সম্পাদকীয়
এক স্বদেশের খোঁজে
সবারই তো স্বদেশ থাকে । সবারই থাকে কি ? যে নিজের ভিটেমাটি , চিরচেনা পরিবেশ , বন্ধু-পরিজন ছেড়ে অপরিচিত প্রতিবেশে চলে যায় তার তো দেশ হারিয়ে যায়। স্বদেশ হয়ে যায় স্মৃতির রেণু। কিন্তু নতুন দেশ , নতুন মাটি , নতুন মানুষওতো একদিন চেনা হয়ে যায় । নতুন দেশও একদিন কি নিজের দেশ , স্বদেশ হয়ে যায় না ? তখন কি তার হয় দুটো স্বদেশ - নতুন আর পুরোনো ? চোখ বন্ধ করে সে কোন দেশের ছবি দেখে ? গভীর স্বপ্নে কোন মানুষরা ধরা দেয় ?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে স্বদেশ কাকে বলে । স্বদেশের ভূগোল কোনটা ? কোন মানচিত্রে স্বদেশ আঁকা থাকে ? মনের গভীরে ডুব দিলে যে স্বদেশের ছবি ফুটে ওঠে তার খোঁজ তো ভূগোলকে পাওয়া যায় না। কারণ প্রায় তর্কাতীতভাবেই বোধহয় বলা চলে মাটির পৃথিবীতে প্রিয় স্বদেশ নেই । হ্যাঁ নেই । স্বদেশ আছে মানুষের মনে । মনের গভীরতম পলিতে প্রোথিত থাকে স্বদেশ । বাস্তব-কল্পনা-স্মৃতি-আদর্শ দিয়ে স্বদেশের মানচিত্র আঁকে মানুষ । বাস্তবের থেকে বোধহয় বাকি তিনটি বর্ণের আধিক্যই থাকে বেশি । সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ যত না উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর বাংলা বা ভারত , তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁর কল্পনা ও আদর্শে আঁকা চিরদিনের বাংলা , চিরায়ত ভারত । বিবেকানন্দর স্বদেশও বৈদিক যজ্ঞধূমের কুণ্ডলী থেকেই রূপ পেয়েছে । ঐতিহাসিকতা নয় তাঁর স্বপ্ন , তাঁর আদর্শ , তাঁর বিশ্বাসই তাঁর স্বদেশের মানচিত্র অঙ্কন করেছে । বিপ্লবীরা যে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে জীবনমৃত্যু তুচ্ছ করতেন সেই স্বদেশও তাঁদের স্বপ্নসৃজন । স্বদেশ তাঁদের কাছে শুধু মাটি নয় , শোষিত মানুষ নয় , তাঁদের মা । দেশমাতৃকা । এই আদর্শ- কল্পনা -স্বপ্ন হতে পারে বাস্তব নয় কিন্তু এঁদের চোখে অতিমাত্রায় সজীব ও প্রিয়।
এই স্মৃতি ও কল্পনার রঙেই মানুষ আঁকে তার প্রিয় স্বদেশ । সে দেশে সে থাকুক বা দেশ ছেড়ে দূর বিদেশে স্বদেশ কখনও তাকে ছেড়ে যায় না । তার স্বপ্নে থেকে যায় স্বদেশ । বোধহয় ঘর ছেড়ে দূরে গেলেই মানুষ তার স্বদেশকে পায় বেশি আপন করে। স্মৃতির উপদান যেই দেশে বেশি থাকে , যেই দেশ তার স্বপ্নে রোজ ধরা দেয় সেটাইতো তার স্বদেশ । এমনকি সেই স্মৃতি পূর্বপুরুষের থেকে হস্তান্তরিত হলেও চলে । এ কারণেই পশ্চিমবাংলায় জন্ম নেওয়া , কখনও পুববাংলা না দেখা , অসংখ্যজনের কাছে পূর্বপুরুষের ফেলে আসা ভিটে , ছেড়ে আসা গ্রামই আজও স্বদেশ । কারণ সেই তালিবনশ্যাম বাংলা , সেই নদী- প্রান্তর- আকাশ যে শুধু স্মৃতি দিয়ে ঘেরা তাই ই নয় , ফেলে আসা দিনের তাঁতে , স্মৃতির সুতোয় যে তার বয়ন । তার না দেখা , না পাওয়া সেই দেশের গল্প তার মনে যে আলপনা এঁকে রেখেছে তা চির-অমলিন। ফেলে আসা সময় , ছেড়ে আসা গ্রাম , পাড়া , দেশ আমাদের স্বদেশ। যদি কোন স্বপ্ন , আশা , উচ্চ আদর্শ না থাকে তবে বর্তমানের দেশটাকে আমরা প্রিয় স্বদেশ বলে ভাবতেই পারি না , নিতান্তই এক রাজনৈতিক মানচিত্র আর ভূপ্রাকৃতিক আয়তন হয়েই থেকে যায় ।
আত্মসর্বস্ব , স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া এই সময়ে আমাদের মনে গভীর ঘুমে কোন মানচিত্র ভেসে ওঠে তা আজ তাই এক জরুরি প্রশ্ন । কারণ স্বদেশ না থাকা মানুষ যে শিকড়হীন । যার স্বদেশ নেই সেই মানুষের ঐতিহ্য নেই , সংস্কার নেই , ভাষা নেই , সংস্কৃতি নেই , অতীত নেই , ভবিষ্যত নেই । সে এক বর্তমান-সর্বস্ব , গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসে চলা না-মানুষ । আদৌ মানুষ আজ স্বদেশ চিন্তা করে কিনা , নাকি শিকড়হীন বর্তমানই বাঙালির ভবিষ্যত তার অনুসন্ধান আজ বড় জরুরি। বিশ্বায়ন ও ভোগবাদের গ্রাসে বাংলার সংস্কৃতি আজ ধ্বস্ত । মাঝেমধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী হুঙ্কারই কি বাংলার স্বদেশচিন্তার একমাত্র পরিচায়ক ? বাংলা ও বৃহত্তর ভারত নিয়ে বাঙালির কি কোন ভাবনা , কল্পনা ও স্বপ্ন আজ আর অবশিষ্ট নেই ? এসবই আমাদের বর্তমান সংখ্যার উপজীব্য ।
পাঠকদের জন্য রইলো চিন্তার খোরাক এবং অবশ্যই আমাদের অনিঃশেষ শুভেচ্ছা ।
ধন্যবাদান্তে
অঙ্কুর রায়
সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্তী
প্রধান সম্পাদক
0 comments:
Post a Comment