সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
বীমায় বিপত্তি
সন্দীপ গুপ্ত
অফিস থেকে বেরোতে পাঁচটা হয়ে গেল I হাসিমপুরের জমিদারবাড়ির ছোট ছেলে বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরীর এন্টিক জিনিস কলেকশনের শখ I গতকাল এক জার্মান সাহেবের কাছ থেকে একটি আংটি কিনেছেন I দাম প্রায় আড়াই কোটি টাকা I তারই বীমা করতে অফিস থেকে যাচ্ছি I দীনেশ বেশ জোরে চালালেও ন’টা বেজে গেল পৌঁছাতে I বীমা সংক্রান্ত ট্রাভেলে এরকম আপ্যায়ন আগে পাইনি I পেল্লাই তিনতলা বাড়ি, সামনে বিশাল বাগান I ক’টা ঘর আছে বলতে পারব না I নীচে পাশাপাশি পাঁচটা গেস্টরুম তারই দুটোয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে I বিনয়কৃষ্ণবাবু বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন I ওনারা তিন ভাই I বড়ভাই স্বর্ণকমল আর মেজোভাই জ্যোতিপ্রকাশ I স্বর্ণকমলবাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে I ওনার একমাত্র ছেলে শুভ্রদীপ আর স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা, ওদের একমাত্র কন্যা কৌশিকী I বছর দশেক বয়স I জ্যোতিপ্রকাশবাবুর স্ত্রী মারা গেছেন বছর দশেক আগে I ওনাদের একমাত্র কন্যা নিবেদিতা আর তার স্বামী পার্থ এবং ছেলে কৌশিক এই বাড়িতেই থাকেন I বিনয়কৃষ্ণবাবুর স্ত্রী হলেন স্বর্ণপ্রভাদেবী I ওনারা নিঃসন্তান I
ডিনারের পর আমি আর বিনয়কৃষ্ণবাবু এন্টিক রুমে বসলাম I বড় ডিল হলে আমরা ল্যাপটপ, প্রিন্টার সব ক্যারি করি I বীমার কাগজপত্র বুঝিয়ে, আংটিটা দেখতে চাইলাম I একটা ড্রয়ারের ভিতর থেকে আংটিটা আমার হাতে দিলেন I জানালেন “বীমা হবার আগে পর্যন্ত, রাতেরবেলায় এইটা বেডরুমেই রাখছি I” পুরো স্বচ্ছ ক্রিস্টালের মোটা বডি, তার উপর তিনটে লাল রঙের হীরে I মাঝের পাথরের সাইজটা বেশ বড়, কিন্তু লাল রংটা একটু ফিকে I সব ডিটেলস ল্যাপটপে তুলে বললাম "আমি শোবার আগে পেপার রেডি করে নেব I আপনি সকালে সই করলেই বেরিয়ে পড়ব I" বিনয়কৃষ্ণবাবু সম্মতি জানালে আমি শোবার ঘরে চলে গেলাম I
"দাদা! তাড়াতাড়ি উঠুন I" দীনেশের চিৎকারে দৌড়ে দরজা খুললাম I "বিনয়কৃষ্ণবাবু মারা গিয়েছেন I" কিছুক্ষনের মধ্যে ডাক্তার, পুলিশ সব এসে পড়ল I স্বর্ণপ্রভাদেবী খুব ভোরে বাথরুমে যান, ফিরে দেখেন বিনয়কৃষ্ণবাবুর শরীর একেবারে ফ্যাকাসে, হাত-পা ঠান্ডা I পুলিশের প্রাথমিক জেরার পর ওনার শোওয়ার ঘরে গেলাম I একেবারে রক্তশুন্য কোঁকড়ানো শরীর আর নাকের উপরে জমাট রক্তের দাগ I স্বর্ণকমল চৌধুরী আমাদের কিছুদিন থেকে যাওয়ার রিকোয়েস্ট করলেন পুলিশের তদন্তের খাতিরে I "আশা করছি দু-তিনদিনের মধ্যে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট চলে আসবে I থানা থেকে আপনাদের অফিসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে I " আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাইরের বাগানে এসে বসকে ফোন করলাম I "দরকার হলে আরও দুদিন থেকে বীমার কাজ করেই এসো, পুলিশের তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা কর, আমাদের নাম যেন ক্লিন থাকে I কোন অসুবিধা হলে আমাকে কল কর I" মর্গ থেকে বডি নিয়ে, সব কাজ সম্পূর্ণ করে সবাই রাত আটটা নাগাদ ফিরলেন I
পরদিন সুযোগ বুঝে স্বর্ণকমলবাবু আর জ্যোতিপ্রকাশবাবুর সাথে একটু কথা বলে নিলাম I দুজনেই বীমার কাজটা সম্পূর্ণ করতে বললেন I সইসাবুত সবই করবেন স্বর্ণপ্রভাদেবী I আগামীকাল পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পেয়ে গেলেই আমরা রওনা হয়ে যাব I সন্ধ্যাবেলায় শুভ্রদীপের কাছ থেকে আরেকবার আংটিটা দেখতে চাইলাম ফর রুটিন অবসরভেশন কারণ বীমা এখনো করা হয়নি I জিনিসটা আগের থেকে একটু ভারী আর অন্যরকম লাগল তবে বুঝতে পারলামনা কি I রাতে শুয়ে এটাই ভাবছিলাম তাহলে কি আংটিটা বদলে গেল আর চুরির জন্যই এই খুন I অফিসে জানাতেই হবে, ডুপ্লিকেট জিনিসের উপর বীমা হলে আমার কেরিয়ারের বারোটা বেজে যাবে I
পরের দিন সকালেই বসকে ফোন করাতে বললেন "আজকে আরেকবার আংটিটা দেখ, গন্ডগোল মনে হলে থানায় জানাও , আমি পরে কল করছি I" দুপুরবেলায় খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে শুভ্রদীপকে আবার অনুরোধ করলাম আংটিটা দেখানোর জন্যI সন্ধ্যাবেলায় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলেই, স্বর্ণপ্রভাদেবীর সই নিয়ে বেরিয়ে পড়ব I কিন্তু এবার আংটিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম, আজকে আবার হালকা মনে হচ্ছে I আর দেরি না করে অফিসের সাথে কথা বলে থানার বড়োবাবুকে ব্যাপারটা জানালাম I এবার বাড়িতে পুলিশ পোস্টিং হল I কিন্তু চিরুনি তল্লাশি করেও কোনো ডুপ্লিকেট আংটি বেরোলোনা I রাতে বস ফোন করে জানালেন যে থানায় কথা হয়ে গেছে কাল সকালেই আমরা ফিরব কারণ পোর্টমোর্টেম রিপোর্টে শুধুমাত্র হার্ট ফেলেরই উল্লেখ আছে I কিন্তু কিভাবে শরীর ওরকম রক্তশুন্য হল জানা যায়নি I তবে বীমা এখন হচ্ছে না I
মাঝরাতে মোবাইল বাজায় ঘুমটা ভেঙে গেল I দীনেশ ফোন করছে I "দাদা এখনই বাইরে আসেন I" দেখলাম রাত দুটো I দরজা খুলে দেখি বড়ঘরের মাঝখানে স্বর্ণপ্রভাদেবী সোফায় বসে কাঁপছেন, পাশে নিবেদিতা, দুজনেই উপরের দিকে তাকিয়ে I আমি আর দীনেশ দোতলায় ছুটলাম I সবাই বিনয়কৃষ্ণবাবুর ঘরের সামনে I ভিতরে ঢুকে দেখলাম প্রিয়াঙ্কার শরীর একদম নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাসে, কুঁকড়ে গেছে আর নাকের কাছে জমাট রক্তের দাগ I বাইরে পুলিশ পোস্টিং অথচ বাড়ির ভিতরে আবার একটা অস্বাভাভিক মৃত্যু I বিনয়কৃষ্ণবাবু আর প্রিয়াঙ্কা যে খুনই হয়েছেন এতে আর কোনো সন্দেহ নেই I ডাক্তারবাবু, থানার বড়োবাবু সবাই চলে আসলেন কিছুক্ষনের মধ্যে I প্রাথমিক ইনভেস্টিগেশনের পর পোস্টমর্টেমের জন্য বডি নিয়ে গেল I ঘর থেকে বেড়োবার আগে একবার শোকেসের মধ্যে আংটিটার দিকে চোখ গেল I মনে হল যেন কেও রঙ করেছে কারণ পাথরের উপর রঙের ফিনিশিংটাও ঘেটে গেছে I আমার কাজের ধরণের জন্যই সব মাইনুট ডিটেলস চোখে পড়ে যায় I জানতে পারলাম প্রিয়াঙ্কা শুয়েছিলেন স্বর্ণপ্রভাদেবীর সাথে I রাতে স্বর্ণপ্রভাদেবী কিছুক্ষনের জন্য বাথরুমে গিয়েছিলেন I ফিরে এসে দেখেন সব শেষ I
থানার বড়োবাবু সবার বয়ান নিলেন I আমি আমার সব অবসরভেশনস ডিটেলসে বললাম I " আপনার ঘরের উপরেই ঠিক বিনয়কৃষ্ণবাবুর ঘর , আপনি দুবারই কোনো আওয়াজ পাননি ?" বললাম "স্যার যেদিন বিনয়কৃষ্ণবাবু মারা গেলেন সেদিন আমি অনেক রাতে শুয়েছি, কোনো আওয়াজই কানে আসেনি, কিন্তু আমি শিওর প্রথম দিন রাতে আমি যে আংটি দেখেছি সেই আংটি এখন শোকেসে নেই I" বাড়ির মধ্যে একটা অসম্ভব ভারাক্লান্ত আর অস্বস্থিকর পরিবেশ I পুলিশ আজ প্রায় তিনবার স্বর্ণপ্রভাদেবীর বয়ান নিয়েছে I বুঝলাম বয়ানগুলির মধ্যে কোনো অসঙ্গতি আছে কিনা দেখে নিচ্ছে I এখন আমরা কেওই সন্দেহের উর্দ্ধে নই I
সন্ধ্যেবেলায় আমি আর দীনেশ আমার শোওয়ার ঘরেই বসে ছিলাম I দীনেশ জিজ্ঞেস করলো "দাদা আংটি চুরি হয়েছে এই ব্যাপারে আপনি শিওর ?" দীনেশ কে বললাম "বলতে পারিস I" আপনারাতো সবসময় ছবি তোলেন, একবার মিলিয়ে নিলেইতো পারেন I" হেসে বললাম "প্রথম দিনতো তুলেছিলাম কিন্তু তারপর আর সুযোগ পেলাম কোথায় ?" গলার স্বর নামিয়ে দীনেশ বললো "দাদা আপনি প্রথম দিনের ছবিটা বার করুন, আমি আজ কয়েকটা ছবি তুলেছি I" নিজেদের উত্তেজনা যতটা পারি আড়াল করে, দুটো মোবাইল থেকে ছবিগুলো মেলাতে থাকলাম I আংটির গঠন একই হলেও পাথরের লাল রঙের গাঢ়ত্ব একেবারেই আলাদা I এখন বুঝলাম মাঝে যতবার আংটিটা দেখেছি এই রঙের গাঢ়ত্ব প্রতিবারই আলাদা ছিল তাই অন্যরকম লেগেছে I
ঠিক করলাম কালতো বেরিয়েই যাব, তাই আজ রাতে এই বাড়ির দোতলায় একটু নজর রাখব I দু-দুটো জ্বলজ্যান্ত মানুষের খুনি এইভাবে পার পেয়ে যাবে এটা মানা যায় না আর আমার বীমার কমিশনটাও চটকে গেল I প্ল্যান হল বারোটা নাগাদ দীনেশ একটা চাদর নিয়ে আমার শোওয়ার ঘরের সামনে দাঁড়াবে I অযাচিত কাউকে দেখতে পেলে চাদর দিয়ে মাথায় পেঁচিয়ে ধরবে আর আমি সদর দরজা খুলে দুজন কনস্টেবলকে ডেকে নেব I যথা সময় বারোটা বাজলো I আমরা দুজনেই ঘাপটি মেরে দোতলার সিঁড়ির নিচে বসে রইলাম I বাগানের আলোটা হালকা হয়ে একতলায় পড়ায় পুরো বাড়িটাতে একটা আলো আঁধারের মায়াজাল তৈরি হয়েছে I দুজনের মোবাইলই সাইলেন্ট I কতক্ষন হয়েছে জানিনা, চোখ লেগে যাচ্ছে হঠাৎ পিছন থেকে দীনেশ হালকা করে হাতটা টেনে ধরল I দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি দোতলায় উঠছে I আমার পা’টা যেন একটু কেঁপে গেল , কিন্তু না এগিয়ে লক্ষ্য রাখতে থাকলাম I ছায়ামূর্তিটা দোতলার অন্ধকারে মিশে গেল I কিছুক্ষন পরে দোতলার একটা ঘরের দরজার নিচ থেকে লালচে আলো দেখা গেল I আমরা পা টিপেটিপে দোতলায় উঠে এলাম ওই ঘরের সামনে I এটাই বিনয়কৃষ্ণবাবুর ঘর I বেশ বুঝতে পারলাম ওই ছায়ামূর্তি একেবারে দরজার সামনে I হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ পেলাম I দীনেশ মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ওই ছায়ামূর্তির উপর চাদর পেঁচিয়ে ধরল I তারপরই "বাঁচাও বাঁচাও " বলে পরিত্রাহি চিৎকার I দীনেশ আর ওই ছায়ামূর্তির ধস্তাধস্তিতে বিনয়কৃষ্ণবাবুর বেডরুমের দরজা খুলে গেল I বুঝলাম ভেতর থেকে দরজা আটকানো ছিল না I কিন্তু দরজা খুলে যা দেখলাম তাতে আমার শরীর পুরো ঠান্ডা হয়ে গেল I ঘর হালকা লাল আলোয় ভরে গেছে I দীনেশ আর ওই ছায়ামূর্তি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে I আমি মোবাইলের ফ্লাশলাইটটা খাটের দিকে ফেলতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল I স্বর্ণপ্রভাদেবীর শরীর থরথর করে কাঁপছে I ছায়ামূর্তি মুহূর্তে এগিয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিল I আলোয় পার্থকে দেখে একটু অবাক হলাম I কিন্তু খাটের দিকে তাকিয়ে আমাদের তিনজনের চুল খাড়া হয়ে গেল I স্বর্ণপ্রভাদেবীর নাক থেকে অনর্গল রক্ত পড়ছে কিন্তু তা সব শুষে নিচ্ছে ওই নাকের উপরে থাকা আংটিটা I পাথরের লাল রঙটা আরও জোরালো হচ্ছে I আমি মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরে ওই আংটিটা ধরে ছাড়াবার চেষ্টা করলাম I কিন্তু মনে হল আংটিটা আগুনের তাপে ফুটছে আর আমার শরীরে লাগছে সহস্র ভোল্টের ইলেকট্রিক শক I আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম I
সকাল সাতটা বাজে, আমি আর দীনেশ এখন কলকাতার পথে I এই হোয়াটসাপের যুগে এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলে বোঝানো অসম্ভব I প্রায় আধা ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরেছিল I সেই রাতে পার্থও আমাদের মতন আড়াল থেকে লক্ষ্য করছিল I স্বর্ণপ্রভাদেবী বেঁচে গিয়েছেন I স্বর্ণকমলবাবু আমাদের ধ্যনবাদ জানিয়েছেন আর এই রহস্যের কিনারার জন্য কিছু পারিশ্রমিকও গুঁজে দিয়েছেন I ওই রক্ত পিপাসু আংটির কি ইতিহাস, কিভাবে শিকারের শরীরের আসত, এইসব আমাদের জানা নেই কিন্তু টাটকা রক্ত না পেলেই ওর ওজন কম আর রঙ ফিকে হয় পড়ত I আংটিটার ফরেনসিকে কিছু পরীক্ষা করা হবে I সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে কিনা শুধু সময়ই বলতে পারবে I তবে স্বর্ণকমলবাবু জানিয়েছেন পুলিশের কাজ হয়ে গেলে, ওটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন I
0 comments:
Post a Comment