সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
হিন্দু সংস্কৃতি ও অসহিষ্ণুতার ঐতিহ্য
অঙ্কুর রায়
বিশ্বজুড়ে আজকে সন্ত্রাসবাদী হিংস্রতার তুঙ্গস্পর্শী সময়ে ইসলাম সন্ত্রাসবাদের সাথে সমার্থক হয়ে উঠেছে । ইসলামি সংস্কৃতি তার যাবতীয় বিজ্ঞানচর্চা , স্থাপত্য ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে একটি অসহিষ্ণু ও অসুস্থ সংস্কৃতি হিসাবেই নিজেকে পরিচিত করতে বা বলা ভালো প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে । ভারতে অবশ্য অসহিষ্ণু সংস্কৃতি হিসাবে ইসলামের পরিচয় প্রাচীনতর । কারণ রাজনৈতিক ইসলাম রাজ্যবিস্তার করতে , বিজিতকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করতে , লুঠ করতে , বিজাতীয় সংস্কৃতিকে অবমাননা করতে বহু শতাব্দী আগেই ধর্মস্থান ধ্বংস এবং বলপূর্বক ধর্মান্তর করে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে । এই কুখ্যাতির ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে গেছে ইসলাম ও হিন্দু সংস্কৃতির পারস্পরিক সহযোগিতা , আদানপ্রদান এবং যৌথ সাধনার এক দীর্ঘ , গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ।
এর বিপ্রতীপে প্রায় সার্বজনীন প্রতিষ্ঠিত ধারণা হল হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিকভাবেই সহিষ্ণুতা ও ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা । বিবেকানন্দ প্রমুখ কম্বুকণ্ঠে বলেছেন ভারত চিরকালই অন্য ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের স্বাগত জানিয়েছে , তাদের দেবালয় তৈরীর জন্য জমি ও অন্যান্য সাহায্য করেছে । হিন্দুধর্ম কখনই অন্য ধর্মের ওপরে আক্রমণ করেনি , তাদের দেবালয় ধ্বংস করেনি শুধুই মিলনমহান-এর আদর্শকে উচ্চে উড্ডীন করেছে ।
হিন্দু সংস্কৃতি যে উদার , গ্রহণেচ্ছু ও নতুন দর্শন , ভাবনা এবং উপাস্য আত্তীকরণে সমর্থ তা আমরা জানি । একটি জনগোষ্ঠীর একান্ত নিজস্ব ধর্ম - বৈদিক ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠার যাত্রাপথটিতো উদার গ্রহণেরই ইতিহাস । প্রাগবৈদিক ও অনার্য ধর্মবিশ্বাস , দর্শন এবং উপাসনা পদ্ধতি আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আদিরূপ গড়ে ওঠে । গুপ্তোত্তর যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নির্দিষ্ট চেহারা নেবার এবং কঠোরভাবে বর্ণাশ্রম ও স্মৃতিশাস্ত্রের অনুশাসন বলবৎ হবার আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে উদারতা যথেষ্টই ছিল । এমনকি তার পরেও সহিষ্ণুতা ও উদারতা পুরোপুরি অপসৃত হয়নি । ভারত সংস্কৃতি বা হিন্দু সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন এমনকি পরস্পরবিরোধী দার্শনিক চিন্তা , বিশ্বাস , উপাস্য ও উপাসনা পদ্ধতির সমান্তরাল বা মিলিতভাবে ভারতসভ্যতার ঊষাকাল থেকেই অস্তিত্ব ছিল । সুফি মতবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামের বাণী ভারতে আগমনের সাথে সাথেই দুই সংস্কৃতির মিলনে ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার আসে । কবীর , দাদ্দু , রজ্জব , নানক প্রমুখ যে উদার মিলনের সাধনপথ নির্দেশ করেছিলেন তা সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তালাভ করে । কিন্তু তার অর্থ এমন কখনই নয় যে অনুদারতা ও অসহিষ্ণুতা হিন্দু সংস্কৃতির কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত কোন বিষয় । এই দেশে সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে বহুদিন ধরেই আবদ্ধ ছিল ।
আজ যা হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত তা আবাহমানকাল ধরেই কিন্তু এই নামে পরিচিত ছিল না । খ্রীষ্টানরাই হিন্দুধর্ম নামটি জনপ্রিয় করেন এবং খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় সনাতন ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যধর্ম হিন্দু নামে নিজের পরিচয় দেওয়া শুরু করে । তার আগে আজকে যা একমাত্রিক হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত তা ছিল শিব , শক্তি , বিষ্ণু ইত্যাদি উপাসনা এবং বিভিন্ন দার্শনিক বিশ্বাসের পৃথক পৃথক মার্গ । সেইসময় শৈব , বৈষ্ণব , শাক্ত , বৌদ্ধ ও জৈনমতের পারস্পরিক বৈরিতা , আক্রমণ ও অত্যাচারের এক দীর্ঘ , রক্তাক্ত ও তিক্ত ইতিহাস আছে । যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসই তার প্রতিযোগি ও প্রতিস্পর্ধী মতকে আক্রমণ শানায় । এর পাশাপাশি হিন্দু শাসকরা রাজ্যজয় করে শত্রুরাজ্যের উপাস্য দেবতার মূর্তিহরণ , লুণ্ঠন ও মন্দির ধ্বংস এমন যে কত করেছিলেন তার নজির ইতিহাসে ভূরি ভূরি । হিন্দু - মুসলমান দ্বন্দ্বে এই ইতিহাস লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায় ।
সংক্ষেপে হিন্দু সংস্কৃতির অসহিষ্ণুতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যাক অন্তত শুধু এটুকু বোঝাতে যে ভারতে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস অতি প্রাচীন , ইসলামের আগমনের ঢের আগে থেকেই এই দেশে মন্দির ধ্বংসের এক লজ্জাকর , নিন্দনীয় ঐতিহ্য ছিল ।
শুরু করা যাক ঋগ্বেদ থেকে । দক্ষ-র কাহিনী , যা ঋগ্বেদের বিভিন্ন ব্রাহ্মণ যেমন তৈত্তেরীয় , শতপথ , ঐতরেয় , গোপথ -এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণে স্থান পেয়েছে তা আসলে বৈষ্ণব ও শৈবদের মধ্যে সংঘর্ষের গাথা ।
শৈবদের উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা একসময় এতদূর পৌঁছেছিল যে এমনকি 1098 খ্রীষ্টাব্দে রামানুচার্যের মত প্রখ্যাত ও জনপ্রিয় আচার্যকেও তাঁর কর্মক্ষেত্র শ্রীরঙ্গম থেকে মহীশূরে পঁচিশ বছরের জন্য চলে যেতে হয় ।
642 খ্রীষ্টাব্দে পল্লবরাজ প্রথম নরসিংহবর্মণ চালুক্যদের রাজধানী বাতাপি ধ্বংস করেন এবং নগরের উপাস্য গণেশমূর্তি হরণ করে নিয়ে আসেন শুধু নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন ও চালুক্যদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য । সাথে অবশ্যই দেবতা গণেশের প্রতি অশ্রদ্ধাও ছিল।
দশম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় ইন্দ্র তাঁর চরম শত্রু প্রতিহারদের কালপ্রিয় মন্দির ধ্বংস করেন ।
প্রথম ও দ্বিতীয় কুলথুঙ্গ চোল ছিলেন ধর্মে শৈব । তাঁরা বহু বৈষ্ণবকে হত্যা করেন । দ্বিতীয় কুলথুঙ্গ চোল এমনকি একটি বিষ্ণু মন্দির ধ্বংসের পরে বিষ্ণু বিগ্রহ মহাসাগরে নিক্ষেপ করেন ।
অষ্টাদশ শতকে পেশোয়া নানা ফড়নবিশের মারাঠা সেনা টিপু সুলতানকে যুদ্ধে হারিয়ে বিখ্যাত শ্রিংগেরি মঠ ধ্বংস করে । কৌতুহলদ্দীপক তথ্য হল টিপু এই মঠটি পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন ।
শৈব ও বৈষ্ণবদের পারস্পরিক শত্রুতার সমান্তরালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং বেদবিরোধী ধর্মের ( বিশেষতঃ বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম ) মধ্যে সংঘর্ষের এবং বৌদ্ধ ও জৈনদের উপরে অত্যাচারের বহু উদাহরণ রয়েছে । বৌদ্ধ এবং জৈনদের প্রতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রথম থেকেই অপছন্দ , বিরূপতা এবং অসহিষ্ণুতা ছিল । রামায়ণে আমরা দেখি বস্তুবাদী ভোগের পক্ষে সওয়াল করার জন্য পুরুষোত্তম রাম জাবালিকে বৌদ্ধ এবং তস্কর বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন । অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বেদবিরোধীদের ঘৃণাভরে বৃষলা বা পাষণ্ড বলেছেন ।
জৈন ও ব্রাহ্মণ্য শত্রুতার প্রাচীনতম উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের ' আয়ারঙ্গসুত্তম ' গ্রন্থে । সেখানে আছে জৈন সন্ন্যাসীরা চর সন্দেহে অভিযুক্ত হবার ভয়ে দিনে লুকিয়ে থাকতো ও রাতে ঘোরাফেরা করতো ।
তৃতীয় শতকের বৌদ্ধগ্রন্থ ' দিব্যবদন ' - এ লিপিবদ্ধ আছে যে পুষ্যমিত্র সুঙ্গ চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে বহু বৌদ্ধস্তূপ ধ্বংস করে , বহু বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দিয়ে , বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হত্যা করতে করতে সকলা বা শিয়ালকোট পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন ।
হিউয়েন সাং এর বিবরণে পাওয়া যায় গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক গয়ার বোধিবৃক্ষটি কেটে ফেলেন এবং স্থানীয় এক মন্দির থেকে বুদ্ধমূর্তি অপসারিত করেন । হুণ শাসক , শৈব মিহিরকুল ষোলোশো বৌদ্ধস্তূপ ও মন্দির ধ্বংস করেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেন ।
একাদশ শতকে কলহন তাঁর রাজতরঙ্গিনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন যে জনৈক কাশ্মীরের রাজা রাজকোষ সমৃদ্ধ করতে বহু বুদ্ধমন্দির ধ্বংস করে সুবর্ণনির্মিত মূর্তিগুলি গলিয়ে ফেলেন ।
আরো উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি না করে দুটি বিষয় উল্লেখ করেই এই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই । প্রথমটি হল অন্যের উপাসনালয় দখল করে নিজ উপাসনালয়ে রূপান্তরিত করা ভারতে ইসলামের অবদান নয় । ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগে এমন অনেক উদাহরণ আছে । যেমন কাশ্মীররাজ ক্ষেমগুপ্ত শ্রীনগরের বৌদ্ধ মন্দির জয়েন্দ্রবিহার ধ্বংস করে সেইসব উপাদান দিয়েই ক্ষেমগৌরীশ্বর নামে একটি মন্দির তৈরী করেন। বিখ্যাত তিরুপতি বালাজি ও বৈষ্ণোদেবী মন্দির প্রকৃতপক্ষে ছিল জৈনদের মন্দির । বৈষ্ণোদেবী আসলে ছিলেন জৈনদের উপাস্য দেবী পদ্মাবতী ।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল ভারতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের এক প্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সামরিক শিক্ষার উদ্ভব হয় শঙ্করাচার্যের অব্যবহিত পরেই । প্রাচীন সাহিত্য থেকে জানা যায় দক্ষিণভারতে মন্দির সংলগ্ন ' সালাই ' ও ' ঘটিকা ' -য় ব্রাহ্মণ ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত । পার্থিবপুরমের এক প্রাচীন নথি ও বিভিন্ন শিলালিপিতে প্রাপ্ত ' কট্ট ' ও ' ভট্ট ' ব্রাহ্মণদের সামরিকশিক্ষাকে নির্দেশ করে । আদি মধ্যযুগের ধর্মীয় সংঘর্ষে ' সালাই ' ও ' ঘটিকা ' -য় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ' কট্ট ' ও ' ভট্ট ' দের বিশাল ভূমিকা ছিল ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে উদার , সহিষ্ণু , হিন্দু সংস্কৃতিতে হিংস্রতা ও অসহিষ্ণুতা যথেষ্টই ছিল । বহু স্রোতের মিলনে যে হিন্দু সংস্কৃতির উৎপত্তি সেই সংস্কৃতিও সহযোগিতার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতিকে উৎপীড়ও যথেষ্ট করেছে । অর্থাৎ ভারতে অসহিষ্ণুতা ইসলামের অবদান নয় । সাম্প্রদায়িকতার যাবতীয় দায় ইসলামের ওপরে ফেললে ভারতে হিন্দু মুসলমানের যৌথ সাধনারও যে এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে তাকে অস্বীকার করা হবে । বরং নিজেদের অসহিষ্ণু অতীতকে স্বীকার করে নিয়ে পথ চললে পথচলা অনেক সহজতর হবে।
4 comments:
সমৃদ্ধ হলাম।
ভীষণ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ জানাই।
লেখা সার্থক হল । ধন্যবাদ দিদি।
Post a Comment