সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 অবতার রহস্য

কৃশানু কুন্ডু 


ফোনের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ঋতিকার। দু মিনিট কথা বলে, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে জানিয়ে রেখে দিল ফোনটা। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বিছানায় বসে থাকার পর উঠতেই হলো। যার কাছ থেকে ফোনটা এসেছে, সে যদি সাত সকালে অফিসে থাকে তার মানে বেশ বড়ো কেলেঙ্কারি হয়েছে বা হতে চলেছে। নিশ্চই রাতে দেরিতে ফিরেছে দেখে তাকে ফোন করা হয়নি, তাই সকাল হওয়া মাত্রই তলব। কিছু তো লাভ হওয়া উচিত ডি সির কাছের লোক হওয়ার। 

কাঁকুড়গাছির জোড়া খুনটা সহজেই সল্ভ হয়ে গেলেও রাজনৈতিক কারণে তাই নিয়ে কিছু বলা যাবে না আপাতত। তিন দিনেই বোঝা গেছে কারা আছে পেছনে। ধরা হবে সবাইকেই তবে একটু সময় দিয়ে, খেলিয়ে, এখন চোখে চোখে রাখা হচ্ছে।  কালকে ওদের পিছনেই বাঁকুড়া গিয়ে তারপর ওপর থেকে অনুমতি না আসায় হাত গুটিয়ে ফিরে আসতে হলো, আর তাতেই হলো দেরি। 

তৈরী হয়ে বেরোতে যাবে, তখনি ফোনটা বেজে উঠল আবার । ফোনের ওপার থেকে কুন্ঠা জড়ান গলা ভেসে এলো ,"হ্যালো , ম্যাডাম আমি রাজর্ষি বলছি।" "কে রাজর্ষি ?" ঝাঁজিয়ে উঠলো ঋতিকা । 

"ম্যাডাম, আপনি আমাদের ট্রেনিং করিয়েছিলেন একবার, ক্রাইম সিন্ প্রেসারভেশন নিয়ে।"

"হ্যাঁ, তো ?"

"আমি মানে এতদিন মেটিয়াবুরুজে ছিলাম, তাই হয়ত আপনি ভুলে গেছেন।"

ঋতিকা একটু বিরক্ত হয়েই বলল ,"আপনি কোথায় ছিলেন আমি জানতে চাইনি ? আমার নাম্বার পেলেন কি করে ? আমায় ফোন করছেনই বা কেন ?"

"মানে, ম্যাডাম আমাকে বলা হয়েছে আমি যেন আজ থেকে আপনাকে রিপোর্ট করি, মানে বোঝেনই তো, আনঅফিসিয়ালি।"

অবাক হওয়ায় গলার স্বর একটু চড়েই গিয়েছিল ঋতিকার, "কেন, কোন কেসে?" কথা বলতে বলতেই গাড়িতে উঠে পড়লো ঋতিকা। রাজর্ষি বলল, "আপনিই এখনও জানেন না তো আমি কি করে জানব ম্যাডাম? আমাকে পৌঁছতে বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আর আপনাকে একটা ফোন করতে বলেছিল, তাই করলাম।"

"কে বলেছিল?" "ইয়ে ম্যাডাম, স্যার বলেছিলেন, ডি সি ডি ডি।"  কয়েক মুহূর্তের জন্য একটু থমকে গেল ঋতিকা, "আচ্ছা, রাখুন। আমি পোঁছে যাব," বলে ফোন কেটে দিল ঋতিকা। সকালে ডি সির ফোন আর নতুন ন্যাঙট, ব্যাপারটা কি, অভিজিতদা ফোনে কিছু বললেননা কেন? একরাশ কৌতুহল নিয়ে সকালের ফাঁকা বৌবাজার পেরিয়ে গেল ঋতিকা।

"স্যার, একটা জলে ডোবা লাশ বেরিয়েছে সেটার মধ্যে আপনি আমায় ঢোকাচ্ছেন, আর আমার ওপর নজর রাখতে একটা ঘন্টাও বাঁধছেন গলায়। এটা কি ঠিক হচ্ছে? ইয়েস, উই আর ক্লোস, ইয়েস, আমার কিছু পার্সোনাল ঝামেলা চলছিল, কিন্তু আমার পার্সোনাল লাইফ কখনও আমার কাজে বাগড়া দেয়নি।  ইউ আর মাই মেন্টর বাট ডু নট বেবিসিট মি, আই মিন, লুক আট মাই রেকর্ড। আমি কাঁকুড়গাছির কেসটা অন্য কাউকে দেব না। আপনি জানেন ওটা আমার জন্য দরকারি ইন দা কারেন্ট সিচুয়েশন...."

"শাট আপ ঋতিকা।" আদেশটা একটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল। মুখ খুলতে গিয়েও আর মুখ খুলতে পারলনা ঋতিকা । অভিজিতদার শিক্ষকসুলভ বাইরেটা যখন আর ভিতরের কঠিন মানুষটাকে আটকে রাখতে পারেনা, তখন বুঝে নিতে হয় যে এবার শুধু তিনিই কথা বলবেন। ঋতিকা এটা ঠেকে শিখেছে। উত্তেজিত হয়ে আর লাভ নেই, বাকি কথাগুলো মুখেই আটকে গেল তার। 

"শাট আপ এন্ড লিসেন, আর যদি নিজের ভাল চাও তো মাঝখানে আর কথা বলবে না, এলস এই কেসটা আমি অন্য কাউকে দিয়ে দেব কিন্তু কাঁকুড়গাছির কেসটাও যাবে তার সঙ্গে।"  একটু থেমে অভিজিত পুরকায়স্থ, ডি সি, ডি ডি, ইন চার্জ হোমিসাইড যা বললেন তা একটু হলেও, বিব্রত করল ঋতিকাকে।

"আজ ভোরে, পোর্ট থানার রিভার পেট্রল নিজেদের পেট্রলে বেরোচ্ছিল ভোর ছটা নাগাদ। স্পিড বোটে উঠেই ওরা লক্ষ্য করে যে বোটের দড়িটা জেটিতে না বাঁধা হয়ে চলে গেছে জলের তলায়। দড়িতে টান পড়ছিল বেশ জোরে, ছাড়ান যাচ্ছিল না । অবাক হয়ে একটু টানাটানি করতে গিয়ে ওরা দেখে দড়ি নিচে কোথাও আটকান আছে । এটা চিন্তার ব্যাপার কারণ এভাবে বোট রাখা হয়না। কেউ পুলিশের বোটে কারসাজি করার সাহস করেছে। দড়িটা নিচে কোথায় আটকাচ্ছে দেখতে জলে নামতেই ওরা খুঁজে পায় বডিটা। লুকনোর চেষ্টা নয়, বরং যেন সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় তারই ব্যবস্থা করা হয়েছে।" ঋতিকা কিছু বলতে যেতেই হাত তুলে তাকে থামতে বললেন অভিজিত। "দড়িটা বাঁধা ছিল বডির দুহাতে, পা বাঁধা ছিল বোট থেকেই নেওয়া একটা নাইলনের দড়ি দিয়ে যার শেষ অংশটি বাঁধা ছিল জলে ডোবা একটা আউটবোর্ড মোটরে।  প্রাইমা ফেসি, মনে হয় লোকটা মারা গেছে ডুবে, সাফোকেশন ডিউ টু ড্রাউনিং। কিন্তু পোস্ট মর্টেম এখনও হয়নি। তুমি বলছিলে ঋতিকা, কেন তোমায় এই কেসটা দিচ্ছি। বলতে বাধা নেই তুমি গত কবছরে বেশ কয়েকটা কঠিন হোমিসাইড সল্ভ করেছ। তার মধ্যে কিছু কিছু রাজনৈতিক, যার ফলে এখন তুমি সরকারের নেকনজরেও আছো কিন্তু এই কেসটা তোমার দক্ষতার পরীক্ষা। এই কেসটা সল্ভ হওয়া চাই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে।  মিডিয়া আমাদের ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে.."কিন্তু স্যার", ঋতিকা বলে উঠল, "রাজনৈতিক কোন নেতার বেলাও তো আমরা এতো তাড়াহুড়ো করিনা, তাহলে?" উত্তরটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো ঋতিকা । "কারণ, যে মারা গেছে সে কোন লোকাল রাজনৈতিক নেতা নয়, সে হেস্টিংস থানার সাব - ইন্সপেক্টর, নির্মল মাঝি।" 

ঘন্টা দুয়েক পর ঋতিকা আর রাজর্ষি কথা বলছিল ডক্টর মজুমদারের সাথে। ডক্টর মজুমদার এস এস কে এমের এই মর্গটির দায়িত্বে আছেন । উনি বললেন,"একটা আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি বাঁদিকে, কানের তলায়। অনেকটা ভোঁতা কোন জিনিস দিয়ে মারলে যেরকম হয়, পোশাকি ভাষায় যাকে বলে, ব্লান্ট ফোর্স ট্রমা।"

রাজর্ষি বাচ্চা ছেলের মতো ছুটে গিয়ে বলল, "কই দেখি?" ডক্টর মজুমদার বাঁদিকের চুলটা সরিয়ে দেখালেন। "এটাই মনে হচ্ছে জ্ঞান হারানর কারণ। পেটে তো কোন কিছু পেলাম না তবে ভিসেরা হতে দুদিন লাগবে, তখন বলতে পারব।"

ঋতিকার কাছে এই ঘরটা নতুন নয়। প্রায়ই নানা কেসে আসতে হয় এখানে। একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলল না ঋতিকা। রাজর্ষি নিজের এলেম দেখাতে খুব উদগ্রীব। অবশ্য এই উদ্দমটাই নাকি ওর ইউ এস পি, শুধু লেগে থেকে খিদিরপুর এলাকার বেশ কিছু মার্ডার কেস সল্ভ করেছে সে, নিশ্চই বুদ্ধিও আছে। সেই জন্যেই নাকি ওকে এই কেসে ঋতিকার সাথে ভিড়িয়ে দেওয়া। সাহায্য করতে, না তার জীবনের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পর এরকম একটা কেসে তাকে পুরোপুরি ভরসা করতে পারছেন না অভিজিতদা, তাই রাজর্ষিকে সঙ্গে লাগিয়েছেন সব খবর রাখবার জন্য।

"ঠিক কখন হয়েছে, আট থেকে এগারো ঘন্টা মনে হয়," প্রায় নিজের মনেই  বললেন মজুমদার।

"তিনটের পরে, সাড়ে পাঁচটার আগে," বলল ঋতিকা। ডাক্তার মজুমদার আর রাজর্ষি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাতেই ঋতিকা বলল,"গঙ্গায় রাতের শেষ পেট্রল ফিরে আসে তিনটেয় আর ভোরের প্রথম পেট্রলের জন্য জেটিতে আনাগোনা আরম্ভ হয় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তিনটেয় কেউ কিছু লক্ষ্য করেনি, একই বোট ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও, তার মানে তিনটে আর সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই যা হওয়ার হয়েছে, সোজা হিসেব।"

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে ভাল লাগছিল না ঋতিকার। ডক্টর মজুমদারের বক বক না শুনে কাজে লেগে যাওয়া ভাল। ডক্টর মজুমদারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিপোর্ট দিতে আর তেমন কিছু পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করতে বলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে, পিছন পিছন রাজর্ষি । ঋতিকা বলল, "আমি রেকর্ড রুমে যাচ্ছি, নির্মল মাঝির সার্ভিস রেকর্ডটা একবার দেখা দরকার। আপনি একবার হেস্টিংস থানায় যান। কথা বলুন সবার সাথে। কেমন মানুষ ছিলেন এই নির্মল মাঝি। কোন রিসেন্ট কেস? কোন পুরোন ঝামেলা? রগচটা ছিল না মেনি বেড়াল? জিজ্ঞাসা করবেন। কেউ না বললে বা কথা না বলতে চাইলে আমার নাম বলবেন, তাতে না হলে স্যারের নাম। মোট কথা জবাব চাই। আর হ্যাঁ, সামনের চায়ের দোকান, আশপাশের পান, সিগারেটের দোকান, সেখানেও কথা বলবেন, অনেকসময় ওরাই আসল খবরটা জানে।"

রাজর্ষি এক হাত জিভ কেটে বলল,"আমাকে আর আপনি বলবেন না ম্যাডাম, আপনি আমার সিনিয়র।"

ঋতিকা বলল, "আমি খুব একটা ভদ্রতা এমনিও করতে পারিনা, কথা না বাড়িয়ে যাও, আর কি জানলে আমায় প্রত্যেক ঘন্টায় রিপোর্ট দেবে," তারপর একটু থেমে বলল,"আর স্যার ফোন করলে আমায় সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। মনে রেখো নাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।"

তিনটে বেজে গেছে, বেশ কয়েকবার বেজে গেছে ফোন। শেষ মেশ আর এড়াতে না পেরে অভিজিতের ফোন ধরতে বাধ্য হলো ঋতিকা। বলতেই হলো যে বিশেষ কিছুই এখনও জানা যায়নি তবে কাজ এগোচ্ছে। রাতের দিকে ফোন করবে বলে ফোন কেটে দিল ঋতিকা । ডি সি ডি ডি জানে যে এত তাড়াতাড়ি কাজ হবে না। সামনের টেবিলে রাখা ঝুরঝুড়ে ফাইলটাতে মন দিল সে।  ফিতে খুলে, হলদে পাতাগুলো উল্টে নির্মল মাঝির গত বিশ বছরের চাকুরীজীবনে খুঁজতে শুরু করল তার মৃত্যুরহস্যর চাবি। কিছু একটা যেন মাথায় এসেও বার বার আসছিল না। নির্মল মাঝি..নির্মল মাঝি, নামটা যেন কোথাও ঋতিকার চেনা, কোথায় যেন শুনেছে সে। একে একে বেড়িয়ে এলো কিভাবে এক আধা শিক্ষিত, বদরাগী, অমানুষ পুলিশের চাকরী পায়। প্রথমে ৮০র দশকের রাজনৈতিক শক্তির হয়ে কাজ করা, তারপর তাদের বদান্যতায় হোমগার্ডের চাকরী, সেখান থেকে জুভেনাইল কারেকশান হোমের প্রধান রক্ষক, সেখান থেকে পুলিশে কাজে ঢোকা। তারপর বিশ বছরে এস আই। লোকটা আস্ত জানোয়ার, তিনবার সাসপেন্ড হয়েছে দুর্ব্যবহার, মূলত মহিলাদের সাথে ওর ব্যবহারের জন্য। ঋতিকার চিরকাল অবাক লাগে পুলিশের মধ্যেই কত পশু লুকিয়ে আছে তা ভেবে। 

ফোনটা বেজে উঠল আবার। ওদিক থেকে রাজর্ষি যা বলল তার সারমর্ম দাঁড়ায় নির্মল মাঝি খুব ঝামেলার লোক ছিল এবং থানার ও সিও তাকে সমঝে চলত। তার কারণ লোকটা চিরকাল কোন না কোন স্থানিয় নেতার চোখকান হয়ে যেত আর থানায় চোখকান কেই বা না চায়। এতদিন একই কাজ করার পর নাম ডাকও বেড়েছিল। পৌরসভার পার্ষদ থেকে এখন সে বিধানসভার নেতাদের আশীর্বাদধন্য হয়েছিল। এতবার সাস্পেনড হয়েও চাকরি যে যায়নি তার কারণ  ঋতিকা এখন বুঝতে পারল। আর কিছুই এখনও জানা যায়নি। ওর মরার খবর এখনও কেউ জানেনা। মাঝে মাঝেই থানায় তার টিকি দেখা যেতনা তাই এখনও কেউ কিছু সন্দেহ করেনি। কোনদিনই কোন কাজ করত না তাই কোন কাজ নিয়ে ডাকও পড়েনি তার। এবার রাজর্ষি যাবে আশপাশের দোকানে, সেখানে গিয়ে নির্মল মাঝির নাম করে গালমন্দ করবে। দেখবে কেউ এগিয়ে এসে কিছু বলে কিনা। 

ফাইল পড়তে পড়তে সন্ধে হয়ে এসেছিল, উঠতে যাচ্ছিল ঋতিকা। এই ফাইলেই কোথাও লুকিয়ে আছে এ রহস্যের চাবিকাঠি, ভাল করে সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। এদিকে বার বার আসছে অভিজিতদার ফোন। নিয়মবিরুদ্দ হলেও ফাইলটা সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। ফাইলটা বন্ধ করে উঠতে যেতে গিয়েও উঠতে পারল না সে, চোখ আটকে গেল হঠাৎ খুলে যাওয়া একটা পাতায়। নির্মল যখন হোমে ছিল তখন একটা বিরাট গন্ডগোল হয়েছিল হোমে। একটা মেয়ে ওর বিরুদ্ধে মেয়েদের ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। যেমন হয়, কিছুদিন এই নিয়ে জলঘোলা হওয়ার পর সব চুপ চাপ হয়ে যায়। একটি এফ আই আর হয়েছিল যা কোন পরিণতি পায়নি। মেয়েটি নাকি কদিন পরে পালিয়ে গিয়েছিল হোম থেকে। এলাকার পার্ষদের স্নেহধন্য নির্মলের কোন শাস্তি হয়নি, উল্টে কদিনের মধ্যে পুলিশে চাকরি পাকা হয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্য্যের কিছু নেই এর মধ্যে কিন্তু কেন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল ঋতিকা। কোথায় যেন চেনাচেনা ঠেকছিল মেয়েটার নামটা, চুমকি সরকার। কোথায়? কোথায় শুনেছে নামটা? দরকারের সময় কেন যে মনে পড়েনা কিছু ?

ডায়রিতে নামটা লিখে তার নিচে কয়েকটা দাগ কাটতে কাটতেই আবার বেজে উঠল ফোন। আবার রাজর্ষি, এবার খবরটা একটু কাজের। যা জানা গেছে নির্মলের স্ত্রী মাঝে মাঝেই থানায় এসে ঝামেলা করত টাকাপয়সার জন্য। সে ঝামেলা মাঝে মাঝেই থানার সামনের রাস্তাতেও উপচে পড়ত। গতকালই নাকি খুব একচোট হয়েছিল, ধমকাধমকি, হুমকি কিছুই বাকি ছিল না। স্ত্রীকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার কথাও নাকি বলেছিল নির্মল। রাজর্ষি আর কিছু বলার আগেই ঋতিকা জিজ্ঞাসা করল নির্মলের ব্যাপারে ওর পরিবার থেকে কোন খোঁজ করা হয়েছিল কিনা। না, সেরকম কিছু জানা যায়নি।

ঋতিকা বলল, "দেরি না করে নির্মলের বাড়িতে খোঁজ নাও একবার। কি হয়েছে কিছু বলতে হবেনা। বলবে দরকারি কাজে নির্মলকে খুঁজছ, ওর ফোন অফ তাই বাড়িতে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সন্দেহ করতে পারে কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। একা যেও না, হেড কোয়ার্টার থেকে ক্রাইম ব্রাঞ্চের দুজনকে সঙ্গে নেবে, প্লেন ড্রেসে, কেস সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে না। ওরা তোমায় ফোন করবে, জায়গাটা কোথায়?" ওদিক থেকে আসা কথাকে সময় না দিয়ে ঋতিকা বলে চলে, "এন্টালি ? ওরা তোমায় ফোন করে নেবে, আমি অভিজিতদাকে বলে দিচ্ছি।"

চটজলদি নির্দেশগুলো দিয়ে এবার উঠে পড়ল ঋতিকা। অভিজিতদাকে ফোন করে কিছু সুত্র যে পাওয়া গেছে সেটা জানিয়ে দুজনকে এন্টালি পাঠাতেও বলে দিল একই সঙ্গে। গাড়ি চালাতে চালাতে মাথায় উঁকি দিচ্ছিল সেই মেয়েটার কথাই। খোঁজ করতে হবে কি হলো মেয়েটার, গেল কোথায়? বাকি আর কার কার সাথে একই ঘটনা ঘটেছিল? তারাই কি কেউ প্রতিশোধ নিতে উদ্দত হয়েছে? কিন্তু এত বছর পরে কেন?  ট্রিগারটা কি? চুমকি সরকার, কোথায় উঠে এসেছিল মেয়েটার নাম? কোনো কেসে কি? নিজের অফিসের কম্পিউটারটার জন্য আর তর সইছিলনা ঋতিকার । 

অফিসে পৌঁছে সার্চ করে কিছুই পাওয়া গেলনা। কাগজের ফাইল থেকে সফ্ট কপিতে কি কিছুই তোলা হয়নি ? পুরোন ফাইলেও তো কিছু পাওয়া গেলনা। হাল ছাড়লে চলবেনা। আবার ভাবতে হবে। নিরুদ্দেশের কেসগুলো একবার দেখলে হয় ভেবে সার্চ করতে আরম্ভ করল সে। এবারও হতাশাই শুধু হাতে এলো। শেষ চেষ্টা হিসাবে খবরের কাগজের রিপোর্টগুলো একবার পড়ে দেখতে শুরু করল ঋতিকা। বেশ কিছু মাইক্রোফিল্ম পার হওয়ার পর চোখ আটক গেল আনন্দবাজারের একটা ছোট্ট ভিতরের পাতার খবরে। বার বার নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা হওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লিলুয়ার কারেক্শনাল হোম। প্রায় বিশ বছর আগের খবর। ২০০০ সালের কথা, ১৯টা মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল একসাথে। মিলে যাচ্ছে হোমের নামটাও। কাটিংয়ের মধ্যে কয়েকজনের নামও রয়েছে যারা হারিয়ে গেছে। লিস্টের তৃতীয় নামটাই চুমকি সরকার। 

কিন্তু এই চুমকি সরকারের কি হল তারপর? খুঁজে বার করতেই হবে চুমকি সরকারকে। হয়তো কিছুই নয় কিন্তু কোন কারণে এই নিখোজঁ মেয়েটি ভিজে কুয়াশার চাদরের মতো ঢেকে ফেলছিল ঋতিকার সমস্ত চিন্তা। ঘোর কাটল ফোনটা বেজে ওঠায়। ওপাশে রাজর্ষি যা জানাল তা বিশেষ কিছু নয়। এন্টালির এঁদো বস্তির ভিতরে নির্মল মাঝির বাড়ি। ঠিক বাড়ি নয়, পরপর দুটো ঘর। বস্তির মধ্যে, নির্মল মাঝির বাসস্থানের পাশেই একটি কারখানা। প্রচুর ধুলো, ধোঁয়া আর আওয়াজ। দুটো ঘরই বাইরে থেকে তালা দেওয়া। চারপাশে কারখানা হওয়ায় প্রতিবেশি বলতে তেমন কেউ নেই। শুধু কারখানার কর্মীরাই বলল এ ঘরগুলোতে তারা আগে এক মহিলা ও একজন পুরুষকে বসবাস করতে দেখে থাকলেও, দু তিনদিন হলো তারা কাউকেই দেখেনি। ওর বউকেও কেউ দেখেনি কাল থেকে। কেন বন্ধ? ঋতিকা তালা ভাঙতে বলেও, আবার চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলল সে নিজেই আসছে.ততক্ষন যেন কিছুতে হাত না দেওয়া হয়। 

মিনিট পনেরর মধ্যেই হুটার বাজিয়ে পৌঁছে গেল ঋতিকার গাড়ি এন্টালির বস্তির মুখে। হয়তো এমনিতেই কেউ নেই। হয়তো অন্য কোথাও উঠে গেছে। হয়তো কদিনের জন্য কোথাও গেছে, কিন্তু নিশ্চিত হওয়াটা দরকার। কারখানাটা এখন বন্ধ তাই লোকজন তেমন নেই আশপাশে। ঘিঞ্জি বস্তির মধ্যে এ যেন এক নির্জন দ্বীপ। কয়েকবারের চেষ্টাতেই ভেঙে ফেলা গেল প্রথম ঘরের তালাটি। শুধু ভাঙাচোরা জিনিস ডাই করে রাখা। এবার দ্বিতীয় ঘর। এটাই নিশ্চই বসবাসের জন্য ব্যবহার হতো। তালা ভেঙে ঢুকে যা দেখা গেল তা তেমন কিছু নয়। সাধারণ বসবাসের ঘর। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে যদি তেমন টাকাপয়সা পেয়েও থাকে নির্মল মাঝি তা অন্তত এই ঘরের জিনিসপত্রে প্রকাশ পায় না। ত্রিপল টাঙিয়ে ঘরটাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। পিছনের দিকটা নিশ্চই স্নানঘর হিসাবে ব্যবহার হয়, আর ঐঘরটা ভালো করে খুঁজতে গিয়েই চমকে পিছিয়ে এলো ক্রাইম ব্রাঞ্চের পোড় খাওয়া একজন। ছেঁড়া কাপড়ের পর্দা দেয়া স্নানের জায়গার ভেতরে ভাজ করে রাখা এক মহিলার দেহ। কপালের ডানদিকে আঘাতের দাগ কিন্তু সেটা চমকে দেয়নি তাদের। দেহটিকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে পাশের ভাঙা চেয়ার থেকে নেওয়া দুটো শক্ত কাঠের টুকরো। পেটের দুপাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে এসেছে পিঠের দিকে, মেরুদণ্ডের দুপাশ দিয়ে, আর তার সাহায্যেই ঠায় বসিয়ে রাখা হয়েছে নিষ্প্রাণ দেহটিকে। 

রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। অভিজিত পুরোকায়স্থর তিনতলার ঘরে তখন ঋতিকা আর রাজর্ষি ছাড়াও প্রচুর সিগারেটের ধোঁয়া। অভিজিত ততক্ষণে জানিয়ে দিয়েছেন যে পরিস্থিতি ভাল নয়। দু দুটো লাশ পেয়েও পুলিশ একটা এফ এই আরও করেনি তা তো সম্ভব নয়। এফ আই আর হয়েছে নিয়ম মতো। সংবাদমাধ্যম এখনও খবর পায়নি তবে মনে হয়না কাল সকালের বেশি চাপা থাকবে এ খবর, লোকাল থানার ভিতর থেকেই খবর চলে যাবে সংবাদপত্রে। ওপর থেকে আসা চাপের কথা আর না তোলাই ভালো। অভিজিত বললেন, "ফাইনাল বলে দিলাম , যা ইচ্ছে করো , যেকজন লাগে নাও, সোর্স ব্যবহার করো, যাকে হাজতে নিয়ে জেরা করতে চাও করো। কাল দিনের শেষ পর্যন্ত সময়, তারপরে কেস হয়ত সি আই ডির হাতে চলে যাবে। কি হলো ?" ঋতিকার মুখে অস্বস্তির লক্ষণ দেখে বলে উঠলেন অভিজিত।

"এটা সেরকম কেস নয় স্যার, লোকাল গুন্ডার কাজ নয়, ছুরি বন্দুকও নয় যে কোথা থেকে আনা হয়েছে তা জানা যাবে। দুটো খুনই একটু অদ্ভুত। যেন খুব ভেবেচিন্তে ওই ভাবেই মারতে হতো। অন্য কোন ভাবে করলে হতো না। এরকম তখনই হয় যখন কোন গভীর আক্রোশ থেকে কাজটা করা হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর উত্তর লুকিয়ে আছে নির্মল মাঝির অতীতে। চুমকি সরকার, চুমকিকে খুঁজে বার করতেই হবে আমাদের, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।"

এমনিতে এরকম সময়ে কথা না বলাই ভালো এতো খুব ভালো করেই জানে রাজর্ষি, কিন্তু একটা কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। "বলছিলাম কি ম্যাডাম, "আমার মনে হয় এমনও তো হতে পারে চুমকি সরকার আর চুমকি সরকার নেই ? মানে নাম পরিবর্তন করেছে, সেইজন্যই আমরা কোথাও কোন রেকর্ড পেলাম না।"

ঋতিকা বলে উঠল, "তাহলে তো আর কথাই নেই, অন্য নাম আর পরিচয় নিয়ে খুন করে বেড়ালে কোন সন্ধানও নেই। হাতে নাতে ধরা ছাড়া কিছু করা যাবে না।"

অভিজিত ঋত্বিকাকে থামিয়ে বলল, "তুমি কি বলছিলে পুরোটা বলো। "

রাজর্ষি ভয়ে ভয়ে বলল, "কোর্টের রেকর্ড দেখলে হয়না, নাম পরিবর্তনের, আর খবরের কাগজে এফিডেভিটের তো আলাদা জায়গা থাকে।"

"কিন্তু তাতে তো অনেক সময় লাগবে।"

ঋত্বিকাকে আবার থামিয়ে অভিজিত বলল, " আমি লোক লাগাচ্ছি, হোম থেকে পালানোর পরের পাঁচ বছর দেখা যাক, পেপারের ক্লাসিফায়েড আমাদের রেকর্ডেই থাকবে, কম্পিউটারেই পাওয়া যাবে তবে তখনকার কোর্টের রেকর্ডের জন্য সময় লাগবে, কাল দুপুরের আগে হবে না। তবে খুঁজে দেখা যাক, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, একটা লিড তো বটে।"

রাজর্ষি বলল, " নির্মলের বাড়ির আশপাশেও সাদাপোশাকে লোক রেখেছি স্যার, যদি কাউকে চোখে পড়ে। তাছাড়া ওর স্ত্রীর কোন প্রেমঘটিত ব্যাপার ছিল কিনা, তাই নিয়েও খোঁজখবর নিচ্ছি। তবেকি আশপাশে খুব একটা মেলামেশা করত না ওরা। টাকাপয়সার অভাব তো হওয়ার কথা নয়, তাহলে বস্তিতে থাকত কি শুধু লোকের চোখ এড়ানোর জন্য, নাকি দেশের বাড়ি আছে যেখানে সব রাখা আছে। অনেকগুলো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।"

ঋতিকার মনে হচ্ছিল তদন্তের সুতোটা তার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিরক্ত হলেও কিছুই বলার নেই আপাতত। সময় লাগবে, আরেকটু ভাবতে হবে। ততক্ষণ না হয় অভিজিতদা এই রাজর্ষির মতো লোকদের নিয়েই নিজেকে খুশি রাখুক। 

রাজর্ষির আর ভালো লাগছিল না। এটা কি মিটিং হলো না তাদের বলা হলো যে তারা না পারলে এবার অন্য কেউ দেখবে কেসটা। সেটা হলে, গালে থাপ্পড় ছাড়া সেটাকে অন্য কিছু হিসেবে দেখা সম্ভব নয়।  কি অদ্ভুত রে বাবা, দুটো হাতল ঢোকান পেটে, ঠিক যেন কোন জানোয়ারের শিকার, হাতি বা বুনোশুয়োড়। ছোটবেলায় পড়া শিকারের গল্প মনে পড়ে গেল রাজর্ষির। মাথাটা ধরেছিল। ঋতিকা কোথায় সে জানেনা। ডি সির ঘর থেকে বেরিয়ে একটাও কথা না বলে চলে গিয়েছিল। রাজর্ষিও আর পিছন পিছন যায়নি। মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার। তাকে যখন কেউ খুঁজছে না, বাড়ি গিয়ে, একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা ভালো।

রাজর্ষির ঘুমটা ভাঙল টিভির শব্দ হঠাৎ তীক্ষ্ণতর হওয়ায়। বাড়ি ফিরে সোনালী তরলে বরফ নিয়ে খেলতে খেলতে কখন চোখ বুজে এসেছিল কে জানে? সংবাদপাঠিকার গলা প্রায় সপ্তমে, খবরটাও হাড় হিম করে দেওয়ার মতনই। মিডলটন রোর শেষে, লরেটো স্কুলের কাছে দুটি বাড়ির মাঝখানে একটি নারীদেহকে একটি জঞ্জালের ভ্যাটের উপর ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। খুন যে তাতে সন্দেহ নেই কিন্ত এতো ভয়াবহ কেন তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বুকের নিচ থেকে দুপায়ের সন্ধিস্থল অবদি চিড়ে দেওয়া হয়েছে, টেনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ভেতরের অন্ত্র। পোশাক থেকে মনে হয় আশপাশের কোন পানশালায় সময় কাটিয়ে ফিরছিলেন। অনেক রাতে জায়গাটা খালি হলেও পার্ক স্ট্রিট পাড়া তাই কারও চোখে পড়তে দেরি হয়নি। তদন্তে নেমেছে পার্ক স্ট্রিট থানা। 

ফোন আসবে জেনেই ঝট করে তৈরী হয়ে নিচ্ছিল রাজর্ষি। তার মন বলছিল কপালে আরও দুঃখ বাকি আছে। জুতো পড়তে পড়তে রাজর্ষি লক্ষ্য করল যে টিভির ছবি বদলে গেছে। দেখান হচ্ছে, সল্টলেক স্টেডিয়ামের কাছে, কমিশনারের অফিসের থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে পাওয়া গেছে আরও একটি লাশ। এবার খুন করা হয়েছে মাথা পাথড়ে গুড়িয়ে দিয়ে। সব চেয়ে অদ্ভুত, দেহটিকে এমন ভাবে রাখা হয়েছে যেন সে কিছু নিবেদন করছে, এক্ষেত্রে তার নিজের মাথা। মারা গেছেন একজন মহিলা ক্রীড়া প্রশিক্ষক যিনি কাছেই সাই হোস্টেলে থাকতেন। 

রাজর্ষির প্রত্যাশা মতো কোন ফোন সেদিন এলো না। সকালে শুধু জানা গেল কেস এখন আর তাদের হাতে নেই, বিশেষ তদন্তকারী দল, যাকে সিট্ বলা হয়, তা গঠন করা হয়ে গেছে। অনেকবার ফোন করেও ঋতিকা বা অভিজিত, কাউকেই ধরা গেলো না। প্রথম দুটি খুনের কথা যথারীতি পৌঁছে গেছে সংবাদপত্রের কাছে আর দুয়ে দুয়ে চার করতে দেরি করেনি সাংবাদিকরা। প্রথম পাতায় উঠে এসেছে নরসিংহ, স্টোনম্যানের মতো রঙিন নাম। কি করবে সে, নিজের থানায় রিপোর্ট করবে না অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না তাকে কিছু বলছে অভিজিত। অপেক্ষা করতে করতে শিকে ছিঁড়ল দুপুরের দিকে।

অভিজিতের ঘরের আবহাওয়া থমথমে। যা আলোচনা হলো তার সারমর্ম দাঁড়ায় সিটের কাছে কোন লিড নেই। ধস্তাধস্তির চিহ্ন থাকলেও কোন আঙুলের ছাপ বা ডি এন এ পাওয়া যায়নি। আশেপাশের কোন ক্লোস সার্কিট ক্যামেরাতেও কোন সন্দেহজনক গতিবিধি ধরা পড়েনি। তাই ডি সি চান তারা যেন তদন্ত চালিয়ে যায়, কিন্তু কিছু জানতে বা জানাতে হলে অভিজিতই কথাবার্তা বলবে। মৃত চারজনের মধ্যে তিনজনই মহিলা হলেও, ধর্ষণের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আলাদাভাবে মৃতদের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, যারা তাদের শেষ দেখেছে তাদেরকে জেরা করা হলেও, মনে হচ্ছে না সেখান থেকে কিছু উঠে আসবে।

ঋতিকা হঠাৎ বলল, "একটা কথা কি শুধু আমারই মাথায় আসছে? এটা যদি সিরিয়াল কিলিং হয় তাহলে, একটা কিছু থাকবে যেটা সবকটা মৃত্যুর ক্ষেত্রে একরকম। মোডাস অপেরান্ডি, মানে যেভাবে মারা হয়েছে, প্রথমটা জলে ডুবিয়ে, দ্বিতীয়টা পেট ফুঁড়ে দিয়ে, তিন পেট চিড়ে, চার নম্বর, যেন কিছু নিবেদন করছে।  এতে এমনিতে কোনো মিল নেই । কিন্তু আপনারা কেউ কি বিষ্ণু পুরাণ কখনও পড়েন নি? ছোটবেলায় গল্প শোনেন নি, এমনকি টি ভিতে এতো সিরিয়াল, নাটক, এতো কিছু দেখেও কিছুই মনে হচ্ছে না ? মৎস, বরাহ, নরসিংহ, বামন। বামনে অবতারে কাউকে বদ করেননি ভগবান কিন্তু বালি নিজের মাথা নিবেদন করেছিলেন তাকে। মৎসতে ধরা জলে ডুবে গিয়েছিলো, বরাহের দুটো দাঁত দুটো হাতল, নরসিংহ নাম তো খবরের কাগজ দিয়েই দিয়েছে আর বালি নিজের মাথা নিবেদন করেছিলেন আগেই বলেছি। আমাদের এমন একজনকে খুঁজতে হবে যে বিষ্ণু পুরান জানে। আমি জানি কারণ আমার পি এইচ ডির বিষয় ছিলো বিভিন্ন অবতার।" 

"অ্যাবসার্ড", বললেন অভিজিত, "কিন্তু অ্যাবসার্ডই চাই, ছেড়ো না, আরও খোঁজ, ভিকটিমদের মধ্যে মিল কোথায়, বেছে বেছে এদেরকেই কেন তুলে নিলেন এই ভগবান? কিছু একটা দাঁড় করাতে হবেই, তারপর শুধু সেরকম একটা লোক খোঁজা, এর বেশি এভিডেন্স পাওয়া যাবে না যদি না হাতে নাতে ধরা যায়।"

"কোর্টের রেকর্ডগুলো কি তাহলে ছেড়ে দেব?" রাজর্ষির প্রশ্নের জবাবও এলো সঙ্গে সঙ্গে, "কিছুই ছাড়া যাবে না, আমার ওগুলো আজ রাতের মধ্যে চাই।" 

দিনের বাকিটা কেটে গেলো ন্যাশনাল আর্কাইভসের দপ্তরে। বেশি রাতের দিকে নিজের চেনা একজনকে কোর্টের রেকর্ডগুলো খুঁজতে বলে ঋতিকার আর নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে, লালবাজারমুখো হয়েছিল রাজর্ষি। কোন সংবাদমাধ্যমেই চোখ রাখা যাচ্ছে না। অনলাইন, অফলাইন সবগুলোতেই কাপড় খুলে নেওয়া হচ্ছে কলকাতা পুলিশের । খুনগুলোর নৃশংসতায় ভয়ে কাঁপছে গোটা শহর। রাজ্যসরকারও থরহরিকম্প, শাসক, বিরোধী, সি আই ডি, সি বি আই, সব দাবিই উঠে গেছে। সবার মনেই কয়েকটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। এর পরে কে? কখন? রাস্তাঘাট হয়ে গেছে শুনশান। একটা বড়ো খটকা রাজর্ষির মনে সন্ধে থেকে আটকে আছে। অবতার নিয়ে পড়াশোনাটা যে কেউ করতে পারে। কারণ সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে উচ্চতর শিক্ষায় এমন বিষয় নিয়ে থিসিস মাত্র তিনজন জমা দিয়েছে কলকাতায় গত বিশ বছরে। একজন মৃত, একজন ভুপালে কর্মরত, তিন নম্বর..নাহ তা কি করে হয়? ফোনের আর্তনাদে সাড়া দিতে গিয়ে বাইক নিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল রাজর্ষি। ঋতিকা।

"শোনো, পরেরটা পরশুরাম। ভিকটিম এমন কেউ যে অনেক ক্ষমতার অধিকারী, মন্ত্রী, শিল্পপতি টাইপ আর যে কোন আশ্রম, দল, ক্লাব, এরকম কিছুর ক্ষতি করেছে, এই কলকাতাতেই। লোকটা রামায়ণ, মহাভারতের রাজাটাজার মতো বলতে পারো। ভেবে দেখো কে হতে পারে।" ঋতিকা কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করার আগেই ফোনটা কেটে গেলো । 

অন্ধকার ছাদের কোনায় একা দাঁড়িয়ে ছিলো সে । এখান থেকে অনেকটা শহর দেখা যাচ্ছিল। আলোয় মোড়া, হাজার তারার ঝলকানি। কিন্তু এই আলোর মাঝেই লুকিয়ে আছে কত অন্ধকার। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিল চুমকি। হাওয়া বার বার তার খোলা চুলগুলো উড়িয়ে আনছে কপালে। যতবার এই শহরকে দেখে ততই অবাক লাগে তার। তার হোমের ভয়াবহ জীবন কোন জাদুমন্ত্রে যেন হারিয়ে গেছে। মনে পড়ে সেই পালিয়ে আসার দিনটা, তারপর থানাতেই তার উপর সেই অকথ্য অত্যাচার। যাদের সাথে পালিয়েছিল, যাদের সাথে বেঁচেছিল, তারাই এক এক করে বিক্রি করে দিল। এসেছিল এক দেবতা, নিজের মেয়ের মতো করে রেখেছিল এক বিশাল প্রাসাদে। একটা বিয়েও হয়েছিল তার এক দেবপুত্রের সাথে কিন্তু আজ তাকে আবার ফেলে দেয়া হয়েছে রাস্তায়। সেই বঞ্চনাই তাকে জাগিয়ে তুলেছে আবার । পুরোন চুমকি, যার সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে, আর ক্ষমা করার শক্তি নেই তার। হাত নিশপিশ করছে তার, মরতেই হবে অরুণ ভানুশালীকে। দেরি নয়, আজই, এখনই।  

এমনিতে যা এড়িয়ে যায়, সেই ডি সির ঘরে নিজেই ঢুকল এবার রাজর্ষি। প্রায় তার পি এ ও গার্ডের সাথে হাতাহাতি করেই। গোলমালে বেরিয়ে এসেছিলেন অভিজিত। ঋত্বিকাকে ফোনে পেলনা রাজর্ষি বা অভিজিত কেউই। চাকরির পরোয়া না করে বলেই দিল রাজর্ষি, যতই অবিস্বাশ্য হোক। "ঋতিকা ছাড়া আর কেউ নেই যারা দশাবতার নিয়ে কলকাতায় রিসার্চ করেছে । যদিও দশাবতার সম্বন্ধে জানে তো সবাই। যেটা বার বার মাথায় ঘুরছে সেটা হলো এরকম একটা চিন্তা ঋতিকা ম্যাডামের মাথায় এলো কেন? ঋতিকা এতো নিশ্চিত হচ্ছে কি করে?"

অভিজিতের বিরক্তি তার গলার স্বরে প্রকাশ পাচ্ছিল, "ঋতিকাকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। ওর বাবা আমার সিনিয়র, এখন অবসরপ্রাপ্ত। ওর উপর সন্দেহ? মোটিভ?"

রাজর্ষি বলল, "সিরিয়াল কিলিংয়ে একটা ডেফিনিট মোটিভ থাকে স্যার , কিন্তু সেটা শুধু যে খুন করছে তার কাছেই বোধগম্য। হয়তো এমন কিছু আছে ওর ব্যক্তিগত জীবনে যার সম্বন্ধে বাইরের পৃথিবী, এমনকি আপনিও, ওয়াকিবহাল নন। তাছাড়া ওর জীবনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতো সবাই জানে। ঝামেলা, বিবাহবিচ্ছেদ, সবই তো খবরের কাগজে বেরিয়েছিলো। রিসেন্ট সাইকোলজিকাল ট্রমা থেকে যদি কিছু হয়ে থাকে? আপনি ভাবুন একবার, এমনকি এও বলে দিচ্ছে যে পরের খুন কার হবে , কিভাবে হবে ! মন্ত্রী, শিল্পপতি নয়তো রাজা, তাজ্জব ব্যাপার। 

অভিজিত বললেন, " হয়তো ও কিছু জানে যা আমরা জানিনা। একজন তো প্রথমেই মাথায় আসে....।" বলতে বলতে পরের কথাগুলো মুখেই থেকে গেলো অভিজিতের। "বিশ্বাস হয় না, সত্যি বিশ্বাস হয় না তবে নিশ্চিত হতে হবে। তাড়াতাড়ি যাও রাজর্ষি, আমি ব্যাক আপ পাঠাচ্ছি। গতসপ্তাহেই ১৭ একর জমি দখল করেছে যে, শ্মশান, মন্দির সমেত, আমাদেরই সাহায্যে, সেই নয় তো ? অরুণ ভানুশালী !" এবার রাজর্ষির হাঁ করা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, "মানে ঋতিকার এক্স হাসব্যান্ড?"

রাজর্ষি যখন সাদার্ন এভিনিউয়ের একটি আবাসনের সতেরো তলায়, অরুণ ভানুশালীর ফ্ল্যাটে পৌঁছল তখন চারদিক নিস্তব্ধ। সদর দরজা খোলা কিন্তু ভেজানো দেখে সন্দেহ হলো তার। গ্লকটা আগে বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকল সে। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল তা হলো বসবার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা লোকাল থানার ও সি ও আর একজন পুলিশকর্মীর দেহ। ১২গেজের শটগানের গুলিতে শরীরের উর্ধাংশের অনেকটাই আর নেই। শোবার ঘরের প্যাসেজে আরও একটি দেহ, অরুণের নিজের দেহরক্ষীর। খুব সাবধানে, ধীরে ঘরে ঢুকল রাজর্ষি। প্রায় পাগলের মতো নিজের প্রাণভিক্ষা করছেন অরুণ আর পাথরের মূর্তির মতো শটগানটা সোজা তার মাথার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঋতিকা। ঠিক সেই মুহূর্তে বেজে উঠল রাজর্ষি আর ঋতিকা দুজনেরই ফোন।

ফোনটা চমকে দিলো চুমকিকে। ফোনটার দিকে অবাকনেত্রে তাকিয়ে দেখল, স্ক্রিনের প্রিভিউতে ফুটে উঠেছে একটি ছবি। ছবি নয়, পেপার কাটিং। "আজ থেকে শিয়ালদা কোর্টে এফিডেফিট করে চুমকি সরকারের নতুন নাম হচ্ছে ঋতিকা, ঋতিকা জৈন।"

একই ছবি ততক্ষণে ফুটে উঠেছে রাজর্ষির ফোনের স্ক্রিনেও। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো সেও। হঠাৎ কেটে যাওয়া কুয়াশার মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল হারিয়ে যাওয়া চুমকির পরিচয়। ঋতিকা রাজর্ষির উর্ধতন অফিসার, খুন করতে উদ্দত হলেও সোজা গুলি করা যায়না ঋতিকাকে। সময় নষ্ট না করে রাজর্ষিও শুরু করল অনুনয়, "তুমি ঋতিকা, চুমকি নও। আই পি এস, তোমার সফল কেরিয়ার, সামনে জীবন পড়ে আছে, স্যার সব সামলে নেবেন, এটা করো না ঋতিকা। ঋতিকা যেন শুনতেই পাচ্ছেনা । কিন্তু বার তিনেকের পর চুমকি আর চুপ করে থাকলো না। প্রচন্ড বিস্ফোরণে প্রায় শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেলো অরুণ ভানুশালীর মাথা আর প্রায় একই সঙ্গে গর্জে উঠলো রাজর্ষির গ্লক। ৯ এম এমের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল ঋতিকা ওরফে চুমকির শরীরটা । 

তিন দিন পরের এক সকালে ডি সির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রাজর্ষি। অভিজিত পুরকায়স্থ যা বললেন তা থেকে গত কদিনের ঘটনাগুলো পুরো পরিষ্কার হওয়া সম্ভব হয়নি। কিছু থিওরি শুধু দাঁড় করানো গেছে। নির্মল ও তার স্ত্রী হোমে হওয়া ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল। বাকি দুজন যারা খুন হয়েছে তারা পরে কৃতি বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও, তারাও ছিল একই হোমে, পালিয়েও ছিল একই সাথে। কিন্তু যা বোঝা যায়, পালানোর পর নানাভাবে চুমকিকে শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল তারা। নিজেদের শরীর দিয়ে শুধু বাঁচার উপায় খোঁজা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও, মেনে নিতে পারেনি চুমকি। চুমকিরা উদ্ধার হওয়ার পর, চুমকিকে ভালো লেগে যায় তখনকার ডি জি পি, জগমোহন জৈনের। নিজের ক্ষমতায় চুমকির নাম পুলিশ রেকর্ড ও খবরের কাগজের বাইরে রাখেন তিনি। চুমকি থেকে ঋতিকা হয়ে যাওয়া মেয়েটি অতীতকে ধীরে ধীরে ভুলে যায় তার সাবলীল, উচ্চবিত্ত জীবনযাত্রায় মেতে ওঠে বিপত্নিক জগমোহনের ভালোবাসায়। জগমোহনের বাকি পরিবারের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক না থাকায়, ঋতিকার আসল পরিচয় গোপন রাখা হয়ে ওঠে আরও সহজ। কেন ঋতিকার মধ্যে এই দ্বৈত সত্তা তৈরী হলো, কেন এরকম নৃশংসভাবে চুমকি ফিরে এলো, তার উত্তর হয়তো দিতে পারত কোন অভিজ্ঞ মনস্তাত্বিক, তবে তার জন্য দরকার জীবিত ঋতিকাকে। হয়তো তাকে ডিভোর্স করেছিল অরুণ ভানুশালী, তার মতে অন্যায়ভাবে, অকারণে। পুলিশের বড় অফিসার হয়েও, অরুণের টাকার জোরকে হারাতে পারেনি ঋতিকা আর এই পরাজয়ই উস্কে দিয়েছিল তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা চুমকির প্রতিশোধস্পৃহা। পরশুরামের কুঠারের বদলে ১২ গেজের শটগান, অস্ত্রটাও ঠিকই বেছেছিল ঋতিকা। 

ঋতিকা ও কলকাতায় এই হঠাৎ আসা কালবৈশাখী ঝড়কে নিয়ে জলঘোলা করা হবে আরও অনেক দিন । অনেক বড়ো মাথা কাটা যাবে, অনেক কালি খরচা হবে সংবাদপত্রে। এসব নিয়ে আর ভাবতে ভালো লাগছিল না। লালবাজারের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো রাজর্ষি ।

2 comments:

shamik said...

Krishanu dar lekha one of the best golpo gulor moddhe etaa ekta - and I don't have any doubt on the same. Just amazing bolle kom bola hoy..

Unknown said...

Khub bhalo laglo.lekhata chkaie jaben.