সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
শীত মরশুমের দেশজোড়া উৎসব আমাদের পরম্পরা
শুভাশিস ঘোষ
ক'য়েক দিনের অতিথি হলেও এসেই পড়েছে শীত। উত্তর কিম্বা উত্তর-পশ্চিম ভারতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডার আমেজ না থাকলেও আছে আদর মাখানো শীতের পরশ। হিমেল হাওয়ার সাথেই বয়ে এনেছে নলেন গুড় আর পিঠে পুলির গন্ধ। হরেক উৎসবের বার্তা। পার্বণ আর মেলার আবহ বয়ে এনেছে পৌষ। ডাক দিয়েছে দেশ জুড়ে উৎসবের মরশুম। ফসলের উৎসব, শস্যের উৎসব। প্রায় সমগ্র ভারত জুড়ে শস্য কেন্দ্রিক উৎসবের এই মরশুমের পরতে পরতে জুড়ে আছে এ দেশের ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, লোকাচার। ফসল যেখানে প্রধান বিষয় আর কৃষক হল কেন্দ্রীয় চরিত্র, এমনই এক দেশজোড়া মরসুমী উৎসব। প্রদেশ, জনগোষ্ঠী, ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু ইত্যাদি ভেদে উৎসবের নাম এবং বহিরঙ্গের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন হলেও এই উৎসবের চালিকা শক্তি কিন্তু অভিন্ন। কৃষি আর কৃষক - কর্ম এবং কর্তা। এদের ব্যতিরেকে এ মরসুমের উৎসব যেমন অর্থহীন, তেমনই কৃষির সাফল্য এবং কৃষকের হাসিমুখ ছাড়া এ দেশের অগ্রগতিও যে নেহাতই খঞ্জ তা বোধহয় অপেক্ষা রাখে না বলার।
হিমালয়ের বরফ গলা জলে পুষ্ট নদী গুলির তীরেই গড়ে উঠেছিল এ দেশের প্রাচীন সমস্ত জনপদ। আর সেই সব জনপদই এ দেশের কৃষি ভিত্তিক সভ্যতার ইতিহাস। ভরা শীত ই কৃষকের ঘরে ফসল তোলার মরশুম। আর মাঠের ফসল ঘরে তুলে উৎসব পার্বণে মেতে ওঠার রীতিও এদেশে বহুদিনের। প্রাচীন ভারতের আর্যাবর্ত থেকে দাক্ষিণাত্য - সব জনপদে ই ফসল-উৎসবের মরশুম ছিল এই সময়টা। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায় পৌষের শেষ আর মাঘের শুরু, দেশ জুড়ে কেবলই উৎসব। কৃষকের খামারে, গোলায় বান ডাকত ফসলের আর খুশির বান ডাকত গ্রামীণ সমাজজীবনে। সেই সংস্কৃতি আজও বহমান।
পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ সহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখন্ড জুড়ে শুরু হবে লোহরি, কোথাও বা মাঘি। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় , ত্রিপুরা সহ দেশের বড় অংশে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। দক্ষিণ ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠী পালন করবেন পোঙ্গল। উত্তর- পূর্বের অসমে চলবে মাঘি বা ভোগালী বিহু। মহারাষ্ট্রে তিলগুল, কর্নাটকে ইল্লু বিল্লা। অন্ধ্রপ্রদেশে এমন দিনে পালিত হবে পেড্ডা।
বাংলার পৌষ সংক্রান্তির আচার অনুষ্ঠান নতুন করে বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই পার্বণ। এ উৎসব ছিল প্রাচীন বাংলায় ধনলক্ষ্ণীর আরাধনা। তখন শস্য ই ছিল প্রধান ধনসম্পদ। তাই ঘরে নতুন শস্যের আগমন আসলে লক্ষ্ণীর আগমন বলেই মনে করত বাঙালি। সেই উপলক্ষে উৎসব - পৌষপার্বণ। যে উৎসবের পরতে পরতে ছিল প্রাণের পরশ। যাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে ফসল আসে ঘরে, সেই মুনিশ মজুররা যত্নসহকারে আপ্যায়িত হত এই পার্বণে। কৃষকের দালানে পাত পেড়ে নবান্ন আর পিঠে পুলির পরিবেশন ছিল অন্যতম প্রধান বিষয়। আজও পৌষের শেষের এই উৎসবে একুশ শতকের নব্য বাঙালির এতটুকু নেই উৎসাহের অভাব।
উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পালিত হয় লোহরি। এ উৎসব ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সব অংশের মানুষের এক সামাজিক মিলন অনুষ্ঠান। নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দে পালিত হয় লোহরি। মতান্তরে সূর্যের দক্ষিণায়নের শেষ এবং উত্তরায়নের সূচনা কে স্বাগত জানাতে পালিত হয় এই অগ্ন্যুৎসব। তীব্র শীতের অবসান কল্পে দীর্ঘতর দিনের কামনায় খামারের নতুন ফসল , মূলতঃ ভূট্টার আহুতি দেওয়া হয় আগুনে। এ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নাচ গান।পাঞ্জাব,হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশের শিখ, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে পালন করে লোহরি। এমনকি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো পালিত হয় এ উৎসব। উৎসবের দিন কিন্তু অভিন্ন। পৌষ সংক্রান্তি।
অসমের প্রধান উৎসব বিহু পালিত হয় বছরে তিন বার। ফসল ওঠার পর পৌষ সংক্রান্তিতে শুরু হয় মাঘ বিহু, যা ভোগালী বিহু নামেও পরিচিত। নতুন শস্য 'ভোগ' করার উৎসব ই ভোগালী। নদীর তীরে গ্রামের যুবকরা তৈরি করে নতুন ফসলের বিচালি দিয়ে ভেলাঘর, তার পাশে রাত্রে মেজি (আগুন) জ্বালিয়ে বাদ্য সহ বিহু গান আর নাচ। পিঠে তৈরি আর পংক্তিভোজ চলে তিন দিন ব্যাপী। ভোগালী বিহুর অন্যতম অনুষঙ্গ জলাশয়ে মাছ ধরা, পশুর লড়াই। অন্যের ক্ষেতের শস্য চুরি করার রীতিও আছে এই বিহু তে। তাই ভোগালী বিহুকে চোর বিহু ও বলা হয়। পৌষ সংক্রান্তিতে শুরু হওয়া এ উৎসব চলে তিন দিন।
দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই শস্য কেন্দ্রীক উৎসব পালনের রীতি বহু যুগের। উৎসবের নাম, আচার, অনুষ্ঠানে ভিন্নতা থাকলেও উপলক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন, ফসল ই হলো উৎসবের কেন্দ্রীয় উপাদান।
সময়ের সাথে পাল্টেছে মানুষের জীবন যাত্রা। জীবন যাপনে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। গতির সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হারিয়েছে অনেক কিছুই। অনেক আবেগ, অনুভূতির অপমৃত্যুর অভিযোগও ওঠে অহরহ। তার অনেকটাই অসত্য নয়। কিন্তু অনেক ঐতিহ্য, পরম্পরাকে আজও ভারতবাসী জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আধুনিকতার নামে বলি দেওয়ার কথা কল্পনাও করে না ভারতবাসী। তেমনই এক ঐতিহ্য শীতের মরশুমের এই দেশজোড়া উৎসব।
2 comments:
চমৎকার লিখেছেন। দেশজুড়ে শীতকালীন উৎসব ছোট্ট পরিষরে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। শেষটাও করেছেন ভারি সুন্দর করে। অনেককিছুই জানলাম নতুন করে।
ধন্যবাদ। ভালো লাগলো আপনার মূল্যবান মতামত।
Post a Comment