সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 



আমার হস্তিদর্শন (তৃতীয় পর্ব) 
অনুরাধা মুখার্জী 


        
একটি মর্মান্তিক মৃত্যু 

     আবার ফিরে এলাম মেহেসির সেই ইঁদারার ধারে ।আমার মানুষ দেখার সূত্রপাত হয়েছিল এইখানে ।কতরকম লোকজনের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে ।এইখানে দেখেছি ভাল্লুকনাচ ।ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর আর তার সঙ্গিনীর মান -অভিমান ও মানভঞ্জনের পালা ।শুধু ছাগল, বাঁদর, কুকুর ও টিয়াপাখি নিয়ে সার্কাসের খেলা ।দেখেছি ভানুমতীর খেলা ।আমার ভাইয়ের নাক দিয়ে অন্তত পঁচিশ টা রূপোর টাকা বার করে দিতে ।আজো মনে পড়ে বেচারার আকুল কান্না -'আমি কোনো টাকা নিই নি ।'আবার নৌটঙ্কি দেখার প্রথম ও শেষ সুযোগ এখানেই পেয়েছি ।আগেই বলেছি রেলোয়ে স্টেশনের কাছে ই থাকার দরুণ যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থাও দেখেছি ।কোনো বিশেষ মহিলা যাত্রী আসার খবর পেলে বাড়ী থেকে পালকি আসত আর তা না হলে গোটা দুয়েক গরুর গাড়ি ছিল সম্বল ।তাতেও শ্রেণীবিভাজন ছিল ।রইস যাত্রী দের জন্য ছই ঢাকা গাড়ী যার চাকা গুলো ছোট ছোট আর টায়ার মোড়া ।আর সাধারণ মানুষের জন্য ছিল বিশাল বিশাল কাঠের চাকাওলা গো -যান যেগুলো 'ওরে বাবা আরপারিনা জাতীয় প্রতিবাদ ধ্বনি ক্যাঁচকোঁচ রবে জানাতে জানাতে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলত ।দুরকম গাড়ীর বলদদেরও সাজসজ্জার পার্থক্য ছিল ।এছাড়া আর একটি সওয়ারি ছিল -হাতি, শর্মাজির হাতি ।যদিও প্রতিদিন যাত্রী পেতনা কিন্তু মাহুতের সঙ্গে সে রোজ দুবেলাই আসত ।আমার মনে হয় তার ও বোধহয় ট্রেন দেখার নেশা ছিল আমাদের মতো ।দশটার ট্রেন চলে গেলে সে আসত ইঁদারার ধারে, একটু পরে শর্মাজিও আসতেন ।নিঃসন্তান শর্মাজির বেটা  (এই নামেই শর্মাজি ডাকতেন তাকে )তারপর শুরু করত জলনিয়ে খেলা ।মাহুত বালতি করে জল তুলত আর সে জলখেত, শুঁড়দিয়ে জল ছেটাতো ইচ্ছে মতো ।মাঝে মাঝেই দুষ্টুমি করে আমাদের গায়ে জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিত ।তারপর শর্মাজির ধমক খেয়ে শুঁড় তুলে সেলাম জানাত ।আবার কখনো কখনো জরিমানা স্বরূপ মাটিতে বসে শুঁড় দিয়ে আমাদের পিঠে তুলে নিত তারপর খানিকদৃর ঘুরিয়ে আনত ।যদিও শর্মাজি নিজে বা মাহুত সঙ্গে থাকত তবুও ভয় পেতাম ।তবে ও কিন্তু আমাদের প্রতি খুবই বন্ধু ভাবাপন্ন ছিল ।আরেকটা আশ্চর্যের বিষয় ছিল আমার বাবাকে দেখলে কিন্তু শুঁড় তুলে সেলাম জানাত না ।মাটিতে বসে সামনের দুটো পা ছড়িয়ে দিত তারপর নিজের মাথা টা পায়ের ওপর রেখে শুঁড়টা সামনে লম্বা করে দিত ।এটা ছিল তার প্রণাম ।এও শর্মাজির শিক্ষা ।
        এবার আসি তার বৈকালিক পর্বে ।বিকেলের ট্রেন চলে গেলে সে আসত মিষ্টির দোকানের সামনে ।এবং শুঁড়দিয়ে কোনো একটি পরাত  (বড় কাঠের বারকোশ ) দেখাত ও দোকানি সম্পূর্ণ পরাতটি তার সামনে ধরে দিত ও সেটি সম্পূর্ণ শেষ করে সে রওনা দিত বাড়ীর দিকে ।রাতে শর্মাজি এসে দোকানির দাম মেটাতেন ।আমার মনে হয় এতে দোকানিদের লাভ বেশি হত কারণ ঐ জায়গায় এক পরাত মিষ্টি বিক্রি হওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না ।
     আচমকা শর্মাজির হাতির আসা বন্ধ হয়ে গেল ।আমাদের একমাত্র অবোলা বন্ধু টি না আসাতে আমাদের আর সময় কাটে না ।শুনলাম হাতি নাকি গরম হয়েছে ।তাকে মোটা মোটা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ।মা আমাদের ওপর কার্ফ্যু জারি করলেন বাড়ি থেকে এক পাও বাইরে রাখবে না ।সম্পূর্ণ গৃহবন্দী হয়ে জানলা দিয়ে ট্রেন দেখে সময় কাটাই ।দুতিনদিন কাটল এভাবে ।তারপর এল সেই চরম দিন ।খবর পেলাম হাতি শিকল ছিঁড়ে মাহুত কে মেরে ফেলেছে আর দোকান পাট ভাঙতে ভাঙতে এদিকে ই আসছে ।মা তো কান্না কাটি শুরু করে দিলেন ।মাটির বাড়ি তাই মায়ের ভয় অসঙ্গত ছিল না ।কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতি এসে দাঁড়ালো ইঁদারার ধারে ।ঠিক পিছনে শর্মাজি,হাতে বন্দুক ।হাতি একটু দাঁড়াতেই শর্মাজি হাঁক পাড়লেন "বেটা রুক জাও, হিলো নহী "।কি আশ্চর্য হাতি স্থির হয়ে দাঁড়ালো ।শর্মাজি পরপর গুলি চালালেন ।প্রথম কেঁপে উঠল ঐ বিশাল শরীর, তার পর শুঁড় তুলে সেলাম জানালো তারপর মাটিতে বসে প্রণাম জানালো মালিকের উদ্দেশে আর তারপরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে ।শুধু ছোট ছোট দুই চোখ দিয়ে জল ধারা বেরিয়ে এল আর সারা শরীর থরথর করে কিছু ক্ষণ কেঁপে স্থির হয়ে গেল ।ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন শর্মাজি ।তারপর একসময়ে বন্দুক ফেলে দিয়ে লুটিয়ে পড়লেন হাতির গায়ের ওপর আর তারপর সেই আকুল কান্নার বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যাতীত ।যে পিতা নিজের হাতে একমাত্র সন্তান  (হোক সে দোষী)কে হত্যা করে তার শোকের পরিমাপ করা আমার পক্ষে আজো সম্ভব নয় ।

0 comments: