সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
সম্প্রীতির আলোয় : কিছু টুকরো স্মৃতি
অনুরাধা মুখার্জি
বয়সে আমি ভারতের স্বাধীনতার থেকে এক বছরের বড়ো। সেইসময় আমরা যারা জন্মেছিলাম, তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বোধ একটু কম ছিল। তদুপরি আমার বাবা একেবারে ঐ দোষ মুক্ত ছিলেন। বাবার সঙ্গে ঈদ-বকরি ঈদে বাবার বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া ,ঈদ-মিলাপ সারা,ঈদির আদানপ্রদান সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করেছি। আমার ছোটোবেলা কেটেছে বিহারের চম্পারণ জেলার সদর শহর মতিহারিতে। ছোট থেকে পুরো স্কুলজীবন বন্ধুদের মধ্যে চাঁদ ভাই , বিবি, রোশন জহাঁ, শমীমা বাজী, উম্মহানিদি, নৈয়র ইমাম, নন্হে, নিজাম, হালিম , আর চাইবাসায় চাকরিসূত্রে তাজুনবিবি ও তার স্বামী, সপরিবারে হাসিম ভাই, জেব উন্নিসা, অতি সম্প্রতি বৃদ্ধাশ্রমের বন্ধু বিলকিস বেগম কলকাতায় সপরিবারে আহমেদ, সফি,( এরা দুজন অবশ্য আমার ভাইয়ের বন্ধু রূপে এসে পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিল ) সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে আমার বা তাদের তরফ থেকে কোন সঙ্কোচ, কোন দ্বিধা ছিল না।
আমি ছিলাম গোপাল সাহ বিদ্যালয়ের ছাত্রী।উম্মহানিদি্র সঙ্গে আমি একসঙ্গে স্কুলে যাতায়াত করতাম । ওর বাড়ি ছিল আমার বাড়ির মুখোমুখি।উম্মহানিদির বাবা ও মা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। ওর মা আমাকে প্রায়ই বলতেন - "আমি তো একদম সময় পাইনা, তোমার মা'কে নিয়ে একদিন এসো।" এখানেই ছিল মুশকিল। আমার বাবা ও তাঁর প্রভাবে আমরা যেমন অসাম্প্রদায়িক ছিলাম, আমার মা ঠিক তা ছিলেন না। না ওঁর কোনো ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার ছিল না, কিন্তু উনি ওদের মধ্যে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন না। অবশ্য তার কারণও ছিল, ঢাকা শহরে থাকতেন, নিত্য রায়ট দেখেছেন। এক মামাতো বোন খুন হয়েছিল,এক জেঠতুতো ভাই প্রাণে বেঁচে গেলেও অত্যাচারের চোটে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই মায়ের পক্ষে আমাদের মতো সহজভাবে মেলামেশা করা সম্ভবপর ছিল না। তাই উনি যে উম্মহানীদির বাড়ি যাবেন না,এটা আমি নিঃসংশয় ছিলাম। আর যেহেতু খুব একটা চালাক চটপটে ছিলাম না,তাই এই কথাগুলো নিশ্চিন্তে আমি উম্মহানীদির মাকে বলে দিয়েছিলাম। উনি শুনে কিছু বললেন না কিন্তু কয়েক দিন পর একসন্ধ্যায় আমাদের বাড়ী এলেন, মায়ের সঙ্গে আলাপ করলেন,মা ও চা জলখাবার করে খাওয়ালেন। বেশ কিছু ক্ষণ গল্প করার পর যাওয়ার সময়ে মায়ের হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন - বোন এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা তে তুমি অনেক কিছু হারিয়েছো ঢাকাতে, আর পাটনায় আমি আমার পুরো বাপের বাড়ির সবাইকে হারিয়েছি। আমি বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি ছিলাম বলে প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। উম্মহানীর বাবা অসুস্থ। আজ যদি ওঁর কিছু হয়ে যায়,তাহলে ছেলে মেয়ে নিয়ে দাঁড়াবার মতো আমার কোনো জায়গা নেই। তাই বলছি কিছু দুর্বৃত্তদের শয়তানি কার্যকলাপের জন্য আমরা কেন দূরে সরে থাকবো? আমি অবাক হয়ে দেখলাম মা ওঁর হাত সজোরে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন, দুজনের চোখেই জলের আভাস। এরপর থেকে মায়ের সব আড় ভেঙ্গে গেলো। মা নিজেও ঠিক বাবার মতোই সহজ, স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা শুরু করলেন। আর আমার নিজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা নির্মূল হয়ে গেল।
অবশ্য পরে বুঝেছিলাম তা সম্ভবত হয় নি। এর বীজ এতো গভীরে প্রোথিত যে এত সহজে তা উন্মূলিত হয় না। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। বুঝতে পারলাম আমার ভিতরেও সাম্প্রদায়িকতার শিকড় অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়েছিল,তাকে সম্পূর্ণ উৎপাটিত করার জন্য আরেকটা ঘটনার প্রয়োজন ছিল। এবং এই দ্বিতীয় বারের শিক্ষা আমাকে একদম সার্থক ভাবে অসাম্প্রদায়িক করে তুললো, সেই ঘটনার কথাই এখন বলবো।
তখন ১৯৬৪ সন। কাশ্মীরে হজরত বাল মসজিদ থেকে কোনো স্মৃতিচিহ্ন হারানো নিয়ে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক টেনশনের চাপাস্রোত বইছিল আর সেই টেনশনের সাময়িক অবসান হয় 1965 র ভারত পাক যুদ্ধের পর ।যাক। আসল গল্পে আসি - 64 সনের মে মাস ,আমি তখন মুন্সী সিং মহাবিদ্যালয়ের বি এস সি পার্ট ওয়ানের পরীক্ষার্থী। আমার ফিজিক্স প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা পড়েছে দ্বিতীয় সিটিঙে - অর্থাৎ বেলা দুটো থেকে পাঁচটা পর্যন্ত । ঐসময় চম্পারণে এমন লু (গরম হাওয়ার ঝড় ) বইত যে পারতপক্ষে জনপ্রাণী বাইরে বার হতো না। তার ওপর দিন দুয়েক যাবত কম্যুনাল টেনশন একদম চরমে পৌঁছেছিল আমাদের মতিহারিতে। অথচ পরীক্ষা , যেতে তো হবেই। বাবারও অফিস আছে। তাঁর পক্ষে আমার সঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। আর কেউ বাড়ীতে এমন নেই যে আমার সঙ্গে যেতে পারে! শেষে পাড়ার এক পুরনো, অতি বিশ্বাসী রিকশাওয়ালাকে ঠিক করা হলো যে আমাকে নিয়ে যাবে। মাঝের সময়টা সে কলেজেই থাকবে ও পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে বাড়ী ফিরিয়ে আনবে । এখানে আরও একটা কথাও বলা দরকার যে আমাদের এম এস কলেজটি ছিল মূলতঃ ছেলেদের । সব ক্লাস মিলিয়ে তখন মেয়েদের সংখ্যা 20 ছাড়ায়নি। আর আমার ইয়ারে পিওর সায়েন্স আমিই একমাত্র ছাত্রী। অর্থাৎ সেদিন সারা কলেজে আমিই একমাত্র মহিলা। যাইহোক ভয় মনে চেপে সাড়ে তিন মাইল রাস্তা খাঁ খাঁ দুপুরে পার হয়ে কলেজ পৌঁছলাম। রিকশা থেকে নামছি সামনে ফিজিক্সের অধ্যাপক নাসিম স্যার। ভদ্রলোক অতি সুভদ্র মানুষ। আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। স্কুলের উঁচু ক্লাসেও কিছুদিন পড়িয়েছেন কাজেই অনেক দিনের পরিচয় আর আমিও ওঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতাম । কিন্ত সেদিন সেই মুহুর্তে ওঁকে দেখে আমার মন বিরক্তিতে ভরে গেল। এদিকে উনি আমাকে বকতে শুরু করলেন যে আমার দুপুরের সিটিঙে পরীক্ষা ওঁকে কেন জানাই নি? জানলে উনি চেঞ্জ করে দিতেন। তা না করে এই দুপুরে, এরকম টেন্স পরিস্থিতিতে আমি একলা এসেছি। যেকোনো বিপদ হতে পারতো। উনি আমাকে যত বকেন আমি তত যেন ঘৃণা আর রাগে জ্বলতে থাকি। আমার মনে যে এতো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল আমি আগে কোনোদিন তা বুঝিনি। যাহোক পরীক্ষা শেষ হল। এবার ফেরার পালা। আমি রাগে আগুন হয়ে দেখতে দেখতে দেখতে এলাম যে নাসিম স্যার আমার রিকশার সঙ্গে সমানে সাইকেল চালিয়ে আসছেন। বাড়ীর সামনে বাবা দাঁড়িয়েছিলেন। স্যার কে দেখে বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন "আরে নাসিম ভাই আপনি!" স্যার উত্তর দিলেন শহরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয় মুখার্জিদা, মেয়েটা এতটা রাস্তা একলা আসবে, যদি কোনো কিছু ঘটে কে বলতে পারে। গুণ্ডা এলিমেন্টে শহর ভরে গেছে। কিন্তু আমি সঙ্গে থাকলে এখনও কিসী মাঈ কে লাল কো হিম্মত নহী হোগী কি উসকে তরফ আঁখ উঠাকে ভী দেখে। বাবা আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন কিন্তু উনি রাজি হলেন না বললেন পরীক্ষার কাজ বাকি ফেলেই চলে এসেছেন। হেসে আমাকে বললেন ভালো করে পরীক্ষা দাও। ভালো রেজাল্ট হলে ভাবীর হাতের দাওয়াত খেয়ে যাব বলে চলে গেলেন। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাকে আমি বিধর্মী বলে আমার শত্রু ঠাউরেছিলাম তিনি শুধু আমার সুরক্ষার জন্য আসতে যেতে সাতমাইল সাইকেল চালালেন তাও এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে। একটা কথা বলা হয় নি যে ওঁর মাতামহ জৌয়াদ হোসেন সাহেব অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন শহরের। তাই ওঁর উপস্থিতি আমাকে সত্যিই সুরক্ষিত করেছিল।
সেই দিন আমি অনুভব করেছিলাম যে এই বিভেদ এবং ঘৃণা কী সাংঘাতিক শক্তি ধরে! বাবার কাছে সব খুলে বলার পর বাবার সমস্যা বিশ্লেষণ ও আমাকে বোঝানোর ফল এতটা হয়েছিল যে আর কোনো দিন জীবনে এই ভেদবুদ্ধি আমার মধ্যে মাথা তুলতে পারে নি। মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে,তার ধর্ম, ভাষা বা জাতে নয়। সেদিন থেকে ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা আমি বুঝতে পেরেছি । এই ছিলেন আমাদের ফিজিক্সের অধ্যাপক সৈয়দ নাসিম আহমেদ।
তারপর চাকরিজীবনে পেয়েছি তাজুনবিবিকে। আমার বাড়িতে ফোন লাগানো নেহাত জরুরি, কিন্তু অতো দৌড়ঝাঁপ করার লোক নেই,তাজুনের স্বামী অফিসে ছুটি নিয়ে আমার বাড়িতে ফোন লাগিয়ে দিলেন।হাসিম ভাইয়ের বাবা আমাকে প্রথম বোঝালেন আর্থিক বৈষম্যের বিষফল কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের জন্ম দেয়।
আমার সান্ত্বনা শুধু এইটুকু যে এতগুলো ভালো অসাম্প্রদায়িক মানুষের সংস্পর্শে এসে আমি নিজেকে এতটা তৈরি করতে পেরেছি যে১৯৭৮/৭৯র জামশেদপুরের দাঙ্গা ও ১৯৮৪র এ্যান্টি শিখ দাঙ্গার সময়ে আমার ছাত্রী জেবুন্নেসা কি কমলজিত আমার ওপর বিশ্বাস রেখে বাড়ি যায়নি,গার্জেনকে ফেরত পাঠিয়েছিল এই বলে যে দিদি আমার মাথার ওপর থাকলে আমার কোনো ভয় নেই। ওদের এই বিশ্বাসটুকুই আমার জীবনের পরমপ্রাপ্তি।
0 comments:
Post a Comment