সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

28,049
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


  

আজও ভালোবাসি 

উত্তম চক্রবর্তী


ঠিক দুই বছর আগের এই দিনেই শেষ দেখা হয়েছিল ওদের। সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ, বাংলা আশ্বিন মাসের কোন একটা তারিখ ছিল সেদিন। আকাশ ছিল আজকের মতই পরিষ্কার আর সেই একই রকম বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া বইছিল এই বালিগঞ্জ লেকের পাড়ে। শুধু মাত্র পাঁচ মিনিটেই সুমন সেদিন মেঘনার দেওয়া চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করে নিয়েছিল সেই বিকেলে। দুই বছর বাদের কথা মত সেই আজকের দিনের বিকেল পাঁচটায় সুমন এসেছে ওর প্রাণ ভোমরা মেঘনার সাথে দেখা করে ওদের মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী আজই মেঘনাকে হাতে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করতে।


অবশ্য সুমন পকেটে করে নিজে পছন্দ করে কেনা এই তিরিশ হাজার টাকার সুন্দর আধুনিক ডিজাইনের আংটিটা যে কিনে আনবে সেটা মেঘনার জানবার কথা নয়। দুই বছর আগের সুমন ছিল একজন বেকার ছেলে, মাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে এম কম পাশ করা একটা সাতাশ বছরের ইয়ং হ্যান্ড সাম যুবক। উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মা বাবা এবং এক ছোট বোনকে নিয়ে সুখী পরিবারের খুবই ভদ্র ও শিক্ষিত ছেলে সুমন তখন মনে প্রাণে ভালবেসেছিল ওদের যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ের এম কম ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী মেঘনা চৌধুরীকে। ফর্সা লম্বা ঘন কালো চুল আর সুগঠিত সাস্থের সুন্দরী মেঘনা তখন ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছেলেদের ক্রাশ। কিন্তু পড়াশুনায় ভীষণ ভাল আর হ্যান্ড সাম প্রায় ছ’ফুট লম্বা আমাদের সুমন ছিল মেয়েদের ক্রাশ।


সুমন একদিন কলেজ লাইব্রেরিতে ওর সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং সেই পরিচয় থেকেই ওদের ইকোনমিক্সের নোট চাওয়া, নোট দেওয়া, ফেরত দিতে গিয়ে ক্যান্টিনে বা লাইব্রেরীতে ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ ইত্যাদি এগিয়ে চলছিল। যতই মেঘনাকে দেখত সুমন ততই ওর দুচোখের গভীরে ডুবে যেত আর হারিয়ে যেত ভবিষ্যতের স্বপ্নে। শেষে একদিন বালিগঞ্জ লেকের এক কোনে গাছ তলায় বেঞ্চে বসে এক সন্ধ্যায় সুমন ওকে বলেই ফেলেছিল সেই তিন শব্দের আন্তর্জাতিক ভালোবাসার কথাটা, যেটা আগেও মেঘনাকে অনেক ছেলেই নাকি একান্তে ডেকে বলেছিল।


মেঘনা কিন্তু সুমনকে বেশ পছন্দ করত এবং ওর চোখের ভাষায় মেঘনা বুঝতে পাড়ত যে সুমন ওকে বেশ পছন্দ করে এবং মনে মনে হয়ত ভালোবাসে। সুতরাং মেঘনা সুমনের কলেজ শেষে ওর জন্য লাইব্রেরীতে অপেক্ষা করায় বা চিরকুট পাঠিয়ে ওকে বালিগঞ্জের লেকের গাছতলায় গিয়ে দেখা করার অনুরোধ করায় বিশেষ অবাক হয়নি। মেঘনা বেশ বুঝতে পেড়েছিল সুমন ওকে প্রপোস করতে পাড়ে আজ। কারণ এরপরেই কাল থেকে কলেজে দুর্গা পূজোর ছুটি শুরু হয়ে যাবে। মেঘনা সেদিন একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ির সাথে ম্যাচ করা ব্লাউজ পরে এসেছিল সুমনের বেশ মনে আছে। সুমনের পরনে ছিল কালো জিন্সের উপর আকাশী রঙের একটা টি সার্ট।


সেদিন সাতাশে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার ঠিক আগে মেঘনা পৌঁছে গিয়েছিল সুমনের চিটে লিখে দেওয়া বালিগঞ্জ লেকের পাড়ে নির্দিষ্ট গাছটির নিচে। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে আর নাম নাজানা পাখীর আওয়াজে ওর স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে ওর প্রেয়সীর সাথে দেখা করতে এসেছিল সুমন। গত রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনেক রকম ভাবে রিহার্সাল দিয়েছে সুমন। একবার ভেবেছে চিঠি লিখে মেঘনাকে প্রপোস করবে, বেশ কিছু চিঠির ড্রাফ্‌ট করে পরে সেগুলি ছিঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর ভাবে নাঃ, যা বলবার সাহস করে একদম সামনা সামনি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে আজ মেঘনাকে বলেই ফেলবে যে সুমন ওকে ভালোবাসে, ভীষণ ভালোবাসে। মেঘনা চৌধুরীকে সুমন মুখার্জি বিয়ে করতে চায়।


সুমনের দৃঢ় ধারনা ছিল মেঘনা নিজেও সুমনকে চায়, ওকে ভালোবাসে। কারণ যখনই সুমন ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়াশুনার কথা, নোটসের কথা আলোচনা করেছে তখনই মেঘনার বড় বড় দুই চোখের গভীর দৃষ্টিতে তাকানো যেন অনেক অনুচ্চারিত কথা বলেছে সুমনকে। সেই কথাগুলি নিশ্চয়ই ওর মনের ভালোবাসার কথা, সুমনকে মনে মনে কামনা করার কথা, যেটা ছিল শুধুমাত্র সুমনের জন্য। সুমন সেটা যাতে বুঝতে পাড়ে, ভাবে সেই জন্যই বোধ হয় মেঘনা মুচকি মুচকি হাসত আর মিষ্টি ভাবে সুমনের সাথে কথা বলত। সুমন তো আর অতো বোকা না যে একটা সুন্দরী মেয়ের চোখের ভাষা বুঝবে না।


তাই সুমন সেই বছর সাতাশে সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অনেক আশা নিয়ে বসেছিল সেই গাছটার নিচের সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে আর মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনছিল। মেঘনা ওর বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সাড়ে পাঁচটার ঠিক পাঁচ মিনিট বাদেই চলে এসছিল সেদিন বালিগঞ্জ লেকে। নীল শাড়ি পরা মেঘনা যেন তখন নীল আকাশ থেকে নেমে আসা এক নীল পরী। সুমন উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখেছিল মেঘনাকে আর হাসি  মুখে ওর ভালোবাসাকে বলেছিল, “বোসো মেঘনা।” মেঘনা মুচকি হেসে বেঞ্চের একধারে বসে বলেছিল, “বলুন, কী বলবেন।”   


সুমন আগের রাতের প্র্যাকটিস করা কথা মুখস্ত বুলিটা বলেই ফেলে। মেঘনার সুন্দর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে সুমন বলেছিল, “ আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম মেঘ, আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। আমি তোমাকে ভালবাসি মেঘ, খুব খুব ভালোবাসি আর সাড়া জীবন কাটাতে চাই তোমার সাথে। ” ওদের আসেপাশে কয়েকটা পাখী আর টুকরো টুকরো কিছু মেঘ শুধু সাক্ষী ছিল তখন সুমনের এই প্রেম নিবেদনের। 


মেঘনা কিন্তু মোটেই অবাক হলনা। ও বেশ জানত সুমন কেন ডেকেছে ওকে একান্তে কথা বলতে চায় বলে। মেঘনা একটু মাথা নিচু করে বসে ছিল। সুমন উদবিঘ্ন হয়ে আবার একই কথা বলে বলেছিল, “মেঘ শুনছ, তুমি বুঝতে পাড়ছ, আমি তোমাকে ভালোবাসি মেঘ। আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। তোমাকে বিয়ে করে সুখী হতে চাই মেঘ। তুমি কিছু বল মেঘ।” মেঘনা এবার মুখ তুলে শুধু বলেছিল, “কিন্তু সুমন, আমার সাথে তোমার কোন রিলেশন তো হতে পারবে না সুমন।”


সুমন চমকে উঠেছিল। তার মানে, মেঘের কি অন্য কেউ আছে ? মেঘ কি কাউকে ভালোবাসে আর তাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে ? কে সে ? সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “সে কি মেঘ ? কেন বলছ এই কথা ? তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো মেঘ, নাকি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ? আমার সাথে তোমার রিলেশন হতে পারবেনা কেন মেঘ ?” মেঘনা শাড়ির আঁচল পেঁচাতে পেঁচাতে বলেছিল, “না সুমন, আমার কোন লাভার নেই বা আমার বিয়েও ঠিক হয়ে যায় নি।”  সুমন একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,“তাহলে ? তুমি কি আমাকে পছন্দ করো না মেঘ ? আমি কি তোমার যোগ্য নই ? ”   


মেঘনা মুখ তুলে বলেছিল, “না সুমন। আমি তোমাকে খুব লাইক করি, বিশ্বাস কর। সেটা কথা না।” সুমন আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে , “তাহলে মেঘ ? কিসের অসুবিধা যে তুমি আমার সাথে রিলেশন করতে চাইছ না ?” মেঘনা একটু চুপ করে থেকে বলে, “ আমার সাথে তোমার কোন রিলেশন হতে পারেনা সুমন কারণ আমি একজন মুসলমান। আমার পরিবার বা সমাজ কিছুতেই এটা মেনে নেবেনা সুমন। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না প্লিস। ” মেঘনা মুসলমান মেয়ে ? সুমন চমকে উঠেছিল যেন। আবাক দৃষ্টিতে মেঘনাকে দেখতে দেখতে বলেছিল,“ কিন্তু তুমি তো চৌধুরী ! তুমি তো হিন্দু মেঘনা। ” মেঘনা জবাব দিয়েছিল, “না সুমন, চৌধুরী মানেই কিন্তু হিন্দু নয়। আমরা মুসলমান। আমার বাবা মা কিছুতেই তাদের একমাত্র মেয়েকে হিন্দুর হাতে তুলে দেবেননা। দাদারও একজন হিন্দু বান্ধবী ছিল। কিন্তু ওকেও বাবা মার পছন্দ করা মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করতে হয়েছে সুমন। সুতরাং আমি পারবনা তোমাকে বিয়ে করতে। আমাকে মাফ করে দাও প্লিস।”


আহত সুমন তাও হাল ছাড়ে নি সেদিন। জিজ্ঞাসা করেছিল, “ কিন্তু তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না মেঘ ? সত্যি করে বলতো।” মেঘনা সুমনকে অবাক করে দিয়ে বলেছিল, “ হ্যাঁ, আমিও তোমাকে ভালোবাসি সুমন। খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা অসম্ভব সুমন। কিছু মনে করো না। ভেবেছিলাম তুমি জানতে আমার আসল পরিচয়।”


সুমন একটু চুপ করে থেকে এবার ভেঙ্গে পড়েছিল, ছল ছল চোখে বলেছিল, “ কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না মেঘ। আমি তোমার সাথে সাড়া জীবন কাটাতে চাই।”


মেঘ এক অদ্ভুত জবাব দিয়ে বলেছিল, “সুমন, আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় এটা তুমি আউট অফ ইমোশন বলছ কথাগুলি।  কিছুদিন আমার থেকে দুরে থাকলেই দেখবে এই ইমোশন কেটে যাবে। তুমি আমাকে ভুলে যাবার চেষ্টা কর সুমন। আমিও তোমাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করব ঠিক করেছি। আমাদের আর দেখা হওয়াটাও ঠিক নয়। তাতে তোমার আমার দুজনেরই বদনাম হবে সুমন। প্লিস বুঝবার চেষ্টা কর।”


সুমন হাল ছাড়ে নি। শক্ত মন নিয়ে বলেছিল, “আমার কথাগুলি মোটেই আউট অফ ইমোশন নয় মেঘ। আমি তোমাকে মনে প্রাণে ভালোবাসি। তোমার থেকে দুরে থাকলেও আমি সেই তোমাকেই ভালবাসব, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি কোনদিন বিয়েই করব না মেঘ। শুধু একবার হ্যাঁ বল প্লিস। বাকিটা আমি বুঝে নেব মেঘ, প্লিস তুমি হ্যাঁ বল একবার।”


মেঘনা সেদিন হ্যাঁ বলেছিল। কিন্তু তার জন্য মেঘনা দিয়েছিল এক কঠিন শর্ত। সুমনকে মেঘনা বলেছিল, “ ঠিক আছে সুমন। তুমি আমাকে কতটা ভালবাস তার একটা পরীক্ষা তোমাকে দিতে হবে। যদি তুমি সেই পরীক্ষায় পাশ করে যাও তবে আমি কোনরকম বাঁধা না মেনে তোমাকেই বিয়ে করব সুমন। আজ থেকে ঠিক দুই বছর বাদে আজকের এই তারিখে এই একই গাছের নিচে এসে আমি তোমার অপেক্ষা করব। তুমি এই দুই বছর আমার সাথে কোনরকম যোগাযোগ করবে না সুমন। আমিও তোমাকে ফোন করে বা দেখা করে যোগাযোগ করব না কথা দিচ্ছি। এই দুটো বছর যদি তুমি আমার থেকে দুরে থেকেও আমাকে ভালবাসতে পার তাহলে আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমারই হব সুমন।”


আজ সেই দুই বছর বাদের দিনটা। সুমন সত্যি সত্যি মেঘনার চালেঞ্জ একসেপ্ট করে নিয়েছিল, চাকরি নিয়ে চলে গেছিল দিল্লিতে। ওর ফোনের সিম কার্ড পাল্টে, ফেস বুকের বা ইনষ্টাগ্রামের আই ডি মুছে ফেলে সুমন মেঘের সাথে সমস্ত সম্পর্ক মুছে দিয়েছিল। সুমন দিল্লির মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরিতে দুই বছরের মধ্যেই যথেষ্ট সুনাম করেছে এবং আজই সকালের ফ্লাইটে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছে সুমন। আজ বালিগঞ্জ লেকের বাগানের এই বেঞ্চে ঠিক সময়ে এসেছে সুমন ওর ভালোবাসাকে প্রপোস করার আশা নিয়ে।


সুমন সেই নির্দিষ্ট বেঞ্চের কাছাকাছি এসে একটু দুর থেকে দেখল বোরখা পরা একজন মহিলা কোলে একটা শিশুকে নিয়ে বসে আছে সেখানে। সুমন একটু অবাক হয়ে বেঞ্চটা পার হয়ে এগিয়ে গেল। ভাবল এই বেঞ্চে মেঘনার এসে বসবার কথা। এই বোরখা পরা বিবাহিতা মহিলা না সরলে ও ওখানে গিয়ে দাঁড়াবে কী করে ? সুমন একটু এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে। সেই বোরখা পরা মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে ওকে হাত তুলে কাছে ডাকছে। কোলের সেই বাচ্চাটাকে বুকে চেপে মহিলা সুমনের দিকেই যেন তাকিয়ে আছে। সুমন দাঁড়াতেই মহিলা বোরখার নাকাব উঠিয়ে তাকাল। সুমন অবাক হয়ে দেখল সামনের বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওর মেঘনা। মেঘনার কোলে সন্তান।


তাহলে নিশ্চয়ই মেঘনা বিয়ে করে ফেলেছে। সুমনের মনটা একদম ভেঙ্গে যায়। তবুও সেই ভাঙ্গা মন নিয়ে মেঘনার সামনে এসে দাঁড়াল সুমন। মেঘনাকে বসতে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছ মেঘ ? আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি।”  


মেঘনা সুমনের পাশে বসে ছলছল চোখে বলল, “আমি জানি তুমি আজ এখানে ঠিক আসবে সুমন। এই দুই বছর তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার ফোন নম্বর সেই যে তুমি ডি একটিভেট করে দিয়েছিলে বা ফেস বুক আর ইন্সটাগ্রাম থেকে দুরে সরে গেছিলে, আমি তোমাকে কিছুতেই আর খুঁজে পাইনি সুমন। অনেক চেষ্টা করেছি , বিশ্বাস কর সুমন। আমি যে কী বলে তোমাকে বোঝাব সেটাই বুঝতে পারছি না।”


সুমন কথা ঘোরাবার জন্য জিজ্ঞাসা করে, “এই শিশুটা কার মেঘ ? তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা না করে বিয়ে করে ফেলেছ মেঘ ? এই বাচ্চাটা কি তোমারই সন্তান ? ”  


মেঘনা এবার ভেঙ্গে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, “ তুমি চলে যাবার তিন মাসের মধ্যেই বাবা আমাকে জোর করে সাদি করান সুমন। আমি এখন নিকাহ করব না, চাকরি করব বলে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাবা বোধ হয় কিছু আন্দাজ করেছিলেন, সময় নষ্ট না করে তার এক বন্ধুর ছেলে মুরশেদের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন। আমি তোমাকে কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি সুমন। আমার আর মুরশেদের একমাত্র ছেলে এই সাবির আহমেদ। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি সুমন। আমাকে মাফ করে দাও তুমি।” মেঘনা কাঁদতে থাকে। শিশুটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।


সুমন মেঘনা বিয়ে করে ফেলেছে আর ওদের এই একটা বাচ্চা ছেলেও আছে জেনে একটু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইল সেই শিশুটার দিকে। বাচ্চাটা তখন সুমনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সুমন ওর মাথায় হাত রেখে আদর করে মেঘনার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার কথা মত তোমার কাছ থেকে দুরে দিল্লিতে চাকরি নিয়ে চলে গেছিলাম মেঘ। আজই সকালের ফ্লাইটে এসেছি দুই বছর আগের আজকের দিনে দেওয়া কথা রাখতে। তোমার সাথে যাতে আর কোন যোগাযোগ না করতে পারি বা তুমিও সেটা না করতে পার তাই ঐ সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তা তোমার কর্তা কী করেন মেঘ ?”


এবার সুমনকে অবাক করে দিয়ে মেঘনা আবারও কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “ মুরশেদ আর নেই সুমন। উনি এখন মাটির নিচে চির নিদ্রায় শায়িত। আমি এখন একজন উঁইডো সুমন...” মেঘনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।


মেঘনার দুঃখে বুক ফেটে যায় সুমনের। এতো তাড়াতাড়ি মেঘ বিধবা হয়ে গেল ! হা কপাল। ভগবান কেন ওকে এতো দুঃখ দিলেন ? এই শিশুটাকে নিয়ে মেঘ এখন কত বিপদে পড়েছে।  সুমন জিজ্ঞাসা করল, “ কী হয়েছিল মুরশেদের মেঘ ?”


মেঘনা জবাব দেয়, “অফিস থেকে ফেরার পথে মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টে মারা যান উনি। আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সুমন। আমি এখন কী করব বলে দাও সুমন। এই দুধের শিশুটার জন্য আত্মহত্যাও যে করতে পারছিনা।”


সুমন মেঘের হাতে আংটিটা পরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি তো আছি। আমি আজও তোমাকেই ভালোবাসি মেঘ। তোমাকে আল্লাহ যে শুধু আমার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন মেঘ।”

0 comments: