সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
স্কটল্যান্ডে মফঃসলের পথে মনস্টার নেসির আস্তানায়
প্রকাশ চট্টোপাধ্যায়
গতকাল স্কটল্যান্ডের এডিনবরা দেখে, আজ সকালেই, গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম লিজেন্ডারী-মনস্টার-নেসি খ্যাত লক-নেসএর উদ্দেশ্যে। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝদিয়ে, সুন্দর রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুবই কম। দুপাশে কার্পেটের মত সবুজ ঘাসে বিছানো ঢেউখেলানো উন্মুক্ত প্রান্তর, আর, তার মাঝে নীল-বেগুনী-গোলাপী মেশানো এক অপূর্ব রঙের অসংখ্য হিদার ফুল আলো করে ফুটে চারপাশের প্রকৃতির শোভা বহুগুণ বাড়িয়েছে। আশেপাশে প্রচুর পাইনের মত ঘন সবুজ গাছ। তাদের পেছনে মাঝে মাঝে ধুসর সবুজ পাহাড়ি টিলা। আশেপাশে কোথাও ঘরবাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট নদী, খাড়ি, আর লেক, এদেশে যাদের নাম লক। আর চারপাশে বুনো গাছে, নানা রঙের অয়স্র ফুল ফুটে আলো করে রেখেছে চারদিক। পরিবেশ বড়ই সুন্দর, বর্ণনার অতীত। চলতে চলতে আকাশ এবার বেশ মেঘলা কুয়াশায় ভরে গেল, আর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। এখানে সবসময়েই এরকম স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। একটু পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম ফোর্ট-উইলিয়াম। ইতিমধ্যে আবার আকাশ বেশ পরিস্কার হয়ে গেছে, সূর্যদেব আবার ঝলমল করেছেন।
এখানে খানিক সময় কাটিয়ে এরপর আমরা রওনা দিলাম ফোর্ট-অগস্টাসের উদেশ্যে। এটা লক-নেসের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটা ছোট শহর, যেখান থেকে লক-নেসের শুরু। একটু পরেই এসে যায় ফোর্ট-অগস্টাস শহর। একটু আগে থেকেই দেখলাম পাশ দিয়ে বহে চলেছে ওইচ নদী। মাত্র কুড়ি পঁচিশ ফুট চওড়া, কিন্তু তাতে বেশ গভীর কালো জল, দুর্বার গতিতে বয়ে গিয়ে এই ফোর্ট-অগস্টাসেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে লক-নেসের বুকে। সামনেই বেশ কয়েকটা ঘরবাড়ি। তার মধ্যে একটা এখানকার কাউনসিলের অফিস। এখান থেকে এই লক-নেসএ নানা রকম বোট রাইড এবং ক্রুজের আয়োজন করা হয়। সামনেই তার নানারকম সাইনবোর্ড। সামনে নদীটা বেশ একটু চওড়া হয়ে লক-নেসএ মিশেছে। সামনের ঘাটে নানা মাপের বেশ কিছু উন্নত মানের রঙচঙে বোট বাঁধা রয়েছে। পাশেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের(১৯১৪-১৯১৮) ওয়ার মেমোরিয়াল হল । নদীর ওপারে একটা ফোর্ট, বেশ রঙচঙে, সাজানো গোছানো। এই ফোর্ট আজ আর যুদ্ধের কোনো কাজে লাগে না।
এবার সামনেই দুপাশে সবুজ পাহাড়ের মাঝে সামনেই দেখা যাচ্ছে দিগন্তবিস্তৃত লক-নেস। আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম তার গভীর কালো জলের সামনে। তাকে দেখে এখন সমুদ্রের মত লাগছে। মেঘলা আবহাওয়া আর তার সঙ্গে প্রচণ্ড হাওয়ায় বড় বড় ঢেউ নিয়ে লক-নেস যেন ফুঁসছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়, চারপাশেই উচু পাহাড়ে আবদ্ধ এই লক-নেসের বিপূল জলরাশী, বড় বড় ঢেউ নিয়ে ভয়ংকর বিপদসঙ্কুল হয়ে ওঠে। অনেক সময় সমুদ্রের মত দুই তিন মিটার অবধি ঢেউ উঠে মুহূর্তের মধ্যে নৌকা ঢুবিয়ে দেয়।
এই লক-নেস, ইউ.কের গ্রেট-গ্লেন-মোর এর গ্যেইলিকএর একটি অংশ, যার বিস্তৃতি উত্তরে ইনভারনেস থেকে দক্ষিণে ফোর্ট-উইলিয়াম পর্যন্ত, এবং তার ব্যাপ্তি ষাট মাইলের ওপর। আর এর মধ্যে লক-নেসএর ব্যাপ্তি লম্বায় সাড়ে-বাইশ মাইল, আর চওড়া এক থেকে দেড় মাইল।
ইউ.কে. তথা স্কটল্যান্ডে লক-নেসএর মত এইরকম হ্রদ তো অনেকই আছে। তবে লক-নেস হ্রদটার নাম নিয়ে এত হইচই, কারণ এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এক দারুণ রহস্য। স্কটল্যান্ডের ফোর্ট-অগস্টাস থেকে ইনভারনেস অবধি ব্যাপ্ত এই লক-নেস এক অনন্য বিস্ময়। বিশ পঞ্চাশ বছর তো নয়, বহুকাল আগে থেকে, সঠিক সময় ধরে বলতে গেলে, সেই ৫৬৫ খৃষ্টাব্দে, যায়াবর আইরিশ ধর্মযাজক সেন্ট কলম্বা(যিনি স্কটল্যান্ডে খৃষ্ট-ধর্মের প্রচলন করেন) ওই লক-নেসএ এক ভয়ংকর জলচর দানবের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। তিনি যখন ওখান দিয়ে ইনভারনেস অঞ্চলে সেখানকার রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, তখন হ্রদের জলে স্নান করার সময় ভয়ংকর এক জলদানবের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত একটি লোকের মৃত্যুর কথা শোনেন এবং তার সমাধি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর সেন্ট কলম্বা নিজে ওই হ্রদে স্নান করতে নামলে, সেই দানব তাঁকেও আক্রমণ করতে আসে। তবে সেন্ট কলম্বা তাঁর ইষ্টদেবতার নাম জপ করতে করতে দানবটিকে কবার ''দুর হ, দুর হ,'' বলাতেই, দানবটা দুরে হ্রদের গভীর জলে পালিয়ে যায়।
সেই ৫৬৫ খৃষ্টাব্দে, প্রথম প্রচারের পর থেকে, ওই হ্রদের সেই ভয়ংকর দানব সম্পর্কে নানাধরণের অদ্ভূত সব কাহিনী, ক্রমশই লোকেদের মুখে মুখে ফিরে, তা আজ একত্রিত হয়ে পাহাড়ের মত জমা হয়ে উঠেছে। সে-সব বিবরণ লোকমুখে পল্লবিতও হয়েছে নানাভাবে। যেমন, সেই দানবের মুখ-চোখ দিয়ে নাকি আগুনের হলকা বের হয়। আর, তার সামনে কেউ পড়লে, তার চোখের সম্মোহনী দৃষ্টিতে সেই দানব নাকি নিস্পন্দ, নিঃসাড় করে রাখতে পারে। এইরকম আরও অনেক গুজব।
এরপর ১৯৩৩ সালের মে মাসে, সক-নেসএর ধার দিয়ে যখন রাস্তা তৈরি করা হচ্ছিল, তখন জর্জ স্পাইসার এবং তাঁর স্ত্রী গাড়িতে চেপে সেই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তাঁদের গাড়ির সামনে দিয়ে এক বিশাল আকারের অদ্ভূত ধরণের জন্তুকে রাস্তা পার করতে দেখেন। সেটির দেহ প্রায় ২৫ফুট লম্বা এবং হাতির সুঁড়ের মত ১২ফুট লম্বা গলা। তাঁদের ধারণা ছিল না, তাঁদের লক-নেসএর পাড়ে দেখা এই আজীব জন্তু থেকেই, সারা পৃথিবীর বুকে, লক-নেসএর দানব নেসির জন্ম হবে। এর পরপরই বিশ্বের নানা জায়গার সাংবাদিক-কুল এই লক-নেস অঞ্চলে ভীড় করতে শুরু করেন।
তখন, লন্ডনের বিখ্যাত সংবাদপত্র ডেলি-মেল, তৎকালীন এক বিখ্যাত জলজন্তু শিকারী মারমাডিউক ওয়েদারেলকে নিযুক্ত করেন, যাতে তিনি এই লক-নেসএর দানবকে জ্যান্ত পাকড়াও করতে পারেন। কদিন পরেই, লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউডিয়ামের কিউরেটার মশাই, এক সকালে ঘনঘন একজনের ফোন পেয়ে, ব্যস্ত হয়ে ফোন ধরে দেখেন, সেটি তাঁর পরিচিত জলজন্তু শিকারী মারমাডিউক ওয়েদারেলএর ফোন। ওয়েদারেল তাঁকে বলেন ''তিনি লক-নেসএ এসে এখানে এক চার-পেয়ে জন্তুর পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন, এবং তিনি নিশ্চিৎ, সেটি লক-নেস মনস্টার নেসির পায়ের ছাপ।''
এর পরই ডেলি-মেল কাগজে ঐতিহাসিক হেডলাইন হয়ে সেই খবরটি বের হয়, ''মনস্টার অফ লক-নেস ইজ নট এ লেজেন্ড বাট এ ফ্যাক্ট।''
এর পরই লন্ডনের বিখ্যাত ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিসট্রি মিউজিয়ামএর তরফে দেশের সবচেয়ে বড় প্রাণীতত্ববিদ লকনেসএ এসে এই তথ্য যাচাই করতে শুরু করে দিলেন।
কিন্তু হায়, তাঁর তদন্তে অচিরেই ধরা পড়ে গেল, ওই খবরটি আসলে একটি আস্ত ধাপ্পা, এবং ওই পায়ের ছাপটি আসলে এক বড় মাপের জলহস্তীর পায়ের ছাপ। ইনভারনেস মিউজিয়াম থেকে চুরি হওয়া জলহস্তির স্টাফ করা সেই পায়ের হদিসও পাওয়া গেল, যেটি লক-নেসএর তীরে ছাপ ফেলবার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল।
অবশেষে, ১৯৩৪ সালে এই দানবের এক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেল বলে মনে হল। পাওয়া গেল লন্ডনের বিখ্যাত এক গায়নোকোলজির শল্য-চিকিৎসক ডক্টর রবার্ট কেনেথ উইলসন এর তোলা ''সারজেন্টস ফটোগ্রাফ'' নামে বিখ্যাত এক ফটোতে। লন্ডনের ডেলি-মেল কাগজে ছাপা সেই ফটোয় দেখা গেল, হ্রদের ঘোলা জলের ভেতর থেকে আদিম যুগের প্লেসিওরস্ এর মত এক অদ্ভূত প্রাণী, জলের ওপর তার বিশাল লম্বা গলা বার করে মাথা উচু করে রয়েছে।
সেই ছবি কেউ বিশ্বাস করলো, কেউ করলো না। কিন্তু ইনভারনেসএর কাছে এই হ্রদের এই অদ্ভূত প্রাণীটি সম্পর্কে কৌতুহলের মাত্রা আর নানা ধরণের প্রাপ্ত বিবরণের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।
তখন অবধি নানা জনে, কমপক্ষে তিন হাজার বার, এই লক-নেসএ ওই প্রাণীটিকে দেখবার দাবি নানা সময়ে পেশ করেছে। তার মধ্যে কোনটা সত্যি, আর কোনটা গুজব যাচাই করা কি সোজা কথা ?
কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালে বিখ্যাত এই ''সারজেনস ফটোগ্রাফ''ও জাল এবং ফটোশপ করা বলে প্রমাণিত হয়। সত্যি বলতে কি ১৯৭৫ সালের ৭ ডিসেম্বর, লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ কাগজের এর এক প্রতিবেদনে এই বিষয়ে সবিস্তার খবর বের হয়েছিল, যেটি তখন অনেকের নজর এড়িয়ে যায়। তাঁদের মতে সেটি একটি অতিকায় ইল জাতের প্রাণীর ছবি। ১৯৯৯ সালে ''নেসি, সারজেনস ফটোগ্রাফ এক্সপোজড'' নামের একটি বই প্রকাশিত হয়, যাতে এই তথ্য সুনিশ্চিত হয়।
তবে যাই হোক, লক-নেস মনস্টারের কাহিনী আজও শেষ হয়নি, আর মনেহয়, কখোনো তা শেষও হবে না। হালেই খবর পাওয়া গেছে ২০১৮-১৯ সালেও এই লক-নেস এর বিষয়ে খোঁজ খবর চলেছে।
লক-নেসএর মাঝামাঝি, এর পশ্চিম পাড়ে, রযেছে একটা ছোট জনপদ ড্রামনাড্রোচিট, যেখানে এই মনস্টার নেসির বিষয়ে প্রথম খোঁজ পাওয়া গেছিলো। সেখানেই লেকের পাড়ে, আজ গড়ে উঠেছে মনস্টার নেসি খ্যাত, নেসিল্যান্ড সেন্টার। এখানে নেসির বিষয়ে নানারকম সব তথ্য প্রদর্শিত হয়েছে। আজও নানা জায়গা থেকে লোকেরা ছুটে আসে, এই মনস্টার নেসির বিষয়ে খোজ খবর করতে।
আমরা স্কটল্যান্ডের এডিনরবা শহর থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে এসে পৌঁচেছি লক নেস দেখতে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে লক-নেস।
এই লক-নেস, ইউ.কে,র গ্রেট-গ্লেন-মোর এর গ্যেইলিকএর একটি অংশ, যার বিস্তৃতি উত্তরে ইনভারন্স থেকে দক্ষিণে ফোর্ট-উইলিয়াম পর্যন্ত, এবং তার ব্যাপ্তি ষাট মাইলের ওপর। প্রায় দশ হাজার বছর আগে ভৌগলিক কারণে দুই পাশে এই ষাট মাইল ব্যাপী উত্তুঙ্গ দুইটি পাহাড়ের মাঝে ক্ষতের মত এই অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে দুদিকের দুই পাহাড়ের মাঝে এই জায়গাটায় বেশ কতগুলি অতি গভীর হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে, যেমন লক-লোচি, লক-ওইচ, এবং তাদের মধ্যে প্রধান হল লক-নেস। দেখলে মনে হবে স্কটল্যান্ডের পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তরে নর্থ সির মাঝে উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকের দুটি পৃথক ভূখম্ড কোনো এক ধাক্কায় কাছে এসে জুড়ে যেতে যেতেও, মাঝে একটা ফাঁক রয়ে গেছে। আর সেটা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই গ্রেট-গ্লেনএর লেকগুলোর। দুপাশে খাড়াই পাহাড়ের মাঝে এই লক-নেস অতি গভীর(সর্বোচ্চ গভীরতা ৭৫৪ ফুট)। এই লেকে যত জল আছে তার পরিমাণ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলস মিলিয়ে আরও যতগুলি লেক রয়েছে তাদের সম্মিলিত জলের চেয়েও বেশী। এবং সে পুষ্ট হচ্ছে প্রধানতঃ সাতটি প্রধান নদী, যথা ওইচ, টার্ফ, এনরিক, কোইলতি, মরিসটন, ফয়ার্স এবং ফারিগেইগ থেকে আসা জলে। আর এই লেক থেকে জল বের হবার একমাত্র পথ রিভার নেস, যা ইনভারনেসের কাছ থেকে বেরিয়ে লক নেসের জলতলের থেকে ৫২ ফুট নিচে নেমে সমুদ্রে মিশেছে মাত্র সাত মাইল প্রবাহিত হয়ে। কাল আমরা সেসব দেখবো।
আমরা আজ এরপর এখানে লক-নেস দেখে এগিয়ে চললাম আমাদের আজকের পরবর্তী গন্তব্য লক-নেস এর পূর্ব পারের এক পাহাড়ি গ্রাম ফয়ার্সের উদ্দেশ্যে।
0 comments:
Post a Comment