সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 পজিটিভ

 বিকাশ সেনগুপ্ত

মাস্টারমশাই পড়াতে পড়াতে কথাটা বহুবার বলেছেন__"মানসিকতায় সব সময় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করবে। জীবন কিন্তু ছোট নয়। যা করার, যা মহান হওয়ার এই জন্মেই হতে হবে। পরজন্মের কল্পনায় ভেসে যেওনা। তাহলে এ জন্ম কে অপমান করা হয়। ক্লাসের গাল-গল্পে তো এরকম কত কথাই শোনা যায়, কতজন তা আর মনে রাখে। যারা মনে রাখে, তারা জীবনদর্শন টাই বদলে নিতে পারে। বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে কঠিন বাস্তবকে মূল্য দিতে পারে। সময় মানুষের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা নেয়। সেটার জন্য সবাইকেই প্রস্তুত থাকতে হয়। সন্তানের মৃত্যু ও মেনে নিতে হয়। আসলে মানব জীবন কখনই এক সরলরেখায় বহতি নয়। বাকি নদীর মত বহমান। যারা কষ্ট করে মরে তারা পেলে না কিছুই। যাদের বৈভব তারা সুখের সাগরে বসে আছে। মনোময় এর সু _ছাত্র হিসেবে খুব সুনাম আছে। সবদিক থেকেই ছেলেটি খুব ভালো।স্কুলের যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খেলাধুলা সব এতে অংশগ্রহণ এবং পুরস্কার পাওয়া প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। স্কুলের ছাত্ররা ওকে একডাকে চেনে। খুব অভাবী বাড়ির ছেলে। বাবা মা কে ছেড়ে নতুন বিয়ে করেছে। কিন্তু এইবারে কোনো ছেলেপুলে হয়নি। ওর মা পরিচারিকা। লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। এই নিয়ে মনময় কে কোনদিন দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি কারো কাছে। ও ওর মায়ের কাজকে সম্মান করে। বাবার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে ভাবে না। কিন্তু বাবার বিরুদ্ধেও কোন কথা আজ পর্যন্ত ওর মুখে শোনা যায়নি। বিরল মানসিকতা। নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকে। এইতো সবে ক্লাস টুয়েলভে। এখনো অনেক পথ বাকি। অমবিকা মাস্টার ওর সব মাস্টারমশাইদের বলে প্রাইভেট টিউশন বিনা বেতনে করে দিয়েছে। এটা নিয়েও ও যে খুব মানসিকভাবে ছোট হয়ে গেছে তা নয়। আসলে কঠোর অভাব মানুষকে জীবনযাপনের অভ্যাস শেখায়। ওর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ওর বাড়ি থেকে স্কুলটা তিন মিনিটের।টিফিনের সময় টুক করে বাড়ি চলে এসে আগের দিনের ভিজে ভাত খেয়ে আবার স্কুলে চলে যায়। মনোময় বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারতো। কিন্তু নিজের অবস্থা বুঝে সে আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়েছে। ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক হতে চাই। যার বাড়ির চালের সরকারি ট্রিপল, ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখা যায়, সেও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে ঘুরে দাঁড়ানোর, স্বপ্ন দেখে উঠে দাঁড়ানোর। স্কুলের শিক্ষকদের ওপর ওর মা'র অপার শ্রদ্ধা। অল্প বয়সে বাড়ির লোক বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল রূপবতী বলে। রূপ থাকলে বাড়িতে অত্যাচার বারে এই ধারণা থেকেই ওর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তো সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। এর জন্য মা কাউকে দোষ দেয় এমনটা নয়। সব মুখ বুজে সহ্য করার ক্ষমতা মা-ছেলে দুজনেরই আছে। এমন একটা পরিবারে মনোময় আছে যে বাড়িতে এক বেলা রান্না হয় তাও রাত্রিবেলা। দিনের বেলা কাজের বাড়ি থেকে খাবার দেয়। সেটা যাতে নষ্ট না হয়ে যায় ওর মা এক সময় এসে খাবারে জল ঢেলে দিয়ে যায়। যারা ঈশ্বর তত্ত্বে বিশ্বাস রাখেন তারা বলেন ঈশ্বর তাদেরকে ভয় পান যারা চুপ থাকে।  ঈশ্বর আবার তাদের সহায় যারা চেষ্টা করে।


  ওর পরিত্যাজ্য বাবা মানুষটা ভালো নয়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। তার উপর যা হওয়ার হয়ে হয়ে গেছে রাস্তায় দেখা পেলেই মনোময় কে মা র্নিয়ে হাজার কথা শোনাবে। স্বভাবে নেশাখোর। মনোময় ওর কথা মন দিয়ে শুনে কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়। চোখেমুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। কিন্তু কিছুতেই মুখ খোলে না। ওর পরিত্যাজ্য বাবা লোক মুখে বলে আমাকে বললেই আমি সাহায্য করতে রাজি আছি। কিন্তু এই হতচ্ছারী কে নয়।। ও মনে করলেই বাবার কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ও কথা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি। ও যখন ওর মায়ের গর্ভে তখনই ওর বাবা ওর মাকে ছেড়ে অন্য জনকে বিয়ে করে। তারপর বহু কষ্ট করে মনোময় কে বড় করে তুলেছে ওর মা। কোনদিন ভাগ্যের দোহাই দিতে দেখেনি কেউ। বেঁচে থাকাটাই এ বিশ্বে চরম বিস্ময়ের। সম্পর্ক ভাঙে গড়ে। বেঁচে থাকার জন্য যা করার প্রয়োজন ওর মা তাই করে। মা ছেলের জীবন দর্শনের কি অদ্ভুত মিল। অম্বিকা মাস্টার মাঝেমধ্যে  টুকটাক সাহায্য করে। মনোময় তাতে না বলে না। মানুষের জীবনে প্রয়োজন আছে। অভাবীরা সেটা খুব ভালোভাবেই বোঝে। মনোময় এর সাথে ওর মার দেখা হয় রাত্রিকালে। সব বাড়ির বাড়ির কাজ শেষ করে তারপর ভাঙ্গা সাইকেল ঠেলে কোন ক্রমে  বাড়ি ফেরা। সাইকেলটার অদ্ভুত দর্শন। তীব্র ঘটাং ঘটাং শব্দ।  দীর্ঘকাল তেল পড়েনি। ঘন্টি টার কন্ঠস্বর ভেঙেছে। বসার সিট টা কোনক্রমে টিকে আছে। পুরনো হয়ে যাওয়া কয়েকদিনের খবরের কাগজগুলো ফাটা চটের ব্যাগে করে মনোময়ের‌ জন্য নিয়ে আসে মা। রাত্রিবেলা গরম খাবার দুজনে একসাথে খায়। এই খাওয়াটাই হলো তীব্র যন্ত্রনার। মনোময় পড়ে ঘরের মেঝেই, পাশে বসে মা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়; বোঝা যায় পরের বাড়ি কাজ করে মার হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। ওর চোখ ভিজে বইয়ের পাতায় টপটপ জল পড়ে। মেনে নিতে পারে না, আবার মেনে নিতেও হয়। অভাবির এরচেয়ে কিবা করার আছে। মনোময় দাতে দাত চেপে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে। সামনে আরো কঠিন লড়াই। মায়ের কষ্ট দূর করতেই হবে। একদল মানুষ যাদের অর্থ উপচে পড়ে, অন্যদলের কঠিন দরিদ্র। তারা মরছে নিদারুণ কষ্টে। অমবিকে বাবু মনোময় কে একদিন বলেছিলেন__অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া, বাকি যে কোন স্বাধীনতা অর্থহীন। সেটা সে মরমে মরমে বুঝতে পারে। বন্ধুরা ওকে খুব সাহায্য করে। কেউ দয়া দেখায় না।


হঠাৎ সেদিন ইউরোপের ইতিহাসের পাতায় গভীরভাবে নিমগ্ন। অন্য দিনের মতো আজও মা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাড়ির বাইরে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বরে কে যেন তীব্র আর্তনাদ করে বলছে__হারামজাদি; অম্বিকা মাস্টারের সাথে পীড়িত জোটানো চলছে। কি ভেবেছিলি কেউ জানতে পারবে না, তুই দেখিস দুচোখে, তোকে দেখে হাজার জোনা। মনোময় বইটা ছেড়ে বাইরে যেতে যাবে মা হাতটা টেনে ধরে বললো যাসনা বাবা ওটার স্বভাবই এরকম, একজনের সাথে সংসার করছে তাতেও আমার পিছু ছাড়ে না। ছাড়ো তো, বলে হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে মনোময় বাইরে এসে দেখল হ্যাঁ যা ভেবেছে তাই, ওর বাবা। বলল তুমি যাবে এখান থেকে? না পাড়ার সবাই কে ডাকবো। কেন অশান্তি করতে আসো দীর্ঘদিন তো আমরা একসাথে নেই, তাও এত রাগ। কিছু আরো বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মনোময় হাতটা ধরে টেনে নিয়ে কিছু দূরে গ্রামের মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে এলো। আর বলল ভবিষ্যতে খারাপ কথা বললে__আমিও কিন্তু আর তোমাকে ছেড়ে কথা বলবো না। কথাটা যেন মনে থাকে। তারপর বাড়ি ফিরে এলো। এসে দেখলো মায়ের দুই চোখের জল। মনোময় বলল একটা নোংরা লোক তোমাকে কি সব বলে গেল সেসব নিয়ে চিন্তা কর কেন। ও নিয়ে চিন্তা করে কোন লাভ আছে। মনময়ের সেদিন আর কোন পড়াশোনা হল না।পরের দিন স্কুলের পথে অম্বিকা মাস্টারের সাথে দেখা হল, অম্বিকা বাবু সব ঘটনা জানেন। শুধু স্মিত হাসি হেসে বললেন কত কিছুই তো ঘটে সব মনে রাখতে গেলে চলে; বাদ দাও তো; নিজের কাজে মন দাও। মনে রাখবে আজ তোমার অভাব আছে আহা!  উহু করার লোকের অভাব হবে না, কিন্তু সেদিন তুমি দাঁড়িয়ে যাবে সেদিনও তোমার পূর্ব বস্তা নিয়ে কথা বলতে তাদের রুচিতে বাঁধবে না। এটা মাথায় রেখো। ইংরেজিতে তুমি খুব ভালো। সেখানে তো প্রেসিস, সামারি তৈরি তো করো, জীবনটাকে সেই ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলো। সব কথাতে কান দিও না।মনোময়ের মনে প্রকাশ না হলেও এই অম্বিকা মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্কে একটু ভিন্ন রকমের শ্রদ্ধা আছে। শুধু মনোময় মাস্টারমশাই কে বলেছিল__কতদিন আর কতদিন স্যার। স্যার তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিলেন ততদিন যতদিন না তুমি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছ। ওর মা অন্যদিনের মতো সকাল বেলা কাজে বেরিয়ে গেছে। মন্ডল বাড়ির বড় দিদির নাতনিটি মনময়ের র সাথে পড়ে। শিমুল ফুল। পদ্মের সাথে তো তুলনা হয়না। মনোময় সম্পর্কে হাজার কথা শোনাবে। নাতনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মনোমযয়ের মাকে দিয়ে প্রতিদিন পায়ে গরম তেল মালিশ করায়। ছেলেটাকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দে, কি করে কলেজের পড়া টানবি , এইরকম মন ভাঙ্গানি কথা প্রায় প্রতিদিনই বলে। মনোময় এর মা শুনে। কিন্তু কোন উত্তর করে না। দেখে যার বাড়িতে কাজ করে খায় তাকে অসম্মান করব তা কি হয়। মনোময় একজন প্রকৃত মানুষ। আর ওর মা প্রকৃত মা। অম্বিকা মাস্টার তার নামে যে মাঝে মাঝে কোন চটুল মন্তব্য শোনে না এমন নয়, কিন্তু উনি কান্ দেন না। সাহিত্য নিয়ে চর্চা। তাই মানুষ চেনেন। আর একমাস আছে তারপর মনোময় এর ফাইনাল পরীক্ষা। ওর মা এই কদিন গোয়ালাকে এক পোয়া দুধ দিতে বলেছে। শুনে মনোময় বলল ফালতু খরচ করে কোন লাভ আছে। একে এত কষ্ট। মা শুধু বলল __একটু দুধ ই তো। মনোময় আর কোন কথা বলল না। দুধ কাকু মনোময় কে খুব ভালোবাসে। ও যে খুব ভালো ছেলে এটা সবাইকেই বলে।


পরীক্ষার সময় এসে গেছে। কাল থেকে পরীক্ষা। অম্বিকা বাম্বু হঠাৎ বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দিলেন মনোময়। মনোময় তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে বলল বলুন স্যার। এই নাও তোমার জন্য কয়েকটা কলম এনেছি, একটা বোর্ড। আরেকটু এগিয়ে এসো কানে কানে কিছু কথা আছে বলে ই পকেটের মধ্যে কিছু টাকা পুরে এ দিল। মনোময় একটু ইতঃস্তত করার আগেই স্যার বললেন"এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, ওটা বড়দের ভাবনা। তুমি শুধু ভবিষ্যতের ইতিহাস নিয়ে ভাবো। মনোময় স্যারকে প্রণাম করলো। বলল স্যার পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবেন তো। স্যার বললেন নিশ্চয়ই ওটা আমার ডিউটি। স্যার বললেন যাও পড়ো। মনোময় বাড়ির ভেতরে চলে গেল। মনময়ের মা কাজের বাড়িতে কয়েকদিন ছুটি চাইল। মন্ডল গিন্নি কিন্তু ছুটি দিতে নারাজ। কি কথা। আমাদের ছেলেউ তো পরীক্ষা দেবে আমরা কি ছুটি নিচ্ছি। তোর আবার ছুটি কিসের। মনোময়ের মা বলল__ দিদি যে কটা দিন আসবো না হিসেব করে বেতন কেটে নিয়।ওর পরীক্ষার দিনগুলোতে ওকে যদি একটুও হাতে হাতে করে দিতে না পারি ভগবানও ক্ষমা করবে না। যায় বল আর তাই বল একবেলা হলেও ঘরের কাজ কিন্তু গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে, এই বলে রাখলাম। মনোনয়ন মা বলল ঠিক আছে আসতে একটু দেরি হবে তাহলে আসব। তাই হবে। তোর ছেলে মনে হয় একাই পরীক্ষা দিচ্ছে। মনোময় এর মা "বিহু" ।
বিহু জবাব দিল কি আর করি বলুন অভাবীদের বেঁচে থাকা! বাবা! আবার বড় বড় কথা বলছে। বিহু আর কোন কথা বলল না। কাজ সেরে ভাঙ্গা সাইকেল চেপে বাড়ি চলে এলো। খুব ভোরবেলা উঠে গরম ভাত একটু মাছ একটু চাটনি তৈরি করে মনোময় কে পরীক্ষার আগে বেড়ে দিল। পাশের একটা স্কুলে পরীক্ষা। পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে। মনোময় একটু আগের থেকে বেরোলো।মায়ের পায়ে হাত রেখে প্রণাম করতে গিয়ে মায়ের সেই খোঁচা হাতটা মনোময় মনকে আবার পীড়া দিল। মনে মনে কাঁদলো। ভাবলো মা একদিন তোমার এই কষ্ট আমি দূর করব ই। আস্তে আস্তে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। অম্বিকা বাবু সমস্ত কলেজের খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন।। কয়েকটা কলেজ ও ভেবে রাখলেন। রেজাল্ট আউট হওয়ার পর দেখা গেল মনোময়ন নববই শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। আর মন্ডলবাড়ী ছোট নাতনি ইতিহাসে ডাহা ফেল। তাই নিয়ে বিহু কে যে কত কথা শোনালো তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিহু জানত সে তো জয় করেই ফেলেছে। মনে মনে ছেলের সাফল্যে গর্ব হচ্ছে। অম্বিকা বাবু ওকে একটা ভাল কলেজে ভর্তি করে দিলেন। একজন টিউটরের কাছে ও টিউশন ঠিক করে দিলেন। কিন্তু কলেজের টিউশনের বেতন একটু বেশী। তার উপর ইনি গ্রামের মানুষ নয়। মনোময় চায়না তার অবস্থার জন্য কেউ তাকে দয়া করুক। কিন্তু নিজের বর্তমান অবস্থাটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। অম্বিকা বাম্বু কয়েকটা টিউশনি যোগাড় করে দিলেন। বললেন এর থেকে তোর পড়ার খরচ নিজের খরচ চলে যাবে। কলেজ শুরু হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন ক্লাস করার পর একটি মেয়ে হঠাৎ একদিন মনোময় কে বলল হায়, আমি রিনি তুমি মনোময়। মনোময় সুঠাম চেহারার অধিকারী। সুন্দর। অনেকগুলো গুণের অধিকারী। বলল হ্যাঁ কিন্তু তোমাকে তো আমি চিনি না।মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল পৃথিবীর সবাইকে তোমায় চিনতে হবে তার দিব্যি তো তোমাকে কেউ দেয়নি। আমি তোমার বান্ধবীর প্রণয়ীর কাছে তোমার কথা শুনেছি। আমি ইংলিশ অনার্স। কিন্তু তুমি আমাকে আইডেন্টিফাই করলে কিভাবে। চিনে নিলাম। এই প্রথম মনোময় প্রাণ খুলে হাসল। রিমি বললো আমি তোমার সম্পর্কে জানি। তোমার মার সম্পর্কেও জানি। মানুষ তার নিজের অবস্থার জন্য দায়ী নয় দায়ী এই ব্যবস্থাটা। তাই এটাকে যদি বদলানো যায় মানুষের স্থানিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। কথাটা নতুন শোনালো। মনোময় একটা মোবাইল ছিল রিনি ওর কাছ থেকে নাম্বারটা নিল। বলল আমার বাবা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এর ব্রিগেডিয়ার। আমি বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। মনময় কিছুটা আন্দাজ করে বললো আমাদের কিন্তু কিছুই নেই। রিমি বলল__সো হোয়াট? আজ কলেজ শেষে আমি তোমার সাথে তোমার বাড়ি যাবো। তোমার মায়ের সাথে পরিচয় করে আসবো। মনোময় ইতস্তত করল। এর আগে কেউ আমার বাড়িতে ঢোকেনি ।বাড়িতে বসতে দেবার ই ্জায়গা নেই তার উপর এত ধনীর মেয়ে। বলল দেখো আমাকে অপ্রস্তুতে ফেলোনা। রিনি বললো অপ্রস্তুতে পড়লে পড়বে, প্রস্তুত থাকো না কেন? তার জন্য কি আমি দায়ী। শেষ পর্যন্ত মনোময় এর সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে ওর বাড়ি এলো। সন্ধের সময় শব্দ সাইকেলে মা এলেন।আর দেখলেন একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে মাটিতে বসে আছে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল তুমি কে মা? আমি রিনি।মনময়ের সঙ্গে এক কলেজে পড়ি। আপনার কথা অনেক শুনেছি।তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ।আমাদের ভাঙ্গা দেওয়াল টিনের চালে ত্রিপল এখানে আসতে তোমার মন চাইলো। মাসীমা বলে একটা প্রণাম করে বলল আমাকে এতটা ছোট করে দিলেন ? আরে না না আমি সেরকমভাবে বলিনি। আসলে কেউ তো এই জনম দুখিনীর ঘরে আসেনা। তাই একটু অবাক হলাম। মাসি আপনিতো খুব সুন্দর কথা বলেন। নিশ্চয়ই আপনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তাই না। স্মিত হেসে বললো কই আর কি ক্লাস এইটে পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গেল। ক্লাসের দ্বিতীয় ছিলাম। তারপর তো সব গন্ডগোল। বাড়ির লোকেরা খোঁজ খবর নেয় না। তাই নিজের পথ নিজেকেই করতে হলো। রিমি বললো যা করেছেন বেশ করেছেন। আপনার জীবন, আপনি যা খুশি করতে পারেন সেই নিয়ে অন্য লোকের এত দয়া দেখানোর কিছু নেই আর কিছু বলার নেই। মাসি আপনাদের দু'জনকেই বলছি আমার বাবা বলেন__নিজের যোগ্যতা কে ছোট করে দেখতে নেই। মনোময় একদিন ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়। মা বললো সবই সবার আশীর্বাদ। কিন্তু তোমাকে আমাদের বাড়ীতে কি খেতে দেয় বলতো। রিনি এক গ্লাস জল চেয়ে নিল। মাটির হাড়ি থেকে জল এনে দিল মা। তুমি তো বললে তুমি আর মনোময় একসাথে পড় না তাহলে ওকে চিনলে কিভাবে? রিনি উত্তর দিলো আমার বান্ধবী প্রণয়ী ওর কথা আমাকে বলেছিল । শুনেছি খুব ভাল সংস্কৃতিতে খেলাধুলায় এমনকি পড়াশোনায় পর্যন্ত।তাই ওর সঙ্গে পরিচয় করার সাথে সাথেই তো আমি ওর বাড়ি চলে এলাম।মাসী এবার কিন্তু আমি মাঝে মাঝেই এভাবে চলে আসব আপনাদের জ্বালাতন করতে। বুঝলে রিনি আসলে আমি অন্যের দুয়ারে কাজ করি তো তাই আমার বাড়িতে কেউ আসে না। তাছাড়া আসলেও বসতে দেওয়ার মতো জায়গাও নেই। তুমি এত বড় বাড়ির মেয়ে। তোমাকে যে ঠিক কিভাবে আপ্যায়ন করবো তাও তো জানিনা। যদিও বা জানি উপায় নেই। পোড়া কপাল আমাদের আরো আগে কেন আপনাদের সাথে পরিচয় হয়নি, রিনি বলল। এত নিদারুণ অভাব এর মাঝখানে মনে হয় যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাকে কুর্নিশ। আমাদের তো অভাব নেই তাই ও ভাবীর মন কেমন হয় সেই জ্ঞান ও আমাদের নেই। তবে একটা আমি কথা দিচ্ছি মাসি __আজ থেকে মনময়কে আমি সব দিক দিয়ে সহযোগিতা করব। মনোময় কিছু বলার আগেই রিনি বলে ফেলল এতে আপনাদের ছোট হওয়ার কিছু নেই। একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুর পাশে দাঁড়াবে। আমি ওর পাশে থাকব ওকেও তো পাশে থাকতে হবে। কি মনে হয় কিছু তো বলো। মনোময় এর আগে রিনির মত কাউকে দেখেনি। প্রয়োজন লাগবে নিশ্চয়ই বলবো।ও তার মানে আমি একমাত্র তোমার প্রয়োজনেই লাগতে পারি অন্য কিছুতে নয়। না না আমি তা বলতে চাইনি__আসলে কেউ আগে তো কখনো এভাবে বলেনি। তারপর তোমাকে সেভাবে জানিনা চিনিনা। তাই  অপ্রস্তুতে পড়ে গিয়েছিলাম। প্রথম পরিচয় তুমি যেভাবে পাশে দাঁড়ালে তা অনবদ্য। এইটুকু সময়ের মধ্যে রিনি কিন্তু মনোময় এর মনে যে ঝড় তোলার তা তুলে দিয়েছে। মনে হয় যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। কি মায়া, একি ত্যাগ, একি প্রতিমূর্তি
এটি ঠিক কি তা সে বুঝে উঠতে পারল না।প্রথম পরিচয় একজন সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার কথা কোন দায় বদ্ধতা থেকে বলতে পারে।, তা আশ্চর্য করল। মানুষ মরে কিন্তু মানুষ যে এভাবেও বেঁচে থাকে সেটাই বড় আশ্চর্যের। কোথায় বৈভবী কন্যা, কোথায় কাজের মাসির ছেলে। দুই ভিন্ন মেরুর তীব্র টান। এরকম তো কারো ক্ষেত্রে আগে হয়নি।না না ওর কাছ থেকে হাত পেতে নেওয়া অপরাধ অভাব থাকুক তোমার নিজের মতন করেই লড়ে যেতে হবে। রনি বলল__কি ভাবছ মনে মনে। নানা তোমাকে অপ্রয়োজনে সাহায্য করবো না। আর তুমি তো নেবেই বা কেন? এ নিয়ে এত ভাবনার কিছু নেই। বলুন মাসি আপনারা কেমন আছেন। মাসী বললো চলে যাচ্ছে মা, ওই কোন রকমে। তারমানে আপনারা ভালই আছেন। এটা জেনে খুব ভালো লাগলো। আপনাদের ভালো থাকাটাই কামনা করি। মনোময়, মাসি আজকে উঠতে হব। তোমায় একটু এগিয়ে দিয়ে আসি মনময় বলল। এটাত তোমার ডিউটি বলে খুব জোরে হেসে ফেললো। কি অপূর্ব। প্রতিমুহূর্তে কোন এক তূনির যেনো সোজা হৃদয় টা ফালাফালা করে দিচ্ছে। কোথায় গরিবের সেই মানসিকতা, এত ভালোলাগা। প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা। এও সম্ভব। যা কেউ কোনদিন করেনি মাসি কে প্রণাম করি রিনি বলল__আপনি আমার মায়ের মতো কখনো নিজেকে মনের দিক থেকে গরিব ভাববেন না। আমি আছি আপনার পাশে। রিনির বাড়ি আরো  সাত কিলোমিটার দূরের শহরে। মনোময় ওকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে এলো।আর একটা টোটো বালা কে বলল ওকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিও দাদা। ঠিক আছে চাপুন। ষাট টাকা লাগবে কিন্তু। চলুন। মনোময়কে টাটা করে চলে গেল রিনি। বাড়িতে গিয়ে একটু খন চুপচাপ বসেছিল মনোময়।পেছন থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিনি কাটতে কাটতে মা বলল মেয়েটা সম্পূর্ণ অন্যরকম রে পারলে ওকে বুক দিয়ে আগলে রাখিস। মা কি বলছ। আমি তো তোর মা আমার কথাটা মনে রাখিস। নে একটু খেয়ে নে সন্ধ্যে হয়ে গেছে।

   
গ্রীসের ইতিহাসে তখন তীব্র লড়াই। কে বাঁচবে কি মরবে তা কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। ইতিহাসের আরো গভীরে ঢুকে মনোময় বুঝল জীবন সংগ্রামের কথা কই  ইতিহাসে। তা যেন খানিক নীরবে থেকে গেছে। মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে ছিল। হাতে নিয়ে দেখলপাঁচটা মিসকল। কল ব্যাক করে মনোময় বলল__সরি, আসলে সাইলেন্ট প্রোফাইলে ছিল বুঝতে পারিনি। তাছাড়া গ্রিক ইতিহাস এতই জটিল। বাবা তোমার মার সাথে একটু কথা বলবেন। মাসিকে একটু ডেকে দাও। কিন্তু কেন? তোমার সাথে পরে কথা বলবেন আগে তোমার মায়ের সাথে কথা বলুন। দাও মাসিকে ফোনটা। এতোটুকু পরিচয় কেউ যে এত আপন করে নিতে পারে তা জানা ছিলোনা। মা তোমার ফোন রিনি এর বাবা কথা বলবেন। মা ফোনটা নিয়ে বললেন__নমস্কার; বলুন। আমি মনোময় এর মা। উল্টোদিকে ব্যারিটোন ভয়েসে জিজ্ঞাসা করলেন ভালো আছেন। মনোময় কেমন আছে। সবাই ভালো আছে। আপনি একবার আমাদের বাড়ি আসতে পারবেন। কিন্তু আমার তো রোজই কাজ থাকে। যেদিন কাজ থাকবে না ফাঁকা থাকবে না সেদিন আসবেন। আপনার সাথে আমার কথা আছে। আর সঙ্গে মনোময় কে আনতে ভুলবেন না। আর হ্যাঁ সেদিন কিন্তু দুপুরে পারলে আমার বাড়িতেই খাবেন। আমি আবার টেলিফোন আপনাকে নেমন্তন্ন করলাম কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু খুব আশা করে থাকব। বলেই রিনিকে ফোনটা দিয়ে দিলেন। হ্যালো মাসি মনোময় কে দাও। হ্যাঁ বল, তাহলে কবে আসছো জানিও। আমি তোমাদেরকে নিয়ে আসব। আচ্ছা রাখছি।অভাবী মানুষের প্রত্যাশার চেয়ে মেয়েটা যেন খুব বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে মনোময় কে তার মাকে ।কারণ যা-ই থাকুক না কেন। মেয়েটা খুব আন্তরিক। ঠিক হলো রবিবার সন্ধ্যেবেলা  রিনিদের বাড়িতে যাবে। সেইমতো জানিয়ে রাখল। রিমি বলল বাবা তো দুপুরের খাবার কথাও বললেন। মনোময় বলল অন্য আরেকদিন হবে। তুমি এসে না নিয়ে গেলেও আমি ঠিক পৌঁছে যাব। সময়ের বেশ খানিকটা আগেই রিনি চলে এলো। ওর মা বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করল। হাতমুখ ধুয়ে গরিবের যা পরিধান আছে পরে নিল। একটা টোটো নিয়ে রিনিদের বাড়ি পৌঁছে গেল গিয়েে দেখল এই বাড়িতেই তো একদিন কাজের জন্য এসেছিল। আজ সেখানেই আমন্ত্রিত। এটা মনোময় জানেনা। দরজার বাইরে একটা নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে__'ব্রিগেডিয়ার প্রসন্ন প্রসাদ মুখার্জি'। রিনি জলখাবার নিয়ে এল।সঙ্গে রিনির মা অপরূপ সুন্দরী তার থেকে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু এক বার দেখলেও কাউকে কাউকে ভোলা যায়না। রিনির মা বলল আপনি। নমস্কার আমি মনোময় এর মা। ওপর থেকে ব্রিগেডিয়ার সাহেব নেমে এলেন।সবাই একসাথে বসে থাকলেও মনোময় আর বিহুর  আড়ষ্ঠতা কাটতে চাইছে না। ব্রিগেডিয়ার সাহেব তা বুঝতে পেরে প্রথমে বললেন__প্রথমত আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। মনোময় আর চুপ থাকতে না পেরে বললো এসব কথা কেনো বলছেন? তখন ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, একদিন তোমার মা আমার বাড়িতে কাজের সন্ধানে এসেছিলেন। এটা তুমি জানো না। রিনির মুখ থেকে তোমাদের বিবরণ শুনে আমি বুঝে গিয়েছিলাম। রিনি এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।আজ আপনারা এখানে এসেছেন আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ শুধু নয় খুশিও। আমাদেরকে বিরাট মানুষ ভেবে আপনারা যেন কোন কুন্ঠিত বোধ করবেন না।
রিনি বলে উঠলো এস মাসি তোমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখায়। প্রথমে ইতস্তত করলেও রিমির কথা কাটতে না পেরে ওর সাথে উঠে গেল।মনোময় যে ঐতিহাসিক হতে চায় ব্রিগেডিয়ার সাহেবের উত্তরেতে জানালো। রিনি তো উপরের সব ঘরে ঢুকে ঘুরিয়ে দেখালো। ব্রিগেডিয়ার জিজ্ঞেস করলেন কী বুঝলেন। বিহু উত্তর দিল__কি আর বুঝবো ভগবানের অসীম আশীর্বাদ। ঠিক বলেছেন আশীর্বাদ।কিন্তু আমার থেকে আপনাদের ওপর ভগবানের অসীম কৃপা তাই মনময়ের মতো এত বড় হৃদয় সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছেন। যে তার নিজের পূর্ববর্তী সমস্ত অবস্থা জেনেও কি চরম প্রশান্ত। এ রকম দেখা যায়না। আপনিও মহীয়সী ছেলেকে সঠিক পথে চালিত করেছেন।ওর ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল একদিন অবশ্যই মনোময় মহীরুহ হবে বলে আমার  বিশ্বাস। গল্প করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। ঘড়িতে নটা দশ ।মনময় বলল কাকু আজ উঠি অন্য দিন না হয়। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন__ডিনার না করে কোন ভাবেই নয় আমরা একসাথে সবাই খাব। আর একটা কথা তোমায় বলি মনোময়, একজন শাড়ি কারখানার মালিকের সাথে আমার কথা হয়েছে আশা করি তোমার মাকে ওখানে একটা সম্মানজনক কাজ দিতে পারব। তখন আর অন্যের বাড়িতে কাজ করার প্রয়োজন পড়বে না। আমি তোমাকে কল করবো। খুব শীঘ্রই জানাবো। কথা শেষ হলে সবাই টেবিলে একসাথে বসলো।বিহু বাবুদের বাড়ির খাবার টেবিল দেখেছে ঠিকই কিন্তু সেখানে বসে খাওয়া-দাওয়া সেত কল্পনাতেও আসেনা। আমি যে পরিচারিকা। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন কোনরকম সংকোচ বা দ্বিধা নয়'। রিনির মধ্যে আজ যেন শিশুর আনন্দ। কিছু একটা নতুন যেন আবিষ্কার করেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে বিহু প্লেট গুলো গুছিয়ে দিতে চাইলে সকলে বাধা দিল। মনোময় বলল এত খুব সাধারণ বিষয়। বাড়িতে হলে তো করতেই হতো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন মনোময় তোমার মার বিষয়টা অন্য। তাই তাকে এসব কাজ করতে দেওয়া খারাপ। আমরা করে নিতে পারব। ঘড়িতে সাড়ে দশটা। পরের দিন সকাল বেলা আবার কাজে বেরোতে হবে মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাঙা দেওয়াল তবু নিজের বাড়ি টানত। মনোময় ব্রিগেডিয়ার সাহেব এবং রিনির মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। উপদেশের সুরে ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন__তুমি পারবে জানি তবুও বলছি খাঁটি মানুষ চিনতে ভুল করো না। রাস্তায় বের হতেই টোটো দেখা গেল। রিনি সত্যর টাকা ভাড়া টোটো চালকের হাতে তুলে দিল। মনময় কিছুটা আপত্তি করেছিল তবে তা ধোপে টিকল না।


মানুষের জীবনের একটা সময়ে কোন মানুষ দেবদূতের মত আসে আবার চলে যায়। তাদের অবস্থান ক্ষণস্থায়ী। হয়তো তারা কল্পিত ঈশ্বরের প্রেরিত দূত। তারা মানুষ হলেও মানুষ নয়। সাক্ষাৎ দেবতা। যাদের কোন হিংসা নেই। যাদেরকে মানবতা দিয়ে মাপা যায় না, যাদের বিচার হয় মৃত্যুর পরে। আসলে মৃত্যুর পরে মানুষ কে চেনা যায়। বৈভব থাকলেও যে মানুষ ভালোবাসা জানে না সে মৃত। এই সভ্যতায় তার কোন মূল্য নেই। বৈভব মানুষকে বিলাসী করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। অভাবী মন চিরদিন সুখের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরে। সুখ বড় ফাঁকিবাজ। চট করে ধরাদেয়না। এমনি করে চলতে চলতে মনোময় এর তৃতীয় বর্ষের রেজাল্ট আউট হল, ও ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ইউনিভার্সিটি তে।ব্রিগেডিয়ার সাহেব খুব খুশি মনময়ের আশানুরূপ ফলে। রিনি ও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে তাতেও তিনি ভিশন খুশি। মনোময় এরপর চাকরি করে ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে পড়াশুনাটা বাড়িয়ে নেবে বলে পরিকল্পনা করেছে। খবর কাগজে দেখল মিশনারি স্কুলে টিচার নেবে। বেতন প্রতি মাসে কুড়ি হাজার।মা তো অনেকদিন হলো লোকের বাড়িতে কাজ বন্ধ করেছে এখন তিনি দস্তুরমতো চাকুরে। মনোময় যদি আবার স্কুলে চাকরি পেয়ে যায় তাহলে সোনায় সোহাগা। নির্দিষ্ট তারিখে ইন্টারভিউ হলো এবং মনোময় মনোনীত হলো। রিনির পুরো পরিবার খুশি। মানময়ের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে একটা ভালো বাড়ি তৈরি করার। ব্রিগেডিয়ার সাহেব ওকে সাহায্য করতে চাইলে মনোময় নিল না। ব্রিগেডিয়ার এর চোখেতে ও সম্ভ্রম অনেক বেড়ে গেল। কিন্তু কিছুদিন যাবত মনমের মায়ের শরীরটা যেন ভালো যাচ্ছে না। বুকে যন্ত্রণা। খাওয়া-দাওয়া নেই। মাথা ঘুরছে। কাজে ক্লান্তি আসছে।আসলে একটা সময় না খেয়ে এত মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে যে তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব মনোময় কে তার বন্ধু ডাক্তারের কাছে নাম লিখিয়েছে বলে জানাল। ডাক্তার দেখে অনেক কটা রিপোর্ট করতে দিল। ডাক্তারের চোখে মখে কি যেন একটা গভীর সন্দেহ লক্ষ্য করলো। মনোময় জিজ্ঞেস করল স্যার খারাপ কিছু কি? নানা আগে রিপোর্টগুলো আসুক। আর এই দুইদিনের ওষুধগুলো খান উনি তারপরে দেখা যাবে। মনোময় ডাক্তারের ফি দিতে গেলে ডাক্তার একটু মুচকি হাসলেন। তিনি তা নিতে অস্বীকার করলেন। বললেন আমি চেয়ে নেব। ইতিমধ্যে মনোময় এর জন্মদাতা বাবা মারা গেছেন। ছেলেটা খুব সেনসেটিভ মাকে বলল তবে নিজেও একটু থম মেরে গেল।কোথাও গিয়ে যেন লোকটার প্রতি তার একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল। আজ তার পরিসমাপ্তি ঘটল।পরের দিন সকালে এই প্রথম মনোময় মাকে লক্ষ্য করল যে মায়ের মাথায় সিঁদুর নেই। হাতের চুড়ি সব খোলা। এতদিনে তার মনে হয়েছে মা এসব পড়তো কার জন্য। এটা ভেবে নিজেই অবাক হলো। এতদিন তো এসব ভেবে দেখিনি। সবকিছু আছে যেন ওলটপালট হয়ে গেল। একটা বেইমানের জন্য মায়ের এত ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল। সে এই প্রথম অনুধাবন করল। মা এখন কয়েকদিন অফিসে যাচ্ছে না। আর চারদিন পর সব রিপোর্টগুলো পাওয়া যাবে। তারপর ডাক্তারের কাছে গেলে বোঝা যাবে রোগ টা আসলে কি। যথা সময়ে সব রিপোর্টগুলো নিয়ে মনোময় ডাক্তারের কাছে গেল। মনোময় আর ঋণী একসাথে গেল ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার সমস্ত রিপোর্ট টা ফলো করে বললেন ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে আমি ওভার টেলিফোনে বলেছি। যা ভেবেছি ঠিক তাই। মনোময় বলল__ স্যার আপনি নির্দ্বিধায় বলুন কি? ডাক্তার দীর্ঘসাস ছেড়ে বললো। ব্রেস্ট ক্যান্সার ফোর্থ স্টেজ। ইমিডিয়েট কেমোথেরাপি চালু করতে হবে। তাহলে লাইফস্পান আরো কিছুদিন বাড়ানো যাবে। তবে যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে সময় হাতে খুব কম। এক মুহূর্তের জন্য মনোময় এর সারা পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল। মনে হল কোন কিছুই সত্য নয় এ পৃথিবীতে। ঈশ্বর সেতো কল্পনা। জীবনের কোন মূল্য নেই। স্থির হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। রিনি সাহস দিয়ে বলল ভাবছো কেন আমি তো আছি। যা খরচ হবে সব দেবো। তুমি ধার হিসেবে নিয়ো পরে শোধ দেবে। এবার আর মন না করতে পারল না। পরের মাসের ঊনিশ তারিখ প্রথম কেমোথেরাপি দেওয়ার ডেট। ব্রিগেডিয়ার সাহেব সবকিছু অ্যারেঞ্জ করে রেখে দিয়েছেন। এই সময়টায় মনময়ের সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। কোন কিছুতেই সে একাগ্রতা টা নেই। যদি মা চলে যায় তাহলে কি নিয়ে বাঁচব। মনমের যে স্বপ্ন ছিল একদিন মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। তার আগেই কিমা শেষ হয়ে যাবে। মনে মনে কোথাও যেন লড়াইয়ের শক্তিটা হারিয়ে ফেলেছে বারবার। হোঁচট খাচ্ছে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে।জীবন যে এতটা কর্কশ হতে পারে সে ব্যাপারে তার এরকম ধারণা ছিল না। সে বারবার ভেঙে পড়ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু চোখে মুখে তার প্রকাশ ঘটল না।মা অসুখের ব্যাপারে জানতে চাইলে মনোময় বললো তেমন কিছু না সেরে যাবে। পরের মাসের ঊনিশ তারিখ হাসপাতালে সবাই হাজির ডাক্তার বাবুর সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার, মনোময় ও রিনি দেখা করল। একটা রিস্ক বন্ড এ সহি করতে হবে। এটাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই মেডিকেলে এথিকসে আমাদের এটা করতেই হয়। আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন, আমি ট্রিটমেন্ট স্টার্ট করি। ওরা বাইরে বসে আপেক্ষা করতে থাকলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তারবাবু বাইরে বেরিয়ে এসে কয়েকটা নির্দেশিকা দিলেন। যতটা ভেবেছিলাম দুর্বল ততটা নয়। তবে সাবধানে রাখতে হবে। হার্টবিট একটু কম আছে। এটাই মনে স্ট্রাইক করছে। মনোময় যা বোঝার বুঝে গেল। কিছুক্ষণ পর স্ট্রেচারে করে মাকে নিয়ে আস্তে আস্তে লিফটের কাছে নিয়ে গেল। ব্রিগেডিয়ার স্যার ডাক্তার বাবুর সঙ্গে গেলেন। তিনজন বাইরে বেরিয়ে টি স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ব্রিগেডেয়ার সাহেব নিজের গাড়িতে ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিল। মনোময় মায়ের প্রচুর যত্ন করে।কুটি নেড়ে দুটি করতে দেয় না। কয়েকটা দিন যাওয়ার পর হঠাৎ মায়ের খুব বাড়াবাড়ি হল। রিনিকে কল করলো। রিনির ফোনে কল লাগলো না। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের ফোন কানেক্ট হলে না। ডাক্তারবাবুর ফোন সুইচড অফ। বিপদে পড়ে গেল ছেলেটা। এই রোগী টাকে নিয়ে এখন কোথায় বা যায়। ঘটনাক্রমে ব্রিগেডিয়ার সাহেব কল করলেন মনোময় কে। মা কেমন আছেন? ভালোরে কাকু। এডমিশন করাতে হবে। আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। রিনি কেউ পায়নি।ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন কোন চিন্তা করবেনা ডাক্তারবাবু চেম্বারেই আছেন আমার সাথে কথা হয়েছে আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি তুমি আর রিনি ওনাকে নিয়ে চলে যাও। কিছুক্ষণের মধ্যে রিনি গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। দুজনে দুপাশে ধরে কোনক্রমে গাড়িতে তুললো মা কে। তারপর সোজা হাসপাতাল।ডাক্তারবাবু স্টেথোতে বুকটা দেখেই বললেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ইমিডিয়েট এডমিশন। সাথে সাথে ভর্তি করে দিল। এইবার মনময়ের চোখে জল। সম্পা আন্টি রিনির মা এসে উপস্থিত। দুজনে মিলে প্রচুর সান্তনা দিলো। ভর্তির পর ডাক্তারবাবু শুধু একটা কথাই বললেন ভগবানের উপর ভরসা রাখুন। ওনার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। হবার একটা অ্যাটাক হয়েছে। সাড়ে সাতটায় ভিজিটিং আওার সবাই ওনাকে দেখতে গেল, শুধু ক্ষীন মুঠি মনোময় মাথায় রেখে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। মুখে কিছু বলতে পারলেন না। তারা সবাই বাইরে চলে এলো। মনের কান্না আর থামে না। ও তো খুব চাপা স্বভাবের। তবু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। একজন মানুষ যার কেউ ছিলনা, স্বামী পরিত্যাক্তা, লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন, তার যখন সুখের শুরুর তখনই কি অসুখটা কাল হলো। রাত আটটা পনের ডাক্তারবাবু ঘোষণা করলেন___সি ইজ নো মোর। তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। মনোময় কেদেই চলেছে। হাসপাতালে ডকুমেন্টেশনের দু ঘন্টা লাগবে। তারপর বডি হ্যান্ডওভার করা যাবে। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে মনময়ের মায়ের কলিগ বন্ধুরা সব এসে হাজির। ওকে অনেকে অনেক কথা বলছে।মনোময় শুধু মনে মনে ভাবছে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। আমি যে ঐতিহাসিক হতে চেয়েছিলাম। হাসপাতালের এক কোণে ভাঙ্গা টুলটার উপর মনোময় বসেছিল। ওকে ঘিরে ছিল অপরিচিত সকলে। সবাই ওর পাশে থাকার আশ্বাস দিল। রিনি তো সারা জীবন পাশে থাকার আশ্বাস দিল। তবু মনময়ের হাতটা গাল থেকে একচুল সরলো না।

0 comments: