সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

28,047
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 প্রজাপতির ডানা

  শিশির পাল


ভিডিও কনফারেন্স সেরে নিজের ডেস্কে এসে অরিন্দম দেখল এখনও অনেকগুলো নোটস সাইন করতে হবে।একটা পাঁচ কোটি টাকার রাইস মিল লোন প্রপোজাল পড়ে আছে সকাল থেকে। সময় করে এখনও চেক করা হয়নি। সকাল থেকেই একটা অদ্ভুত অস্থিরতা। পুজো সংখ্যায় লেখার জন্য অন্তত পাঁচটি বড় পত্রিকার আমন্ত্রণ এসেছে এই ক'দিনে। সবাই উপন্যাস চায় এবার। কখন লিখবে এত । অফিস আর লেখালেখি করতে করতে সংসারটাকেই বড় অবহেলা করা হয়ে যায়। লেখা ওর প্যাশনে। পেশা ওর দায়বদ্ধতায় । এ এক সূক্ষ্ম ব্যালেন্স। ভুল হলেই অনেক কিছু এদিক ওদিক হয়ে যায়। আজ ছেলে অভির জন্মদিন। ওকে ডিনারে ভালো কোনও রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে হবে। ওর আব্দার সকালেই জানিয়ে দিয়েছে । যেতেই হবে। গাড়ি নিয়ে গেছে রতন। ওরা বোধহয় এসে গেল বলে।ঘড়ি দেখে অরিন্দম। আটটা। মোবাইলে রিং।

“আমরা এসে গেছি। নেমে এসো। ঐতিহ্য ও প্রান্তে।”

“এক মিনিটে আসছি।”

লিফটে নামতে নামতে , হোয়াটসআপ  গ্ৰুপের মেসেজ চেক করে অরিন্দম।

নেমে এসে দেখে গাড়িতে বসে আছে ঐতিহ্য। অভি মা'র সঙ্গে গা ঘেঁষে। হাসি মুখ। অভি খুশি।অরিন্দম রতনকে বলে, “চলো, হোটেল ডাউন টাউন।”

বর্ধমান শহরের মধ্যে এটা বেশ ভালো রেস্তোরাঁ। রতন কার্জন গেটের দিকে গাড়িকে ঘোরায়।অরিন্দমের অফিস সংস্কৃতি লোকমঞ্চের পাশেই, মিউনিসিপ্যালিটি মার্কেট কমপ্লেক্সের সিক্সথ ফ্লোরে। বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের জোনাল অফিস। মাস ছয়েক হলো, অরিন্দম প্রমোশন পেয়ে ডিজিএম হয়েছে। ব্যাঙ্কের ডিজিএম বেশ উঁচু পদ।প্রায় তিনশ ব্রাঞ্চ অফিসের হেড।সঙ্গে হাই লেভেলের অনেক যোগাযোগ। হিউজ ফিনান্সিয়াল পাওয়ার। ট্রাফিক সিগনাল গ্রীন হলে ডান দিকে মেইন রাস্তায় গাড়িকে তোলে রতন। ঐতিহ্য একটু অনুযোগ করে। বলে, “আমাদের এতক্ষন অপেক্ষা করালে কেন ?”

“অপেক্ষা? কখন? তুমি কল করার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এসেছি।”

অভি বলে, “বাবা, আমি, সিউর তুমি ভুলে গিয়েছিলে।”  অরিন্দম হাসে। অভি বলে যায়, “জানো বাবা আজ অনীক স্যারের কাছে তাড়াতাড়ি ছুটি চেয়ে নিয়েছি । উনি অবশ্য অনেকগুলো হোমটাস্ক দিয়ে গেছেন।”  অভি ক্লাস সেভেনে পড়ে। ঐতিহ্য আর অরিন্দমের  স্বপ্ন।তাদের একমাত্র  উত্তরাধিকারী।

ঐতিহ্য বলে, “তুমি তো পৌনে আটটায় নিচে এসে দাঁড়াবে বলেছিলে। আমরা সেইমতো এসে গেছিলাম। শুধু দেখছিলাম, তুমি কখন আসো। যখন দেখলাম আটটা, বাধ্য হয়েই কল করলাম।আমি তো জানি, তুমি ভুলে গিয়ে থাকবেই, আমরা এসেছি।”

অরিন্দম এমন কথার সঙ্গে পরিচিত। প্রায় সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে, ঐতিহ্যর কথার ধরণ, রাগ, অভিমান, আবেগের জায়গাগুলো চিনে গেছে। ঐতিহ্যর উপর একটা প্রবল মায়া আছে অরিন্দমের।ভরসা আছে।ও আজ যা কিছু , এই সবটুকু হয়ে ওঠার পেছনে ঐতিহ্য।ওর সহনশীলতা আর ধৈর্য্য প্রচুর।অরিন্দমের এই বদলির চাকরি জীবন, নেশাতুর লেখালেখি এ সব কিছুর প্রশ্রয় আর উৎসাহ দিয়েছে ঐতিহ্য। 

অরিন্দম সাড়া দেয়।

“ওহ।তাই। আয়াম সরি পাপা। এক্সট্রিমিলি সরি।ফরগিভ মি।”

“ইটস ওকে। মাই বয়।”

বলেই হাসে অভি। হাসিতে হাসি মেলায় ঐতিহ্য, অরিন্দম।                                                           

গাড়ি চলতে চলতে বাঁ দিকে টার্ন নেয়। হালকা ঝাঁকুনি হওয়ায় অরিন্দম ঐতিহ্যর গায়ে হেলে যায়। ঐতিহ্যও ধরে অরিন্দমের হাত। এ এক অমোঘ অবলম্বন। আশ্রয়। ঐতিহ্য বলে, “তোমার এরকম ব্যস্ততা কতদিন চলবে ?”

“অন্তত পনেরো বিশ দিন। থার্টি ফার্স্ট মার্চ অব্দি। বা এপ্রিলের টেন্থ অব্দি ধরতে পারো।”“বাব্বা।এখনও এতদিন !”

কথা বলতে বলতে ওরা এসে গেছে। রতন গাড়ি থামায়। বিগ বাজার।উপরের ফোর্থ ফ্লোরে হোটেল ডাউন টাউন। গাড়ি থেকে নেমে লিফটে ওঠে ওরা । সঙ্গেই ওঠে আরও দুজন সহযাত্রী। বছর বারোর কিশোর আর মা, এমনই আন্দাজ করা যায়। অরিন্দম একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করে। অনেক চেনা লাগে ওদের। খুব বেশি করে চেনা।কিন্তু ওই কিশোরকে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না। ওই মহিলার চোখ মুখ যেন অতিচেনা। অথচ, অরিন্দম ধরতে পারে না কখন  কীভাবে দেখেছে ওদের।স্মৃতি সায় না দিলে অদ্ভুত অসন্তুষ্টি হয়। অরিন্দম অস্থির হয়।ওর গাল কপাল গলা ঘামে ভিজে আসে।লিফট যেন জ্বলন্ত ফার্নেস ওর কাছে।ঐতিহ্য বুঝতে পারে।বুঝতে তো পারবেই।সম্পর্কের উষ্ণতাই তো এরকম।কাছের মানুষের কষ্টকে নিমেষে বুঝতে পারা।অরিন্দমের কপালে হাত রাখে ঐতিহ্য।বলে, “তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ? এত ঘামছ কেন ?”

“নাহ।এমনই।”

ব্যাপারটা ঢাকতে চায় অরিন্দম। লিফট থামে। থার্ড ফ্লোর। ওরা নামে। ফোর্থ ফ্লোর এলে নেমে আসে অরিন্দম, ঐতিহ্য, অভি। রেস্তোরাঁয় বসে একটু হাল্কা হয় অরিন্দম। স্থির হয়। মেনু কার্ড নাড়াচাড়া করতে থাকে, মা ছেলে।

“বাবা।প্রথমে, স্টার্টার। বেবিকর্ন স্যুপ অর্ডার করো।পরে মেন কোর্স বলছি।”

কথা অরিন্দমের কানে যায় না। লিফটের ওই চেনা অচেনা অবয়ব  কার, হঠাৎ এখানে , কেন, কীভাবে এরকম অনেক ইফস এন্ড বাটস মনে ভিড় করে।অরিন্দম হারাতে থাকে। ওর সামনে অভি, ঐতিহ্য।অথচ অরিন্দম নেই। হাওয়া যেন অন্যরকম।

#


বন্ধুর দাদার বিয়েতে বালুরঘাটে গিয়েছিল অরিন্দম।একদিনের ছোট একটা ঘটনা।কিন্তু তার ব্যাপ্তি বিশাল।এখনও কাঁপিয়ে দেয় অরিন্দমকে।ঝরা পাতার মতো উড়ে গেছে সময়।সময়েরই নিয়মে।হলুদ সময়ের স্তরে স্মৃতি হয়ে গেছে সব।পরে অনেক গল্পে, উপন্যাসে চরিত্র হয়ে ফিরেছে বারেবারে। কেন যে, এই এত বছর পরেও সেসব ছবি আকরিকের মতো উঠে আসে স্মৃতির খনি থেকে , বোঝা যায় না। জীবন কি এমনই ! স্মৃতিসম্বল ! সময়ের আক্রমণে মাঝে মাঝেই বিক্ষত হয় অরিন্দম। এ বাতাস এত বছরে ছুঁয়েছে ঐতিহ্যকেও।শুধু ভালোবাসা দিয়ে আটকে রেখেছে এই সর্বনাশা হাওয়াকে। “অরিন্দম , চল আমার সঙ্গে।”

শেখর বলে। অরিন্দমের হাত ধরে টানে।

“কোথায় ?” অরিন্দম একটু অবাক হয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ও।

“স্বর্গে । পরিদের দেশে।উর্বশী।রম্ভা।মেনকা। তিলোত্তমা। সুকেশী। আরো অনেকে আছে। আয়।আয় বলছি।”“স্বর্গে !”

“হ্যাঁ।পরিদের দেশে।পরিদের সঙ্গে কথা বলতে।”

“পরি, স্বর্গ, কী বলছিস যা তা !”

কথা বলতে বলতে অরিন্দমকে একদল মেয়ের মুখোমুখি টেনে নিয়ে আসে শেখর।তারপর সবার সঙ্গে পরিচয় করায়। বলে, “এই হল অরিন্দম।আমার বন্ধু।কবি।লেখক।পাগল।আর সর্বোপরি একজন সৎ মানুষ।”

বিয়েবাড়ির সুসজ্জিত আলোয় সব ঝলমলে। পোশাকে।সৌন্দর্যে।আচরণে। ততটাই অগোছালো অরিন্দম। একটা হাসির রোল। পরিদেরই মতো কত প্রজাপতি উড়ছে। অরিন্দম ওর কবিতায় ওড়ায় প্রজাপতি। ডানার রং লেগে থাকে তার কবিতার অক্ষরে । ওর হাতের আঙুলে। কিন্তু মুখোমুখি এই প্রথম। লজ্জায় , অপ্রস্তুতে জড় হয়ে যায় অরিন্দম। এরই মধ্যে ওর দৃষ্টি যায় একজনের দিকে। শেখর ঠেলা দেয়।সম্বিৎ ফিরে পায় অরিন্দম।দেখে ওর দিকে চেয়ে আছে সবাই। হাসির খিলখিল শব্দ।ওই অতজোড়া চোখ। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে একজোড়া চোখে স্থির হয়ে যায় অরিন্দম। ওর সমস্ত কবিতা, গল্প যেন পড়ে ফেলে ওই চোখ। তৈরি হয় হাজার হাজার কবিতার উৎসমুখ। অল্প কিছুদিন যোগাযোগ তৈরি হয়।তারপর অজানা কারণে সব শেষ। শেষটা ধোঁয়াশাই থেকে যায় , ঠিক যেমন রহস্যের ছিল সম্পর্কের শুরুটা।


#

অনেক বছর যোগাযোগ নেই শেখরের সঙ্গে।কলেজ জীবন পেরিয়ে কর্মজীবন, সংসার এই সব করতে করতে হারিয়ে যায় অনেকেই। অরিন্দম চাকরিসূত্রে  বিদেশে, লন্ডনের  ব্রাঞ্চে ছিল অনেক বছর ।তারপর মুম্বই।সবমিলিয়ে অনেক বন্ধুই হারিয়ে গেছে, শেখরের মতো।

মেনকোর্স ডিশ টেবিলে সার্ভ করার জন্য রেডি। ঐতিহ্য অভি বেশ উৎসাহী। এই এত ঝড় যাচ্ছে অরিন্দমের উপর বোধহয় আন্দাজ করতে পারছে না।

অরিন্দম অনুভব করে ওর কাঁধে কেউ হাত রেখেছে। চেনা ছোঁয়া। পুরোনো ছোঁয়া। টেবিলে সুস্বাদু খাবারের সুগন্ধ। রেস্তোরাঁর আধো আলো ছায়ায় স্তব্ধতার ছড়াছড়ি।অরিন্দম  রিফ্লেক্সে ওর কাঁধের হাতকে স্পর্শ করে। ঘুরে দাঁড়ায়। এক অনিবার্য বিস্ময় অপেক্ষমান। শেখর। কোনও কথা বলতে পারে না। বুকে টেনে নেয়। একটু স্থির হলে, অরিন্দম বলে, “শেখর, তুই, কোথায় ছিলি এতদিন ! এখানে এভাবে ! কেমন আছিস ! “

হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে আসে। শেখরও আপ্লুত। এত সহজেই অরিন্দম ওকে নির্ঘাত চিনে ফেলেছে !বলে, “এই তো আছি।তোদের মাঝেই।কাছেই আছি।” বলেই হাসে।

অরিন্দম বিলক্ষণ চেনে এই হাসি।

“একই আছিস। একদম !”

“তুই তো বদলে গেছিস বেশ। তোর এটায়ার, আটিটিউড, সব তো উৎকর্ষের চরম মাত্রাকে ছুঁয়েছে।”“কী যা তা বলছিস। ভালো করে দেখ।সেই একই আছি।সেই  লেখার জন্যই পাগল।কাজপাগল। “

দুজনেই হাসে।অরিন্দম পরিচয় করায়।এই আমার ঐতিহ্য। আমার অভি।আমার ছোট্ট সংসার। চেয়ারেই বসে আছে ঐতিহ্য। অভি। শেখরকে যথাযোগ্য রেসপন্স করে। অরিন্দমের মন ভালো হয়ে যায়।একটা নতুন কিছু হঠাৎ পেলে মন অজানা প্রাচুর্যে ভরে ওঠে। বেশিক্ষণ স্থায়ি হয় না এই ভালো লাগা।শেখর হাতের ইশারায় ডাকে ওর স্ত্রী পুত্রকে। কিন্তু এ কী ! অরিন্দম দেখে সেই চোখ।সেই পুরোনো কবিতার পংক্তি।সেই প্রজাপতি। ডানা রং। নিজের হাতের দিকে তাকায় অরিন্দম।তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা সব আঙ্গুল গুলিই প্রজাপতির ডানা রঙে দীপ্যমান। অরিন্দমের বোধে চেতনে অবচেতনে প্রজাপতি উড়তে থাকে।কবিতার পংক্তি দৃশ্যমান।সেই একজোড়া চোখ।

এগিয়ে আসছে সে। স্নিগ্ধ, সুশ্রী, শুচিস্মিতা।ক্রমশ অগ্রসরমান।কাছে।আরও কাছে।অরিন্দম শেখর মুখোমুখি। এতক্ষণে কাছে এসে গেছে সে ।পাশেই, কিছুক্ষণ আগে লিফটে দেখা সেই কিশোর।শেখর অরিন্দমকে মৃদু দোলা দেয়।পরিচয় করায়। অরিন্দম মনে মনে কিছু সমীকরণকে মেলায়।ঐতিহ্য, অভিও উঠে এসেছে।সবার কথা হয়। ভেতরে ভেঙে যায় অরিন্দম।কেউ টের পায় না। কেউ না। এই আত্মআন্দোলন চলতে থাকে। অরিন্দম দেখে ওর চারপাশে প্রজাপতি উড়ছে। আর তার ডানার অজস্র রং থেকে জন্ম নিচ্ছে একটা ত্রিভুজ । যার তিনটি বিন্দু দখল করে দাঁড়িয়ে আছে অতি চেনা তিনজন। তারা যত কাছেরই হোক, যত পরিচিতই হোক অথবা যত সুস্থিরই হোক না কেন, তাদের অবস্থান সর্বদাই অসীমে। 

0 comments: