সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 হিন্দু সংস্কৃতি ও অসহিষ্ণুতার ঐতিহ্য 

অঙ্কুর রায় 


বিশ্বজুড়ে আজকে সন্ত্রাসবাদী হিংস্রতার তুঙ্গস্পর্শী সময়ে ইসলাম সন্ত্রাসবাদের সাথে সমার্থক হয়ে উঠেছে । ইসলামি সংস্কৃতি তার যাবতীয় বিজ্ঞানচর্চা , স্থাপত্য ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে একটি অসহিষ্ণু ও অসুস্থ সংস্কৃতি হিসাবেই নিজেকে পরিচিত করতে বা বলা ভালো প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে । ভারতে অবশ্য অসহিষ্ণু সংস্কৃতি হিসাবে ইসলামের পরিচয় প্রাচীনতর । কারণ রাজনৈতিক ইসলাম রাজ্যবিস্তার করতে , বিজিতকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করতে , লুঠ করতে , বিজাতীয় সংস্কৃতিকে অবমাননা করতে বহু শতাব্দী আগেই ধর্মস্থান ধ্বংস এবং বলপূর্বক ধর্মান্তর করে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে । এই কুখ্যাতির ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে গেছে ইসলাম ও হিন্দু সংস্কৃতির পারস্পরিক সহযোগিতা , আদানপ্রদান এবং যৌথ সাধনার এক দীর্ঘ , গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ।

এর বিপ্রতীপে প্রায় সার্বজনীন প্রতিষ্ঠিত ধারণা হল হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিকভাবেই সহিষ্ণুতা ও ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা । বিবেকানন্দ প্রমুখ কম্বুকণ্ঠে বলেছেন ভারত চিরকালই অন্য ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের স্বাগত জানিয়েছে , তাদের দেবালয় তৈরীর জন্য জমি ও অন্যান্য সাহায্য করেছে । হিন্দুধর্ম কখনই অন্য ধর্মের ওপরে আক্রমণ করেনি , তাদের দেবালয় ধ্বংস করেনি শুধুই মিলনমহান-এর আদর্শকে উচ্চে উড্ডীন করেছে ।

হিন্দু সংস্কৃতি যে উদার , গ্রহণেচ্ছু ও নতুন দর্শন , ভাবনা এবং উপাস্য আত্তীকরণে সমর্থ তা আমরা জানি । একটি জনগোষ্ঠীর একান্ত নিজস্ব ধর্ম - বৈদিক ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠার যাত্রাপথটিতো উদার গ্রহণেরই ইতিহাস । প্রাগবৈদিক ও অনার্য ধর্মবিশ্বাস , দর্শন এবং উপাসনা পদ্ধতি আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আদিরূপ গড়ে ওঠে । গুপ্তোত্তর যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নির্দিষ্ট চেহারা নেবার এবং কঠোরভাবে বর্ণাশ্রম ও স্মৃতিশাস্ত্রের অনুশাসন বলবৎ হবার আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে উদারতা যথেষ্টই ছিল । এমনকি তার পরেও সহিষ্ণুতা ও উদারতা পুরোপুরি অপসৃত হয়নি । ভারত সংস্কৃতি বা হিন্দু সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন এমনকি পরস্পরবিরোধী দার্শনিক চিন্তা , বিশ্বাস , উপাস্য ও উপাসনা পদ্ধতির সমান্তরাল বা মিলিতভাবে ভারতসভ্যতার ঊষাকাল থেকেই অস্তিত্ব ছিল । সুফি মতবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামের বাণী ভারতে আগমনের সাথে সাথেই দুই সংস্কৃতির মিলনে ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার আসে । কবীর , দাদ্দু , রজ্জব , নানক প্রমুখ যে উদার মিলনের সাধনপথ নির্দেশ করেছিলেন তা সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তালাভ করে । কিন্তু তার অর্থ এমন কখনই নয় যে অনুদারতা ও অসহিষ্ণুতা হিন্দু সংস্কৃতির কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত কোন বিষয় । এই দেশে সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে বহুদিন ধরেই আবদ্ধ ছিল ।

আজ যা হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত তা আবাহমানকাল ধরেই কিন্তু এই নামে পরিচিত ছিল না । খ্রীষ্টানরাই হিন্দুধর্ম নামটি জনপ্রিয় করেন এবং খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় সনাতন ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যধর্ম হিন্দু নামে নিজের পরিচয় দেওয়া শুরু করে । তার আগে আজকে যা একমাত্রিক হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত তা ছিল শিব , শক্তি , বিষ্ণু ইত্যাদি উপাসনা এবং বিভিন্ন দার্শনিক বিশ্বাসের পৃথক পৃথক মার্গ । সেইসময় শৈব , বৈষ্ণব , শাক্ত , বৌদ্ধ ও জৈনমতের পারস্পরিক বৈরিতা , আক্রমণ ও অত্যাচারের এক দীর্ঘ , রক্তাক্ত ও তিক্ত ইতিহাস আছে । যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসই তার প্রতিযোগি ও প্রতিস্পর্ধী মতকে আক্রমণ শানায় । এর পাশাপাশি হিন্দু শাসকরা রাজ্যজয় করে শত্রুরাজ্যের উপাস্য দেবতার মূর্তিহরণ , লুণ্ঠন ও মন্দির ধ্বংস এমন যে কত করেছিলেন তার নজির ইতিহাসে ভূরি ভূরি । হিন্দু - মুসলমান দ্বন্দ্বে এই ইতিহাস লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায় । 

সংক্ষেপে হিন্দু সংস্কৃতির অসহিষ্ণুতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যাক অন্তত শুধু এটুকু বোঝাতে যে ভারতে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস অতি প্রাচীন , ইসলামের আগমনের ঢের আগে থেকেই এই দেশে মন্দির ধ্বংসের এক লজ্জাকর , নিন্দনীয় ঐতিহ্য ছিল ।

শুরু করা যাক ঋগ্বেদ থেকে । দক্ষ-র কাহিনী , যা ঋগ্বেদের বিভিন্ন ব্রাহ্মণ যেমন তৈত্তেরীয় , শতপথ , ঐতরেয় , গোপথ -এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণে স্থান পেয়েছে তা আসলে বৈষ্ণব ও শৈবদের মধ্যে সংঘর্ষের গাথা ।

শৈবদের উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা একসময় এতদূর পৌঁছেছিল যে এমনকি 1098 খ্রীষ্টাব্দে রামানুচার্যের মত প্রখ্যাত ও জনপ্রিয় আচার্যকেও তাঁর কর্মক্ষেত্র শ্রীরঙ্গম থেকে মহীশূরে পঁচিশ বছরের জন্য চলে যেতে হয় ।

642 খ্রীষ্টাব্দে পল্লবরাজ প্রথম নরসিংহবর্মণ চালুক্যদের রাজধানী বাতাপি ধ্বংস করেন এবং নগরের উপাস্য গণেশমূর্তি হরণ করে নিয়ে আসেন শুধু নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন ও চালুক্যদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য । সাথে অবশ্যই দেবতা গণেশের প্রতি অশ্রদ্ধাও ছিল। 

দশম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় ইন্দ্র তাঁর চরম শত্রু প্রতিহারদের কালপ্রিয় মন্দির ধ্বংস করেন ।

প্রথম ও দ্বিতীয় কুলথুঙ্গ চোল ছিলেন ধর্মে শৈব । তাঁরা বহু বৈষ্ণবকে হত্যা করেন । দ্বিতীয় কুলথুঙ্গ চোল এমনকি একটি বিষ্ণু মন্দির ধ্বংসের পরে বিষ্ণু বিগ্রহ মহাসাগরে নিক্ষেপ করেন ।

অষ্টাদশ শতকে পেশোয়া নানা ফড়নবিশের মারাঠা সেনা টিপু সুলতানকে যুদ্ধে হারিয়ে বিখ্যাত শ্রিংগেরি মঠ ধ্বংস করে । কৌতুহলদ্দীপক তথ্য হল টিপু এই মঠটি পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন ।

শৈব ও বৈষ্ণবদের পারস্পরিক শত্রুতার সমান্তরালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং বেদবিরোধী ধর্মের ( বিশেষতঃ বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম ) মধ্যে সংঘর্ষের এবং বৌদ্ধ ও জৈনদের উপরে অত্যাচারের বহু উদাহরণ রয়েছে । বৌদ্ধ এবং জৈনদের প্রতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রথম থেকেই অপছন্দ , বিরূপতা এবং অসহিষ্ণুতা ছিল । রামায়ণে আমরা দেখি বস্তুবাদী ভোগের পক্ষে সওয়াল করার জন্য পুরুষোত্তম রাম জাবালিকে বৌদ্ধ এবং তস্কর বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন । অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বেদবিরোধীদের ঘৃণাভরে বৃষলা বা পাষণ্ড বলেছেন । 

জৈন ও ব্রাহ্মণ্য শত্রুতার প্রাচীনতম উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের ' আয়ারঙ্গসুত্তম ' গ্রন্থে । সেখানে আছে জৈন সন্ন্যাসীরা চর সন্দেহে অভিযুক্ত হবার ভয়ে দিনে লুকিয়ে থাকতো ও রাতে ঘোরাফেরা করতো ।

তৃতীয় শতকের বৌদ্ধগ্রন্থ ' দিব্যবদন ' - এ লিপিবদ্ধ আছে যে পুষ্যমিত্র সুঙ্গ চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে বহু বৌদ্ধস্তূপ ধ্বংস করে , বহু বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দিয়ে , বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হত্যা করতে করতে সকলা বা শিয়ালকোট পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন ।

হিউয়েন সাং এর বিবরণে পাওয়া যায় গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক গয়ার বোধিবৃক্ষটি কেটে ফেলেন এবং স্থানীয় এক মন্দির থেকে বুদ্ধমূর্তি অপসারিত করেন । হুণ শাসক , শৈব মিহিরকুল ষোলোশো বৌদ্ধস্তূপ ও মন্দির ধ্বংস করেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেন ।

একাদশ শতকে কলহন তাঁর রাজতরঙ্গিনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন যে জনৈক কাশ্মীরের রাজা রাজকোষ সমৃদ্ধ করতে বহু বুদ্ধমন্দির ধ্বংস করে সুবর্ণনির্মিত মূর্তিগুলি গলিয়ে ফেলেন ।

আরো উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি না করে দুটি বিষয় উল্লেখ করেই এই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই । প্রথমটি হল অন্যের উপাসনালয় দখল করে নিজ উপাসনালয়ে রূপান্তরিত করা ভারতে ইসলামের অবদান নয় । ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগে এমন অনেক উদাহরণ আছে । যেমন কাশ্মীররাজ ক্ষেমগুপ্ত শ্রীনগরের বৌদ্ধ মন্দির জয়েন্দ্রবিহার ধ্বংস করে সেইসব উপাদান দিয়েই ক্ষেমগৌরীশ্বর নামে একটি মন্দির তৈরী করেন। বিখ্যাত তিরুপতি বালাজি ও বৈষ্ণোদেবী মন্দির প্রকৃতপক্ষে ছিল জৈনদের মন্দির । বৈষ্ণোদেবী আসলে ছিলেন জৈনদের উপাস্য দেবী পদ্মাবতী ।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল ভারতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের এক প্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সামরিক শিক্ষার উদ্ভব হয় শঙ্করাচার্যের অব্যবহিত পরেই । প্রাচীন সাহিত্য থেকে জানা যায় দক্ষিণভারতে মন্দির সংলগ্ন ' সালাই ' ও ' ঘটিকা ' -য় ব্রাহ্মণ ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত । পার্থিবপুরমের এক প্রাচীন নথি ও বিভিন্ন শিলালিপিতে প্রাপ্ত ' কট্ট ' ও ' ভট্ট ' ব্রাহ্মণদের সামরিকশিক্ষাকে নির্দেশ করে । আদি মধ্যযুগের ধর্মীয় সংঘর্ষে ' সালাই ' ও ' ঘটিকা ' -য় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ' কট্ট ' ও ' ভট্ট ' দের বিশাল ভূমিকা ছিল ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে উদার , সহিষ্ণু , হিন্দু সংস্কৃতিতে হিংস্রতা ও অসহিষ্ণুতা যথেষ্টই ছিল । বহু স্রোতের মিলনে যে হিন্দু সংস্কৃতির উৎপত্তি সেই সংস্কৃতিও সহযোগিতার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতিকে উৎপীড়ও যথেষ্ট করেছে । অর্থাৎ ভারতে অসহিষ্ণুতা ইসলামের অবদান নয় । সাম্প্রদায়িকতার যাবতীয় দায় ইসলামের ওপরে ফেললে ভারতে হিন্দু মুসলমানের যৌথ সাধনারও যে এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে তাকে অস্বীকার করা হবে । বরং নিজেদের অসহিষ্ণু অতীতকে স্বীকার করে নিয়ে পথ চললে পথচলা অনেক সহজতর হবে।

4 comments:

Prabir Bhattacherjee said...

সমৃদ্ধ হলাম।

Mita ghosh said...

ভীষণ তথ‍্যসমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগলো।

ANKUR ROY said...

ধন্যবাদ জানাই।

ANKUR ROY said...

লেখা সার্থক হল । ধন্যবাদ দিদি।