুই
ওকে খুব পছন্দ করতিস। ও কি তাই করত?
আমি বুঝতাম। তাহলে আমার
কাছে কেন যে গেল?"
মিহির চুপ। নরম আলোয় ঘরটা যেমন,
ওর তার থেকেও বেশী অন্ধকার
লাগে।
অমিয় খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে। তৃতীয় পেগটাও শেষ। -- "ঝুট! বকওয়াস
সব!" বলে ঝুঁকে আচমকাই মিহিরের
শার্টের হাতাটা খামচে ধরে হিসহিসিয়ে ওঠে --"আমার বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে দিব্বি সংসার করছিস আবার আমারই থেকে দালালি কামাবার
ফিকির। তেরা তো জবাব নহি!"
এতক্ষণ যত্নে যে তাসের ঘর তৈরি হচ্ছিল, দমকা
হাওয়ায় সব ছত্রখান।
এক ঝটকায় হাতাটা ছাড়িয়ে নেয় মিহির। ফুঁসে ওঠে, -- " নীপাকে আমি ভাগিয়ে আনিনি অমিয়। তোর ব্যবহারে আর ভুলভাল
লোকেদের আনাগোনা, খারাপ ইঙ্গিতে অতিষ্ঠ হয়ে
চলে এসেছে। যে কোনো দিন দুর্ঘটনা ঘটত। তুই তখন টাকার নেশায় বেহুঁশ। তখন একটা
সন্তান খুব করে চাইত। একটা অবলম্বন। অথচ বাচ্চা হচ্ছেনা বলে তুই ডাক্তার দেখাতে
পর্যন্ত যাসনি। উলটে নেমকহারাম বলে গাল দিয়েছিস। উত্তর আছে কোনো?........ হ্যাঁ, কিছু
টাকাপয়সা সঙ্গে করে ও এনেছিল দিন চালানোর জন্য। নিজের বাড়িতে ফেরেনি, মুখ ছিল
না। এক বন্ধুর সাহায্যে লেডিজ হোস্টেলে কাটিয়েছে।
ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজে বেড়াত। আমার সাথে পথেই একদিন দেখা।........ আর হ্যাঁ,
ওকে আমি অবশ্যই পছন্দ
করতাম। তাতে কি? নীপার চোখে তখন তুই হিরো।
তোকে ঘিরে রঙিন স্বপ্ন। তোর কাছে যাওয়া রুখবে সাধ্য কার। আমি চেষ্টাও করিনি।" উত্তেজনায় হাঁপায় মিহির, বলা থামায় না, -- "দালালির কথা বলছিলি না? ওটা আমার পেশা। তোর পয়সা
আছে তাই প্রোপোজাল দিয়েছি। নীপার
কথা তুলি নি কারণ তোর নাটক আর চালাকিতে ঠকে গেছিলাম। তুই খোঁজ নিয়ে, জেনে বুঝেই আজ এসেছিস। শেয়ারবাজারের টোপ! আমার জমা-পুঁজি যাতে সব যায়।"
অমিয় চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসা। দুই হাত বুকের কাছে জড়। চোখ বন্ধ। ঘন শ্বাস বইছে
উভয়ের।
অমিয় ধ্যান ভেঙ্গে নড়ে উঠল এবার। কোলের উপর থেকে একটা ফোলিও ব্যাগ টেবিলে তুলে
রাখল যেটা আসার সময় ওর বাঁহাতের কব্জি থেকে ঝুলছিল।
--"এতে কি আছে জানিস?" খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল।
--" নাঃ" সাপটা উত্তর মিহিরের। বিরক্তিতে বলে,--"চল, এবার
ওঠা যাক।"
--"আরে ইয়ার, এত জলদি কিসের? নীপাকে
টেক্সট কর, বন্ধুর সঙ্গে আছিস। শোন না, দ্যাখ,
এই ব্যাগটা আমি সব সময়
ক্যারি করি। এতে একটা চেকবই,
লাখ দুই ক্যাশ, এক প্যাক তাস আর.......... একটা নাইন এম.এম. সেমি-অটো পিস্তল আছে।.......... লাইসেন্সড।"
-- "তুই আমায় ভয় দেখাচ্ছিস! ফাঁদ পাতছিস অমিয়?"
একটু নার্ভাস লাগে
মিহিরের।
--" যারা বেইমান, তাদের কাছে আমি শয়তান।" ধকধক করে ওঠে অমিয়র চোখ। পরক্ষণে সুর পালটে যায় -- "আচ্ছা বেশ ভাই। নো ইস্যুস। চল, তুই আমার বড়
ইন্সিওরেন্স বানিয়ে ফেল।"
যেন কিছুই হয়নি, এমন স্বরে অমিয় বলে। --"দেখ, আমি একজন জুয়াড়ি। বাজি ধরা
আমার রক্তে। তাস আমার সঙ্গেই থাকে। আই ওয়ান্ট টু গিভ ইউ আ ফেয়ার চান্স। আয় দোস্ত, একটা বাজি খেলি। পঞ্চাশ লাখ চেক কেটে রাখছি। তুই জিতলে ইন্সিওরেন্স বানা আর আমি
জিতলে নীপা ফেরত যাবে।"
মিহিরের ঘাড় বেয়ে শীতল স্রোত নামে। বুঝতে
পারে অমিয়র প্ল্যান। দুর্বল স্বরে বলে, --" আমি এ'সবে নেই।"
অমিয় কিছু একটা ভেবে প্রসঙ্গ পালটায়। বলে --"আচ্ছা, তোর ছেলেটা কত বড় হোল রে?......... নীপা, ও
কি দেখতে একই রকম আছে?...........
ওদের খুউব ভালবাসিস তুই।
শুধু দ্যাখ, আমি কোথাও কোনো এলবামে
নেই।
মিহির কেঁপে যায়। দুর্বল গলায় বলে,-- "অমিয়,
আর ভাল লাগছেনা, আমায় এবার উঠতে হবে।"
--" ইয়েস বস, চলো উঠবো। নীপা
ওয়েট করছে। খেলাটা একটুখানি মডিফাই করি। তুই তাসের বাজি শুনে চিন্তায় পড়েছিস। শোন, ভাবলাম জিনিষটা তোর জন্য আরো ইম্প্রেসিভ আর ফেয়ার হোক। ওই পঞ্চাশ
লাখ তোর নামে সোজা চেক কেটে রাখছি। তারপর চল, বিল মিটিয়ে নীচে নামি।
গাড়ির রেজিস্ট্রেশন
নাম্বারের উপর জোড়-বিজোড় খেলব। তিনবার ব্যাস! দূর থেকে গাড়ি দেখব, তখনই
একবার তুই বলবি, একবার আমি বলব। কাছে এলে
মিলিয়ে নেব। যার বেশি ঠিক,
সে জিতবে।"
ব্যাগ থেকে চেক বই বার করে লিখতে থাকে অমিয়। খসখস করে সই করে। --"দেখে নে ভাই।"
সামান্য সময় পরে বিল মিটিয়ে দু'জনে নীচের ফুটপাথ কিনারে
এসে দাঁড়ায়। মিহির যন্ত্রবৎ। সামনেই দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার জানে, এখানে ভালো খদ্দের পাবে। অমিয় মিহিরকে বলে, -- "রেফারি লাগবে একজন।" তারপর প্রথম ট্যাক্সিচালককে ডেকে বলে, -- "ভি আই পি রোড, হলদিরামের
কাছে যাব।" ড্রাইভার হ্যাঁ বলতেই বলে, -- "দশ মিনিট দাঁড়িয়ে একটা খেলা খেলব, তুমি রেফারি। একশ টাকা এক্সট্রা। সব শুনে বুঝে ড্রাইভার
ভারি আমোদে মিটার ডাউন করে,
যেন খেলা শুরুর ঘণ্টা।
বাজির খেলা শুরু হয়ে এবার শেষের মুখে। শেষ জোড়-বিজোড়
বলার পালা অমিয়র। ভুল বললে তাকেই হারতে হবে। ভিক্টোরিয়া হাউসের স্টপ ছেড়ে একটা
প্রাইভেট বাস আসছে। তাকে চিহ্নিত করা
হল। এগিয়ে আসছে কিন্তু অমিয় কিছু বলছেনা।
মিহির উদগ্রীব। একি! কাছে এসে গেছে, সব এমনিই দেখা যাবে যে। অমিয়টা পাক্কা শয়তান। ড্রাইভারটাকেও
ঘুষ দিয়ে হাত করেছে। অশান্ত মিহির ঘোরে প্রতিবাদের তাড়ায় আর তখনই অমিয় হেঁকে ওঠে --"জোড়া!"
বাসটা এবার একেবারে সামনে। উৎকণ্ঠায় মিহির নাম্বার দেখতে টাল খেয়ে যায়। ঠিক তক্ষুনি ওর
পকেটে চেকটা গুঁজে ট্যাক্সির দরজা খুলে অমিয় বলে -- "চল।"
বিস্মিত ড্রাইভার স্টার্ট দিতে দিতে বলে ওঠে, --"নাম্বার তো দেখাই যাচ্ছিল প্রায়!"
মিহিরের বিমূঢ় ভাব কাটে অন্য ট্যাক্সিচালকের ডাকে। --"যাবেন?"
ক্লান্ত শরীরটাকে দরজা
খুলে সে ছুঁড়ে দেয় সীটে। --
"কাঁকুড়গাছি।"
একটু পরে, বুকপকেটে গোঁজা চেকটা
আস্তে আস্তে কুচিয়ে বাঁ হাতের মুঠো খুলে জানালায় রাখে মিহির। ফরফর করে বাতাসে উড়ে
যায় শূন্যগুলো আর মানব জীবনে
জোড়-বিজোড়ের জটিল অঙ্ক।
0 comments:
Post a Comment