সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
সার
রাজর্ষি বর্ধন
স্টেশনের বাঁদিক ঘেঁষেই কার্তিক সামন্তের ফুলগাছের দোকানটা পড়ে। এই এলাকার সব থেকে বড় ফুলের দোকান। গত তিন বছর ধরে ওর দোকান থেকেই যাবতীয় জিনিষ কিনছি- ফুল, গাছের সার ইত্যাদি। বাগান করার নেশা আমার ছোটবেলা থেকেই। আমার বাবার এই নেশাটা ছিল, সেখান থেকেই পেয়েছি। বাবাকে দেখতাম বাড়ির সামনের বাগানটাকে ফুলে-ফুলে ভরিয়ে তুলতে। আমি বর্তমানে যে বাড়িটায় থাকি সেখানে বাগান নেই বটে, কিন্তু কাঠাচারেক জমি আছে, সেখানেই শখের বাগানটা করি।
আমি পুলিশে চাকরি করি। বর্তমান থানার আমিই ওসি। বছর তিনেক আগে আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি। এই কুড়ি বছরের চাকরি জীবনে বহুবার বদলি হয়েছি, নতুন জায়গায় গেছি, আমার কাজের এমনটাই ধরণ। চাকরির বাকি আর চার বছর, আর বদলি হওয়ার সম্ভবনা কম। আমার পরিবার থাকে কলকাতায়, আমি অফিসারস কোয়ার্টারে একাই থাকি, এবং বাগান করে সময় কাটাই।
শীত আসছে, নানারকম মরসুমি গাছ লাগানোর সময় এসে গেছে। কার্তিকের দোকানে ঢুঁ মেরে গেছি বার কয়েক। এমনিতে কার্তিকের কালেকশন ভালো, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, পিটুনিয়া, অ্যান্টারটিনাম, প্রায় সব রকম ফুলই পাওয়া যায়। তবে কার্তিকের দোকানের সেরা জিনিষ হল গাছের সার। বেশ উন্নতমানের সার মজুদ রাখে কার্তিক ওর দোকানে। সুফলা বলো, ফসফেট বলো, বোনডাস্ট বলো, যা চাও সবই পাওয়া যাবে, তার মধ্যে সব চাইতে আশ্চর্যের জিনিষ হলো কমপোস্ট, যেটা নাকি কার্তিক নিজে হাতে তৈরি করে। এমন গুনমানের সার এতো কম দামে গোটা শহরে আর কোথাও পাওয়া যায় না। মাটিতে দিলে মরা জমি যেন জ্যান্ত হয়ে ওঠে। আমরা যেই এলাকায় থাকি সেটা একদম পশ্চিম মেদিনীপুর আর বাঁকুড়ার বর্ডারে, মাটি সেখানে ভয়ানক ভাবে রুক্ষ। কিন্তু কার্তিকের সার একবার মাটিতে দিলেই গাছপালা লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। এমনই আশ্চর্য ক্ষমতা এই সারের। আমার তো মনে হয়, এই সার দিয়ে মরুভূমিতেও ধানচাষ সম্ভব!
আমি কার্তিককে জিজ্ঞেস করি, “কি মেশাও বলো তো এই সারে?”
কার্তিক হেসে জবাব দেয়, “কমপোস্ট বানাতে যা-যা লাগে, সবই দি, শুকনো, মরা ডালপালা, গোবর সব মাটির সাথে মিশিয়ে গর্তের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখি দিন পনেরো, তাতেই এমন সার তৈরি হয়। বেশি কিছু করি না!”
কার্তিকের কথা আমার বিশ্বাস হয় না। মন বলে, কার্তিক আরো কিছু মেশায়।
[২]
থানায় একটা মিসিং কেস এসছে। এক স্থানীয় এমএলএর ছেলে অনেকদিন ধরে মিসিং। সে আবার এলাকার বড় প্রমোটর, নাম ইকবাল আহমেদ। হাই-প্রোফাইল কেস, ওপরমহল থেকে চাপ আসছে, যেমন করেই হোক একটা সুরাহা করতেই হবে।
থানায় এসে ইকবাল সম্বন্ধে অনেক খোঁজখবর নিলাম। বয়স পঁয়ত্রিশ, অবিবাহিত, এবং বেশ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে। সাথেসাথে একরোখা এবং বদমেজাজি স্বভাবের। অবশ্য ওর যা ব্যাকগ্রাউন্ড তাতে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তাকে শেষ দেখা গেছিল কাছাকাছিরই একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকে বেরিয়েই নিখোঁজ, কিভাবে? কিডন্যাপিং কেস ও হতে পারে, কারন ইকবাল পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে।
হঠাৎই ইকবালের ছবিতে আমার চোখ পড়ে যায়। আরে, ওকে তো কয়েকদিন আগেই কার্তিকের দোকানে দেখেছিলাম! কি একটা কারনে দুজনের মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হচ্ছিল। আমি তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। শুনলাম, ইকবাল কার্তিককে শাসাচ্ছে এই বলে, “তোর দোকান যদি আমি বন্ধ না করেছি তো আমার নাম ইকবাল নয় !”
ইকবাল চলে গেলে আমি কার্তিকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, “ব্যপার কি?”
কার্তিক বলল, ইকবাল নাকি ক্ষমতা দেখিয়ে তার ভাইয়ের জমি হাতিয়ে নিতে চায় বে-আইনিভাবে। তার ভাইয়ের কাছে জমির সব দলিল থাকলেও সে মানতে চায় না, জোর খাটিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ জমিটা বাগাতে চায়। শেষে কার্তিক গিয়ে তার কাজে বাঁধা দেওয়াতে তার সাথে ঝামেলা বাঁধায়। যার জেরেই এই বচসা !
বুঝলাম, এমএলএর ছেলে দাদাগিরি ফলাচ্ছে। কার্তিকে বলি, “ঠিক আছে, যদি কোন সমস্যা হয়, আমায় জানিয়ো।“
কার্তিক জবাবে বলল, “ও যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, জানে মেরে দেবো!”
আমি চমকে উঠলাম। কারণ কার্তিকের চোখে সেদিন যেই দৃষ্টিটা দেখেছিলাম, আমার অভিজ্ঞতা বলছে, সেটা একজন খুনির চোখেই দেখা যায়!
[৩]
বহুদিন পর বিষ্ণুপুর এলাম। একটা কাজে এসেছিলাম বাঁকুড়ায়, ভাবলাম, বিষ্ণুপুরে একবার ঘুরেই যাই। আগে এই থানায় বদলি ছিলাম, বর্তমান ওসিও আমার পরিচিত, সেখানে গিয়ে অনেকক্ষন আড্ডা মারলাম। তারপর সাহেব আমায় বসিয়ে অন্য কাজে গেলে একটা ফাইল হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে লাগলাম। ফাইলটা জেল পালানো আসামিদের একটা রেকর্ড। সেটা উল্টাতে গিয়ে একটা পাতায় এসে চোখ আঁটকে গেলো। সেটা কায়েসর মণ্ডল নামক জেল পালানো আসামিকে নিয়ে লেখা। খুনের আসামী ছিল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল, এবং যে কিনা প্রায় দশ বছর আগে জেল থেকে পালায়, এখনও নিখোঁজ। সব থেকে আশ্চর্য হলাম কায়েসর মণ্ডলের ছবিটা দেখে, আমাদের কার্তিকের সঙ্গে যার মুখের অদ্ভুত মিল, বিশেষ করে ওর দুটো চোখ আর বাঁ গালের আঁচিলটা যেন হুবহু এক! একমাত্র যেটা তফাৎ তা হল, কায়েসরের মুখে চাপদাঁড়ি থাকলেও কার্তিকের মুখ পুরো কামানো।
হঠাৎই অদ্ভুত সব চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। তাহলে কায়েসর মণ্ডল আর কার্তিক সামন্ত কি একই ব্যাক্তি? কার্তিককে আমি চিনি মাত্র তিন বছর, ওর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্বন্ধেও জানি না, তাহলে কি আমার সন্দেহটাই সঠিক?
মনে একরাশ ধোঁয়াশা নিয়ে ফিরলাম বিষ্ণুপুর থেকে।
[ ৪]
কার্তিককে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বিষ্ণুপুর গেছো কখনও ?”
প্রশ্ন শুনে কার্তিক খানিকক্ষন থেমে গেলো, তারপর বলল, “বিষ্ণুপুরের নাম শুনেছি, শুনেছি অনেক পোড়া মাটির মন্দির আছে, কিন্তু যাওয়া হয়নি।“
আমার মোবাইলে কায়েসরের একটা ছবি তুলে এনেছিলাম, সেটা খুলে কার্তিককে দেখিয়ে বললাম, “একে কোথাও দেখেছ ?”
ফটোটা দেখার পর কার্তিকের মুখে যেই অভিব্যাক্তিটা ফুটে উঠল, তার মধ্যে একই সাথে বিস্ময়, আতঙ্ক এবং ক্রোধের মিশ্রণ ছিল,যেটা আমার নজর এড়াল না। কার্তিক পরক্ষনেই হেসে বলল, “এনাকে আমি আগে দেখিনি, আপনার মোবাইলেই প্রথম দেখলাম !”
আমি বললাম, “তোমার মুখের সাথে অদ্ভুত মিল, তাই না?”
আবার একগাল হেসে কার্তিক বলল, “হয়ত আমার জমজ ভাই হবে, কুম্ভমেলায় হারিয়ে গেছিল!” তারপর খানিকক্ষণ থেমে বলল, “আচ্ছা, আপনি সেদিন জিজ্ঞেস করছিলেন না আমি কি এমন মেশাই যাতে আমার সার এতো ভালো হয়?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, করেছিলাম বইকি।“
“একদিন আসেন না আমার বাসায়, নিজের চোখে কমপোস্ট করা দেখে যাবেন!”
কি মনে করে যেন আমি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। মন বলছিল, একটা দারুণ জিনিষ দেখতে পাবো গেলে!
[৫]
কার্তিকের বাড়ি কাম নার্সারিটা বাজার থেকে একটু ভেতরে, একটু নিরিবিলিতে। বাড়ির ভেতর অনেকখানি জমি, অন্তত বিঘেখানেক তো হবেই। একপাশে নার্সারি রয়েছে দেখলাম, আর একপাশে ডাই করে রাখা, এ সবই সার তৈরির সামগ্রী।
আমাকে দেখে কার্তিক বিগলিত হয়ে ছুটে আসল। বললাম, “তোমার তো বিশাল কারবার দেখছি। এসব কি তুমি একাই করো ?”
একটা বাঁকা হাসি হেসে কার্তিক বলল, “সবই বলব, আগে একটু অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করি !”
আমি কিছু বোঝার আগেই মাথায় একটা ভারি জিনিষের আঘাত লাগল, তারপর দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
[৬]
চোখ মেলেই নিজেকে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দেখলাম। মাথার কাছটায় যন্ত্রণায় ছিড়ে পড়ছিল। চিৎকার করে বললাম, “এসব কি কার্তিক? আমায় বেঁধেছ কেন?”
একটা অট্টহাসি হেসে কার্তিক বলল, “আপনি জানতে চেয়েছিলেন না আমি কমপোস্টের সাথে কি মেশাই, সেটাই দেখানোর ব্যবস্থা করেছি। যদি সহ্য করতে না পারেন, তাই বেঁধে রাখা হয়েছে !”
এটা বলা কার্তিক হাততালি দিতেই দু’জন লোক কোথা থেকে একটা বস্তা নিয়ে এলো। তারপর সেই বস্তাটা খুলতেই একটা বিশ্রী গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মারল। এরপর কার্তিক সেই বস্তা থেকে যেটা বার করল, সেটা একটা মানুষের কাঁটা মুন্ড! দেখেই আমার গা গুলিয়ে বমি পেলো! মুণ্ডুটা আর কারো নয়, ইকবাল আহমেদের, যে আজ সাতদিন ধরে নিখোঁজ!
“আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমিই কায়েসর মণ্ডল, আমিই বিষ্ণুপুর জেল থেকে পালিয়েছিলাম, আর আমিই ইকবালকে খুন করেছি, নিজে হাতে !”
দেখলাম, বমিতে আমার জামা ভিজে গেছে। আমি প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই বাঁধন আলগা করতে পারলাম না।
“আপনি জানতে চেয়েছিলেন আমি কমপোস্টে কি মেশাই, আমি এসব মেশাই- মানুষের রক্ত, মাংস, চর্বি! তাতেই তো আমার সারের এতো গুন, মরা জমিতেও প্রাণ এনে দেয় !”
কার্তিকদের দেখলাম ইকবালের বডির টুকরোগুলো গর্তের মধ্যে ঢালতে, একটু পরেই তার ওপর মাটি চাপা পড়বে। আমার পরিণতিও আমি বুঝতে পারছিলাম। দু’দিন পরে আমার নামে মিসিং ডাইরি হবে, চারিদিকে তন্নতন্ন করে আমায় খোঁজা হবে, কিন্তু খুঁজে পাবে না কেউ, কারণ ততদিনে আমি সার হয়ে গেছি, সস্তা দামের ভালো কোয়ালিটির সার.........
0 comments:
Post a Comment