সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
স্মৃতি বিস্মৃতি
কৃপাণ মৈত্র
প্রতিদিন ট্রেনে অফিস যেতে হয়। প্রতিদিন হাজার দৃষ্টি বিনিময় হয়। খুব একটা কথা হয় না ।কিন্তু একজন লোক আমার দিকে কেমন দৃষ্টি নিয়ে যেন তাকিয়ে থাকেন। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার পর অন্য দিকে তাকানোর ভান করলেও বুঝতে পারি লোকটি আমাকে দেখছেন। নিত্যদিনের ট্রেনে কত মানুষ উঠানামা করে। এদের অনেকেই নিত্যযাত্রী। একাধিক ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু ঐ লোকটির চাহনি যেন কেমন। সেটি কেমন ভাষায় বোঝানো সহজ নয় ।একদিন বলেই ফেললাম ,আমি কি আপনার চেনা.. মানে...কোথাও কি...
লোকটি অপ্রস্তুত হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন ।কিছুটা সরে গেলেন ।কিন্তু আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না ।পরের দিন বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন লোকটি। ডেলি ট্রেনে কদাচিৎ সীট মেলে ।দাঁড়িয়ে যাওয়া আর কষ্ট মনে হয় না। লক্ষ্য করলাম লোকটির সামনের সীট হ ওয়া সত্ত্বেও লোকটি নিজে না বসে অন্যজনকে ইশারায় বসতে বললেন। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমি যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আবার লোকটির দিকে ফিরলে লোকটি বাইরে দেখার ভান করছেন। ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কেনই বা লোকটি আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। হতে পারে পরিচিত ।অনেকদিন আগে পরিচয়। আমি হয়তো মনে করতে পারছি না । আলাপ করে এ জটিলতা কাটানো যেত।আমি স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম। স্কুলের বন্ধু কি! স্কুলের সব বন্ধুদের মনে থাকে না।যারা পাল্লা দিয়ে এগোয় তারা যত স্পষ্ট মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া স্কুলছুটরা তত স্পষ্ট নয়। তাদের অধিকাংশ মেঘে ঢাকা পড়ে যায়। তবু আমি ভাবতে শুরু করলাম। বেশ কয়েকটা মুখ ভেসে উঠেছে।অস্পষ্ট।কিন্তু সেই আট দশ বছরের সঙ্গে এই পঞ্চাশ বছরের মুখ মেলানো সহজ নয়। সারাদিন অস্বস্তিতে কাটছে। কতবার স্টেশন পেরিয়ে যাবার পর মনে হয়েছে যাঃ নামা হলো না ।আবার ফেরার ট্রেনের অপেক্ষা।
স্ত্রী অলকা বলে, কী ব্যাপার ,এত আনমনা কেন? চায়ের টেবিলে চা জুড়োচ্ছে খেয়াল নেই! হাতের সিগারেট হাতে পুড়ছে হেলগম নেই! হলো কী তোমার! বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়লে নাকি !
আমি ব্যাস্ত হয়ে বলি, কী যে বলো।
-আজকাল সকলে রূপে মজে না।ট্যাকের জোর রূপের থেকে অনেক দামি। হ্যাঁ গো, বলো না, কী হয়েছে ।মনে থাকে যেন তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়েছে। ছেলে উচ্চমাধ্যমিক। আমাকে কিন্তু অনেক মেয়ে ব্যাঙ্গ করে বলে, অমুকের গলায় মুক্তোর হার ।
অলকা উল্টোটা বলল।অলকার সঙ্গে বেরোতে অস্বস্তি হয়। একদিন তো বন্ধু প্রকাশ বলেই ফেলল, বৌদি তোমাদের দেখাশোনার সময় বুঝি তোমার বাবার চোখের অসুখ ছিল ।এই অক্ষয় বাঁদরের একটা ছবি কি পাশাপাশি রেখে কম্পেয়ার করা যেত না।আলকা কপট রাগ করে বলেছিল, কী যে বলেন। শুধু রূপ দিয়ে হয় না ।গুণ আসল। বলেই হেসে যোগ করেছিল, গুণ মানে খুব বাধ্য।প্রকাশ হেসে বলেছিল, খুব ডোমেস্টিক! বিড়ালের মতো। তাই না। তবে জেনে রাখুন আওতায় গাছের মেরুদন্ড মজবুত হয় না ।
আমি বাধ্য হয়ে অলকাকে সব কথা বললাম ।
অলকা পরামর্শ দিল,ডেকে জিজ্ঞেস করে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায় ।
আমি যে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কথা অলকাকে বললাম না।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। কোনমতেই ঘুম ধরছে না। চোখ বন্ধ করলে হাজার মুখ ভিড় করে আসছে।বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম ।বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসলাম।সকলে আমার বাগানের প্রশংসা করে।দিনের যেটুকু সময় বাড়িতে থাকি ,বাগানে কাটাই।হেলান চেয়ারে বসে কত পুরনো স্মৃতি স্থবিরত্ব কাটিয়ে চলমান হয়ে যায়। চোখ ভেসে উঠল মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের সহপাঠীদের মুখ।যারা আবছা ছিল রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট হয়ে উঠল ।তাদেরকে বয়স্ক করে দিলেও তো তারা খোঁচা দাড়ির আড়ালের রহস্যময় লোকটির সঙ্গে মেলে না। স্মৃতিকে আর একটু উস্কে দিতে কলেজের বন্ধুরা স্পষ্ট হয়ে উঠল।নাহ্ কৈ মিলছে না তো। তাহলে কি খেলার বন্ধু! অভিমান ,শঠতা, প্রতারণা ,প্রতিযোগিতার সঙ্গীরাও তো এই আদলে আসছে না। তাহলে কি কোন আত্মীয় বাড়িতে পরিচিত হওয়া...। না সে সম্ভাবনা জোরের উপর দাঁড়ালো না।হাজার মানুষ যারা পর্দার আড়ালে ছিল কেমন যেন প্রকট হয়ে উঠল। কিন্তু হিসাব মিলল না ।কখন ভোর হয়ে গেছে খেয়াল নেই।
কাঁধের উপর একটা ঠান্ডা হাত। চমকে উঠলাম ।
-সারা রাত ঘুমোও নি তো।যাও মর্নিং ওয়াক করে এসো স্নান করো। তাড়াতাড়ি পুজো সেরে এসো। একসঙ্গে চা খাব।
রবিবারের সকালের পুজোটা আমি করি। খুব মজা করে একসঙ্গে চা খাওয়া হয়। গল্প হয় ।তারপরে লিস্ট মিলিয়ে বাজার করা হয়। কেমন যেন উইকএন্ডের ছন্দের মধ্যে ছন্দ পতনের ছন্দ। বেরিয়ে পড়লাম মর্নিং ওয়াকে। নাহ্, হাঁটতে ইচ্ছা করছে না।পরিচিত জনদের মুচকি হাসির বিনিময় করার মতো সৌজন্য দেখাতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম।দায়সারা মর্নি ওয়াক করে ফিরে এলাম। স্নান করলাম। গাছের ফুল তুলে পুজোয় বসলাম
।ধূপ দীপ ছাড়া পুজো দেখে অলকা বলে, তুমি দেখছি একটা অঘটন না ঘটিয়ে ছাড়বে না ।কে না কে ...।তার জন্য... দু'দিন অফিস ছুটি নাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
অনেক ছুটি পাওনা।অফিস আপত্তি করল না।ভাবলাম রবীন্দ্র সংগীত শুনলে আর বই পড়লে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।কিন্তু ফুলের স্বর্গে কিরাতের মতো দুশ্চিন্তা উঁকি মারা থেকে বিরত হলো না।
দুদিন ছুটি কাটিয়ে ট্রেনে চলেছি ।মনকে দৃঢ় করলাম ,আজ আর লোকটির দিকে ফিরেও তাকাবো না।কিছুক্ষণ কোন মতে নিজেকে উদাসীন রাখলাম।মনে হলো এক পলক দেখে নিই।নাহ্ কৈ লোকটিকে তো দেখা যাচ্ছে না।মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। আতিপাতি করে লোকটিকে খুঁজছি। না, তাঁঁকে তো কোথাও দেখছি না। কোথায় গেলেন! কিছু হলো না তো !পরের দিনও লোকটিকে দেখা গেল না ।আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী বলুন দেখিনি।
লোকটির সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ নেই কিন্তু নিত্যযাত্রী হিসাবে সকলে সকলের চেনা।কথাটা বলে নিজেই লজ্জিত হলাম।এ কেমন প্রশ্ন! লোকটি যদি জানতে চান কী ব্যাপার। তাহলে আমি কি বলতে পারব যে একটি লোক প্রতিদিন আমাকে নয়নবিদ্ধ করে বিরক্ত করত, সেই লোকটিকে দেখছি না কেন।
লোকটি কোন রকম প্রশ্ন না করে বললেন, ঐ লোকটার কথা বলছেন তো। ঐ যে দুর্ঘটনা ।
আমি অবাক হয়ে ভুরু তুলতে লোকটি বললেন ,আহা,ঐ যে লোকটি চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিল...। আপনার বয়সি হবে বোধ হয় ।
আমি চোখ বুঝলাম ।বুঝতে পারছি আমার গাল বেয়ে একফোঁটা জল ট্রেনের ফ্লোর ছুঁয়েছে। লোকটি আমার হজার বন্ধুকে জাগিয়ে দিয়ে এক মর্মান্তিক ঘটনা হয়ে গেল। ভেবে মীমাংসা পাই না,ওর অনুপস্থিতি কি আরামের হবে নাকি মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া নদীর মতো স্মৃতি হবে।
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment